প্রয়োজনে ব্যবসায়ীদের আরও কর ছাড় দেওয়া হবে: অর্থমন্ত্রী
শুল্ক-কর প্রয়োগের ক্ষেত্রে সরকার আরও নমনীয় থাকবে জানিয়ে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, প্রস্তাবিত বাজেটই চূড়ান্ত নয়। প্রয়োজনে ব্যবসায়ীদের শুল্ক ও করে আরও ছাড় দেওয়া হবে। কোথাও করহার বাড়ানো হবে না।
শুক্রবার বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, বেসরকারিখাতে বিনিয়োগ ও উৎপাদন বাড়ানোর মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টির উদ্দেশ্যে ব্যবসায়ীদের শুল্ক-করে ছাড় দিয়ে প্রস্তাবিত বাজেট পুরোটাই ব্যবসায়ী বান্ধব করা হয়েছে।
'সরকার যেহেতু কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারে না, তাই বাজেটে বিভিন্ন সুবিধা দিয়ে বেসরকারিখাতকে চালকের আসনে বসিয়ে তাদের সাহায্য করার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। রাজস্ব আদায়ের পাশাপাশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা সরকারের উদ্দেশ্য'- যোগ করেন তিনি।
'অতীতে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে অন্যায় হয়েছে উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, যারা বেশি আয় করেন, তাদের ওপর বেশি হারে করারোপ করা হতো। অথচ হওয়ার কথা ছিল এর উল্টোটা। কারণ, যারা সীমিত সম্পদ ব্যবহার করে অধিক সম্পদ সৃষ্টি করতে পারে, তাদের ছাড় দেওয়া দরকার ছিল। এসব বিষয় যতোটা সম্ভব পর্যালোচনা করে এবার সহজ ও সার্বজনীন করার চেষ্টা করেছি'- জানান মন্ত্রী।
কোভিড সংক্রমণের পর অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক খারাপ হলেও এখন সবগুলো সূচক ইতিবাচক অবস্থায় ফিরেছে জানিয়ে তিনি বলেন, প্রস্তাবিত বাজেট বিনিয়োগ বাড়াবে। তাতে নতুন করে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। এর মধ্য দিয়েই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকা রক্ষা পাবে।
অর্থমন্ত্রী বলেন, 'অর্থনৈতিক কর্মকান্ড চাঙ্গা রাখতে বাজেট পুরোটাই ব্যবসায়ী বান্ধব করা হয়েছে। আশা করি, ব্যবসায়ীরা এ সুযোগ নিয়ে বিনিয়োগ ও উৎপাদন বাড়াবে। আর উৎপাদন বাড়াতে গেলে অবশ্যই কর্মসংস্থানও বাড়াতে হবে'।
তিনি বলেন, বাজেট পুরোটাই ব্যবসা বান্ধব। আশা করছি, তারা এই সুযোগ নেবেন এবং বিনিয়োগ বাড়িয়ে উৎপাদনে যাবেন। আর উৎপাদন বাড়াতে হলে কর্মসংস্থান স্বাভাবিকভাবেই সৃষ্টি হবে। দেশীয় পণ্যের সম্ভাবনা কাজে লাগাতে 'মেইড ইন বাংলাদেশ' শিরোনামে রপ্তানিমুখী খাতগুলোকেও সহায়তা দেওয়া হয়েছে।
করপোরেট কর কমানোসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের ছাড় দেওয়া হলেও লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আদায়ে তার প্রভাব পড়বে না বলে মনে করেন অর্থমন্ত্রী।
'কর ব্যবস্থাপনা আইনগুলো আমরা সহজ করবো। এছাড়া, কাদের কর দেওয়া উচিত, তা সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে পারলে রাজস্ব আদায় বাড়বে।
যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ চেষ্টা করেছে কর হার বাড়িয়ে বেশি রাজস্ব আদায় করার। বাংলাদেশেও এমন চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু আমরা মনে করি, কর হার কমালে আদায় বাড়বে। সবার জন্য লাভের পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে'।
বিনিয়োগ ও ব্যবসা সম্প্রসারণে এতোদিন 'ফিসক্যাল মেজার্স' সক্রিয়ভাবে প্রয়োগ করা হয়নি বলে দুঃখ প্রকাশ করে কামাল বলেন, 'এতোদিন শুধু আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে। এবার বড় ধরণের রাজস্ব পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছে'।
বাংলাদেশের ঋণ-জিডিপি অনুপাত ৪০ শতাংশের অনেক কম জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, ভারত ও চীনের এ হার ১০০ শতাংশের মতো। তাই প্রস্তাবিত বাজেটে ৬.২% ঘাটতি বহন করার সক্ষমতা বাংলাদেশের রয়েছে।
'আমাদের ব্যয় বাড়াতেই হবে। সরকার ব্যয় না করলে বেসরকারি বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান হবে না। সেজন্যই ঘাটতি বাড়াতে হবে। তবে এতে কোন ঝূঁকি নেই। তাছাড়া, জুলাই-মে সময়ে রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি ১৩%, রাজস্ব প্রবৃদ্ধি ১১% এবং রেমিট্যান্সেও উচ্চ প্রবৃদ্ধি। তাই ঋণের লক্ষ্যমাত্রায় কোনো সমস্যা দেখছি না।'- জানান মন্ত্রী।
করোনার অভিঘাতে কি পরিমাণ মানুষ নতুন করে দারিদ্র সীমার নিচে নেমে গেছে, তা নির্ধারণে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) কাজ করছে। তাদের হিসাব এখনও পাওয়া যায়নি। তবে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (বিআইডিএস) প্রাথমিক একটি হিসাব করে জানিয়েছে যে, ২৬% মানুষ দারিদ্র সীমার নিচে অবস্থান করছে।
'বিবিএসের তথ্য পাওয়ার পর বিআইডিএসের তথ্যের সঙ্গে মিলিয়ে দেখে তাদের জন্য করণীয় নির্ধারণ করবো আমরা। তাদের অর্থনীতির মূল ধারায় ফিরিয়ে আনতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হবে'- জানান অর্থমন্ত্রী
'অপ্রদর্শিত অর্থ যতোদিন থাকবে, ততোদিন তা বৈধ করার সুযোগ অব্যাহত থাকবে'- সপ্তাহখানেক আগে এমন বক্তব্য দেওয়ার পর প্রস্তাবিত বাজেটে এ সম্পর্কে কোন তথ্য উল্লেখ না করার কারণ জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী বলেন, কতোজন অপ্রদর্শিত অর্থ সাদা করেছেন, সে তথ্য তখন ছিল না।
'চলতি অর্থবছরের মতো বিশেষ সুবিধায় এ সুযোগ অব্যাহত রাখলে যদি লাভ হয়, তাহলে এ সুযোগ আবার দেওয়া হবে। তবে এ বিষয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া আছে। কেউ কেউ এর পক্ষে থাকলেও ইক্যুইটেবল জাস্টিস প্রশ্নে অনেকে এর বিরোধিতা করছেন। আমরা আরও কিছুদিন বিষয়টি পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেব। এ বিষয়ে আরও কাজ বাকি আছে।'
পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য অধ্যাপক ড. শামসুল আলম বলেন, 'বিনিয়োগ উৎসাহিত করতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কর কমিয়ে সরকার ঝুঁকি নিয়েছে। বেসরকারি খাতকে ব্যবসার সুযোগ দিয়েছে, তাদের ব্যবসা হোক। কাক্ষিত বিনিয়োগ ও উৎপাদন বাড়লে আগামী তিন বছরের মধ্যে বাড়তি রাজস্ব পাওয়া যাবে। তাই প্রস্তাবিত বাজেটে বিনিয়োগ ও জিডিপির প্রাক্কলন ৩২% মোটেই বেশি নয়।'
অর্থসচিব আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, 'প্রস্তাবিত বাজেটে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে অধিক বরাদ্দ রাখা হয়েছে, যাতে এসব উন্নয়ন কর্মকান্ডে বাড়তি কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়'।
তিনি বলেন, 'করোনার প্রভাবে যারা কর্মহীন হয়েছেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসলে তাদের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে পাঁচ মাস সময়ও লাগবে না'।
অর্থনীতিতে কোভিডের প্রভাব মোকাবেলায় প্রণোদনা প্যাকেজগুলো বাস্তবায়ন অব্যাহত থাকবে জানিয়ে রউফ বলেন, 'প্রয়োজনে আরও প্রণোদনা দেওয়া হবে বলে প্রধানমন্ত্রী আমাদের জানিয়েছেন'।
ঘাটতি অর্থায়নে ব্যাংক ঋণ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. ফজলে কবির জানান আগামী অর্থবছর ব্যাংক থেকে ৭৬ হাজার টাকা নেওয়ার পরিকল্পনা করেছে। তবে ব্যাংকখাতে এখন দুই লাখ কোটি টাকা অতিরিক্ত তারল্য রয়েছে, যার মধ্যে ৪০ হাজার কোটি টাকা নগদ ও বাকিটা ট্রেজারি বিল ও বন্ডে বিনিয়োগ অবস্থায় রয়েছে।
স্বাস্থ্যের কেনাকাটায় দুর্নীতি বন্ধে ক্র্যাশ প্রোগ্রাম
স্বাস্থ্যখাতের বাজেট বাস্তবায়নে ব্যর্থতা ও কেনাকাটায় অনিয়ম বন্ধে আগামী অর্থবছরের শুরুতেই ক্র্যাশ প্রোগ্রাম নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন অর্থসচিব আব্দুর রউফ তালুকদার।
'স্বাস্থ্যখাতের কেনাকাটা হয় মূলত যোগানের দিক বিবেচনায়। এটাকে আমরা চাহিদার দিকে আনার চেষ্টা করবো। আগামী অর্থবছরের শুরুতে দেশের সকল হাসপাতালে মূল্যায়ন করে যন্ত্রপাতির ঘাটতি চিহ্নিত করে, সে অনুযায়ী কেনাকাটা করা হবে।'
তিনি বলেন, স্বাস্থ্যখাতের প্রকল্প ব্যবস্থাপনা ও কেনাকাটায় দক্ষতার ঘাটতি রয়েছে। আগামী অর্থবছর এটি দূর করতে ক্র্যাশ প্রোগ্রাম চালানো হবে। তাতে এখাত নিয়ে যে ধরণের অভিযোগ উঠে, তা কমবে।
প্রস্তাবিত বাজেটের আকার ৬ শতাংশের মতো বাড়লেও স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ এর দ্বিগুণ হারে বেড়েছে জানিয়ে অর্থসচিব বলেন, আগামী এক বছরে আমাদের যে পরিমাণ ভ্যাকসিন দেওয়ার সামর্থ্য আছে, তার চেয়েও বেশি অর্থ বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
নতুন বাজেটে ভ্যাকসিনের জন্য বরাদ্দ রয়েছে ১৪,২০০ কোটি টাকা। প্রয়োজনে ভ্যাকসিনের জন্য আরও অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হবে। এতে অর্থের কোন সংকট হবে না।
বাজেট বক্তব্যে প্রতিমাসে ২৫ লাখ ভ্যাকসিনেশনের কথা উল্লেখ করেছেন অর্থমন্ত্রী। এতে প্রায় চার বছর লেগে যাতে পারে- সাংবাদিকদের এমন তথ্যে আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, সরকার যতো দ্রুত সম্ভব সবাইকে ভ্যাকসিন দিতে আগ্রহী। এজন্য প্রয়োজনে ভ্যাকসিনের মাত্রা বাড়ানো হবে।
ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে পরিকল্পনামন্ত্রী আবদুল মান্নান, কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক, প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মসিউর রহমান, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম উপস্থিত ছিলেন।