ফলের পাইকারি ও খুচরা দামের মধ্যে বিশাল ফারাক
দেশের সবচেয়ে বড় পাইকারি ফলের বাজার পুরান ঢাকার বাদামতলী, ওয়াইজঘাট ও সদরঘাটে দেশি এবং আমদানি করা ফল স্বাভাবিক সময়ের দামে বিক্রি করলেও খুচরা বাজারে বিক্রেতারা তাদের নিজেদের ইচ্ছেমতো দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। খুচরা ক্রেতাদের দাবি রমজান মাসে অতিরিক্ত মুনাফার লোভে ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে ফলের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে।
সদরঘাট ও বাদামতলীর ব্যবসায়ী ও আড়তদারদের দাবি, বাজারে দেশি ফলের বাজার বেশি না থাকলেও আমদানি করা ফলের কারণে বাজারে ফলের কোনো ঘাটতি নেই। এমনকি রমজানের শুরুরে চেয়ে এখন অধিকাংশ ফলেরই দাম কমেছে বলেও জানান তারা। তবে খুচরা বাজারে বিক্রেতারা প্রতিটি ফলেরই দাম বাড়িয়েছেন কেজিতে ১০ থেকে ১০০ টাকা।
পবিত্র রমজানে ক্রেতাদের ফলের চাহিদা স্বাভাবিক সময়ের থেকে বেশি থাকায় অন্যান্য বছর দাম কিছুটা বেড়ে যায় তবে এ বছর লকডাউনের কারণে মানুষ স্বাভাবিক সময়ের থেকে ফল কম কিনছে বলে পাইকারি বাজারে ফলের বিক্রি ২০ শতাংশ কমেছে, বলছেন ফল ব্যবসায়ী সমিতি।
ফল ব্যবসায়ী সমিতি ও বাদামতলীর ব্যবসায়ীদের দেয়া তথ্য মতে, বাদামতলী ওয়াইজঘাটে প্রতিদিন প্রায় ১৮০ থেকে ২০০টি ট্রাক ও পিকআপ ভর্তি শুধু আমদানি করা ফল আসে। প্রতি ট্রাক ফল ১৫ থেকে ২০ লক্ষ টাকা বিক্রি হয়। ওয়াইজঘাটে প্রতিদিন আমদানি করা ফলই বিক্রি হয় ৩ কোটি টাকার উপরে।
এছাড়া দেশি ফলের আড়ৎগুলোতে প্রায় ৫ কোটি টাকার ফল বিক্রি হয় বলেও জানান ব্যবসায়ীরা।
রাজধানীর বাদামতলী, ওয়াইজঘাট ও সদরঘাটের ফলের আড়ত ও পাইকারি দোকান ঘুরে দেখা যায়, সদরঘাট থেকে বাবুবাজার ব্রিজ পর্যন্ত রাস্তার পাশে সারি সারি ফলের আড়ৎ। রাস্তার একপাশে কোথাও ট্রাক কিংবা পিকআপ থেকে ফলের কার্টন নামানো হচ্ছে আবার কোথাও ট্রাক থেকেই ফল বিক্রি করা হচ্ছে ডাকে তুলে।
দেশি ফলের মধ্যে তরমুজ, পেয়ারা, পেঁপে, আনারস, আতা, কলাসহ নানা রকম মৌসুমী ফল বিক্রি হচ্ছে। বাজারে আম, লিচু, কাঁঠাল, আমরুল, জামরুল এখনও বেশি না আসায় দেশি ফলের বাজারে ক্রেতাদের ভিড় তরমুজ, বাঙ্গি, আনারস, বেল, কলা এগুলোর দিকেই।
আমদানি করা বিদেশি ফলের মধ্যে আপেল, কমলা, আঙুর, মালটা, নাশপাতি, আনার, খেজুরসহ বিভিন্ন ধরনের ফল রয়েছে।
তবে বাজারে দেশি আম না আসলেও গত কয়েকদিনে থাইল্যান্ড ও ভারত থেকে আমদানি করা আম পাইকারিসহ খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে। তবে এ আমের প্রতি কেজির দাম ১০০ থেকে ৬০০ টাকা পর্যন্ত।
মাল্টা পাইকারি বাজারে প্রতি কেজি সর্বোচ্চ ১২০ টাকা দরে বিক্রি হলেও খুচরা বাজারে তা বিক্রি হচ্ছে ১৬০ থেকে ১৭০ টাকায়।
এছাড়া পাইকারি বাজারে আপেল ১৩০, সবুজ আপেল ১৫০ টাকা, চায়না আপেল ১৪৫ টাকা, আঙ্গুর ১৮০ টাকা, লাল আঙ্গুর ৪০০ টাকা, নাশপাতি ১৮০ টাকা, বড় দানার আনার ৩০০ টাকা কেজি, ছোট দানার আনার ১৬০ টাকায় ক্রয় করলেও খুচরা বিক্রেতারা প্রত্যেকটি ফলের কেজিতে ৫০ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত বেশি দামে বিক্রি করছেন।
খুচরা বাজারে প্রতি কেজি আপেল ১৮০ টাকা, সবুজ আপেল ২০০ টাকা, সবুজ আঙ্গুর ২৬০ টাকা, ছোট দানার আনার ২৫০ টাকা, নাশপাতি ২৬০ টাকা দরে বিক্রি করছেন।
পুরান ঢাকার বাদামতলীর ওয়াইজঘাটের পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, রমজানের শুরু থেকে বর্তমানে ফলের দাম কম থাকলেও খুচরা বাজারে রমজান ও গরমের অযুহাত দিয়ে বেশি দামে বিক্রি করছেন বিক্রেতারা।
আমদানি করা ফলের মধ্যে বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে খেজুর। পাইকারি বাজারের দামের থেকে দ্বিগুণেরও বেশি দামে খুচরা বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে এটি ক্রেতাদের কাছে।
ওয়াইজঘাটের পাইকারি ফল বিক্রেতা মেহেদী হাসান টিবিএসকে বলেন, রমজানের মধ্যে লকডাউন থাকায় আমদানি করা ফলের দাম কিছুটা কমেছে। তবে বিক্রি মোটামুটি স্বাভাবিক রয়েছে। আমাদের থেকে কম দামে কিনলে খুচরা বাজারে কম দামে বিক্রি করার কথা।
আরেক পাইকারি বিক্রেতা মো. শাহজাহান হোসেন টিবিএসকে বলেন, 'বাজারে থাইল্যান্ডের আম এসেছে। এগুলোর দাম কেজিপ্রতি ৫০০ টাকার উপরে। এছাড়া অন্যসব ফলের দাম স্বাভাবিক রয়েছে। এর মধ্যে আপেল, আঙ্গুর, আনার, মাল্টার দাম কম একটু'।
দোকানে খেজুর বিক্রি করার জন্য পাইকারি বাজারে খেজুর কিনতে আসা জহির উদ্দিন টিবিএসকে বলেন, 'ছড়া খেজুর খুচরা আমরা ৪০০ করে বিক্রি করি, মরিয়ম খেজুর ৫০০ করে। এছাড়া বস্তার খেজুর ১০০ থেকে ১৫০ টাকা কেজি বিক্রি করি'।
পাইকারি বাজার থেকে এই খেজুরগুলোই অর্ধেক দামে কিনে কিভাবে বেশি দামে বিক্রি করছেন এমন প্রশ্নের জবাবে জহির উদ্দিন বলেন, 'সবাই যে দামে বিক্রি করছে আমাকেও তো সেই দামে বিক্রি করতে হবে। এছাড়া দোকান ভাড়া, নিয়ে যাওয়ার খরচ তো কম না'।
দেশি ফলের মধ্যে পাইকারি বাজারে প্রতিটি আনারস ১৫ থেকে ৪০ টাকায় বিক্রি হলেও খুচরা বাজারে ৩০ থেকে ১০০ টাকায় কিনতে হচ্ছে সেগুলো। পেয়ারা প্রতিকেজি ৩০ টাকায় কিনে ৭০ থেকে ১০০ টাকায় বিক্রি করছেন খুচরা বাজারে।
সেগুনবাগিচার ফল বিক্রেতা পারভেজ হোসেন টিবিএসকে বলেন, 'ফলের দাম পাইকারি বাজারে কমলেও নিয়ে আসতে খরচ বেড়ে গিয়েছে। এছাড়া লকডাউনের কারনে বিক্রি কম তাই একটু বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। বিক্রি কম হওয়ায় অনেক ফল পচে যায় সেক্ষেত্রে আর লাভ থাকে কই'!
কারওয়ান বাজারের খুচরা বিক্রেতা সেলিম খান টিবিএসকে বলেন, 'বাজারে দেশি ফলের দাম বেশি তাই ক্রেতারা কিনছেও কম। আমদানি করা ফল আগের দামেই বিক্রি হচ্ছে'।
বাজারে দেশি ফলের মধ্যে কলার দাম বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। পাইকারি বাজারে সাগর কলা ১৫ টাকা , চাপা কলা ১৫ টাকা, সবরি কলা ২৫ থেকে ৩০ টাকা, সাগর কলা ১৫ থেকে ২০ টাকা হালি বিক্রি হচ্ছে। খুচরা বাজারে এ কলার দাম দ্বিগুনেরও বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে।
খুচরা বাজারে সবরি কলা প্রতি হালি বিক্রি হচ্ছে ৪০ থেকে ৬০ টাকা দরে, চাম্পা কলা ২৫ টাকা, সাগর কলা ২৫ থেকে ৪০ টাকায়।
খুচরা বাজারের ফল বিক্রেতা বজলুর রহমান টিবিএসকে বলেন, 'সারা দিন দোকানদারি করে, দোকানের খরচ চালিয়ে যা বিক্রি হয় এর পরে তেমন কিছুই থাকে না। অল্প এনে বিক্রিও অল্প করি। সারাদিন বিক্রি করে ৫০০ টাকাও থাকে না'।
দেশি ফলের মধ্যে ক্রেতাদের কাছে অতিরিক্ত দামে বিক্রি করা হচ্ছে তরমুজ। পাইকারি বাজারে প্রতি পিস (মাঝারি আকার) তরমুজ সর্বোচ্চ ২০০ টাকায় বিক্রি করলেও খুচরা বাজারে এ তরমুজ কোথাও কোথাও ৩০০ থেকে ৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
খুচরা বিক্রেতাদের দাবি, তরমুজ পাইকারি বাজার থেকেই বেশি দামে কিনতে হচ্ছে তাদের। এছাড়া তরমুজের সাইজ ছোট হওয়া, নষ্ট হয়ে যাওয়া, ভিতরে সাদা থাকায় অনেক তরমুজ নষ্ট হওয়ার কারণে একটু বাড়তি দাম নেওয়া হচ্ছে বলে জানান ব্যবসায়ীরা।
পিস হিসেবে কিনে কেজি হিসেবে বিক্রি করার কারণে গত দুই সপ্তাহ ধরে বিভিন্ন বাজারে ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তর অভিযান চালিয়ে তরমুজের দাম নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করলেও আদৌ কোনো সমাধান হয়নি বলে অভিযোগ ক্রেতাদের।
আনিসুর রহমান নামে এক ক্রেতা টিবিএসকে বলেন, 'আগে কেজি রাখতো ৬০ টাকা করে এখন ১০ কেজির তরমুজের দাম চায় ৭০০ টাকা। ৬০০ টাকার নিচে বিক্রি করে না কেউই। এতে তো আরও দাম বেড়ে গেল'।
ব্যবসায়ীরা আগেই মেপে দাম নির্ধারণ করে রাখেন বলেও অভিযোগ করেন এ ক্রেতা।
ঢাকা মহানগর ফল আমদানি ও রপ্তানিকারক এবং আড়তদার ও ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি লিমিটেডের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম টিবিএসকে বলেন, 'লকডাউনের মধ্যে ফলের আমদানি স্বাভাবিক রয়েছে। স্বাভাবিক সময়ের থেকে বিক্রি প্রায় ২০ শতাংশ কমেছে লকডাউনের মধ্যে'।
ফলের দাম আগের থেকে কমেছে উল্লেখ করে আব্দুল করিম বলেন, 'বর্তমানে বাজারে আমদানি করা ফল বেশি থাকায় দাম বাড়েনি। রমজানে ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী বাজারে ফল রয়েছে। আড়ৎগুলোতে দামের তেমন তারতম্য নেই, খুচরা বাজারে গেলে বিক্রেতারা দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে এমনটা অভিযোগ আসে আমাদের কাছে। তবে এ বাড়তি দামের জন্য পাইকারি বিক্রেতারা দায়ী নন'।
বিদেশি ফলের বাজার সম্পর্কে আব্দুল করিম বলেন, 'প্রতিদিন ১৫০ ট্রাকেরও বেশি গাড়িতে আমদানি করা ফল বিক্রি হয়। লকডাউনের আগে এ সংখ্যা আরও বেশি ছিল। বিদেশি ফলের মধ্যে খেজুর, আপেল, মালটা, আনার এসবের চাহিদা রয়েছে। তবে খেজুরের বিক্রি এখন কম'।