পাটকল বন্ধে নেই আয়, বিজেএমসিতে বাড়ছে ঋণের চাপ
সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সব পাটকল বন্ধের কারণে প্রায় দেড় বছর যাবৎ বাংলাদেশ জুট মিল কর্পোরেশনের (বিজেএমসি) কার্যত কোনো আয় নেই।
তবে সরকারি ব্যাংকে বিজেএমসি নিয়ন্ত্রিত মিলগুলোর প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার ঋণ রয়েছে।
এই ঋণ পরিশোধ হয়নি, বরং মিলগুলোর অপারেশন না থাকায় সুদ পরিশোধে বেকায়দায় পড়েছে বিজেএমসি।
কারণ মিলগুলোর আয় থেকেই দীর্ঘমেয়াদী ঋণের কিস্তি ও সুদ পরিশোধ করা হয়েছে।
আর মিলগুলোর অন্যান্য ব্যয় নির্বাহে সরকার ভর্তুকি দিলেও বছরের পর বছর লোকসান গুনেছে বিজেএমসি।
বিজেএমসির ঋণের সুদ মওকুফের বিষয়ে গত জুনে অর্থ মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়।
সেই সূত্রে বিজেএমসি ও নিয়ন্ত্রণাধীন মিলসমূহের নিকট বাণিজ্যিক ব্যাংকের ঋণ পরিশোধের বিষয়ে গত ১৮ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি দেয় আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ।
চিঠির উত্তরে গত ২৭ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে জানিয়েছে ঋণের সুদ মওকুফের বিষয়ে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত ব্যাংক নিজ নিজ সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংক এটাও বলেছে যে, সরকারি ব্যাংক পরিচালনার ক্ষেত্রে আর্থিক প্রতিষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, কাজেই সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের সাথে আলোচনা করে আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বিভাগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ সমীচীন হবে।
বিজেএমসির চেয়্যারম্যান মুহাম্মদ সালেহউদ্দিন টিবিএসকে বলেন, "সুদ মওকুফের জন্য আমরা পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের মাধমে অর্থমন্ত্রণালয়ে আবেদন জানাব।"
তিনি বলেন, "মিলগুলোর ঋণ রয়েছে, সেটা অর্থমন্ত্রণালয় থেকে বরাদ্দ পাওয়ার পর সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে পরিশোধ করা হবে। কারণ মিলগুলো দীর্ঘদিন বন্ধ, কোনো আয় নেই।"
তিনি বলেন, "এই ঋণের প্রিন্সিপাল অ্যামাউন্ট অর্থ মন্ত্রণালয় দিবে, সেটা ব্যাংককে পরিশোধ করার পর সুদ মওকুফের বিষয়ে আবেদন করবো।"
পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের সুদ মওকুফের চিঠির বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, "আমি এখনো কোনো চিঠি পাইনি।"
লোকসানের ভার কমাতে ২০২০ সালের ১ জুলাই একযোগে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব সব পাটকল বন্ধ ঘোষণা করে সরকার। এসব মিলে প্রায় ২৫ হাজারের বেশি মানুষের কর্মসংস্থান ছিল।
তবে মিলগুলো বন্ধ ঘোষণার পর এবার বেসরকারিকরণ করছে সরকার। মূলত ভাড়াভিত্তিক লিজ প্রদানের মাধ্যমে পুনরায় চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে তিনটি মিল উৎপাদনে ফিরেছে। আরও কয়েকটি মিল বেসরকারি উদ্যোক্তাদের হাতে হস্তান্তরের প্রক্রিয়া রয়েছে।
২০১৯-২০ অর্থবছরের হিসাব অনুযায়ী, বিজেএমসির আওতাধীন মিলসমূহে চলতি দেনা ৩৪৩৮.৭৮ কোটি টাকা আর দীর্ঘমেয়াদে ব্যাংক ঋণ ৯৪৪০.৩৩ কোটি টাকা।
সবচেয়ে বেশি ব্যাংক ঋণ নিয়েছে খুলনা অঞ্চলের মিলগুলো। খুলনা অঞ্চলে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব পাটকলের সংখ্যা ৯টি। খুলনা অঞ্চলের মিলগুলোর ব্যাংক ঋণের পরিমাণ ৪৫২১.৬৮ কোটি টাকা।
ঢাকা অঞ্চলের সাতটি মিলে ব্যাংক ঋণের পরিমাণ ২৯৯০.৩০ কোটি টাকা আর চট্টগ্রাম অঞ্চলের ১০টি জুটমিলের ঋণের পরিমাণ ১৮৮৪.৩৪ কোটি টাকা।
এর মধ্যে ঢাকা ও চট্টগ্রাম অঞ্চলভুক্ত তিনটি নন-জুট পাটকলের ঋণের পরিমাণ ৪৩.৯৯ কোটি টাকা।
সর্বশেষ ২০২১-২২ অর্থবছরে ঋণের সুদ পরিশোধে ৭৬.৫৭ কোটি টাকা ব্যয় দেখিয়েছে বিজেএমসি। এর আগের বছরও বিজেএমসি ৭১.৩৮ কোটি টাকা সুদ পরিশোধ করেছে।
বিজেএমসির কর্মকর্তারা জানান, জুটমিলগুলো পরিচালনার জন্য বিভিন্ন সময় রাষ্ট্র পরিচালিত ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল সাপোর্ট দেওয়া হয়েছে। মিল চালু থাকায় প্রিন্সিপাল ফেরত না দিয়ে কেবলমাত্র সুদ পরিশোধ করা হয়েছে।
তারা জানান, এখন মিল বন্ধ, তাই কোনো আয় নেই, কাজেই সুদ-ব্যয় পরিশোধ করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে বলা হয়েছে, সরকারি নির্দেশনা মোতাবেক বিজেএমসির পাটকলসমূহ ২০২০ সালের ১ জুলাই থেকে বন্ধ অবস্থায় রয়েছে এবং দীর্ঘদিন মিলসমূহের পাট ও পাটপণ্য ক্রয়-বিক্রয় কার্যক্রম নেই। সুতরাং ঋণ হিসাব সমূহ মন্দ/ক্ষতিজনকমানে শ্রেণীকরণযোগ্য মর্মে অনুমিত হয়।
চিঠিতে বলা হয়, "ঋণ শ্রেণীকরণ বিষয়ক নীতিমালা মোতাবেক শ্রেণীকৃত ঋণ হিসাবে সুদ আরোপ না করে তা পৃথক লেজারে সংরক্ষণ করতে হয়, ফলে ঋণের লেজার স্থিতি বৃদ্ধি না পেলেও অনারোপিত সুদের ফলে মিলসমূহের দেনা ঠিকই বৃদ্ধি পাচ্ছে। অর্থাৎ সরকার কর্তৃক পরিশোধ্য অর্থের পরিমাণও দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।"
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, বাণিজ্যিক ব্যাংক গ্রাহকের আমানতকৃত অর্থ ঋণ হিসাবে বিতরণ করে এবং চাহিদামাত্র গ্রাহককে তার আমানতকৃত অর্থ সুদসহ ফেরত দিতে বাধ্য। ফলে নির্দিষ্ট পরিশোধসূচী মোতাবেক সুদসহ ঋণ আদায় না হলে ব্যাংকের তারল্য ব্যবস্থাপনা কঠিন হয়ে পড়ে।"
চিঠিতে বলা হয়, বিজেএমসির মিলসমূহ বন্ধ থাকায় এসব প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে বিতরণকৃত ঋণসমূহের কিস্তি আদায় হচ্ছে না মর্মে অনুমিত হয়। সরকারি সুদ ভর্তুকি ব্যতীত ঋণের উপর সুদারোপ বন্ধ করা হলে ব্যাংকের আয়ের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ার শঙ্কা রয়ে যায়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চিঠিতে আরও বলা হয়, রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংকসমূহের মূলধন সরকার কর্তৃক প্রদত্ত এবং এসকল ব্যাংক পরিচালনার ক্ষেত্রে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
কাজেই পাটকলসমূহের অনুকূলে সর্বোচ্চ কী পরিমাণ সুদ মওকুফ সুবিধা প্রদান করা যাবে, সরকার হতে ভর্তুকি গ্রহণ ব্যতিরেকে সুদ মওকুফের অভিঘাত ব্যাংকসমূহ কতটা বহন করতে সক্ষম, সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ সমীচীন হবে মর্মে বাংলাদেশ ব্যাংক মনে করে।