ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্প: ৫ মাসে অগ্রগতি ২০ শতাংশ, পদ্মা সেতুর মেয়াদ বাড়ছে এক বছর
পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্প ও মাতারবাড়ি ১২০০ মেগাওয়াট আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র ছাড়া সরকারের ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন অগগতি এখনো সন্তোষজনক নয়।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের নভেম্বর পর্যন্ত প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) এসব প্রকল্পে বরাদ্দ অর্থের মাত্র ১৯.৭৫ শতাংশ অর্থ ব্যয় হয়েছে।
সবচেয়ে বেশি, বরাদ্দের ৬০ ভাগ অর্থ ব্যয় হয়েছে পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পে। আর মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে বরাদ্দের ৪২ শতাংশ অর্থ।
পদ্মা সেতু প্রকল্প, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট (এমআরটি), রামপালে মৈত্রী সুপার থার্মাল পাওয়ার প্লান্ট প্রকল্পে আলোচ্য সময়ে ব্যয় হয়েছে বরাদ্দের ২০ শতাংশেরও কম অর্থ।
প্রকল্প সংশ্লিস্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কোভিডের কারণে বিদেশি কর্মী, বিশেষজ্ঞ ও পরার্শকরা এখনো সেভাবে ফিরে না আসায় অনেক প্রকল্পের অগ্রগতি কম।
পদ্মা সেতুতে সবগুলো স্প্যান বসানো শেষ হলেও আনুষঙ্গিক অনেক কাজ কোভিডের কারণে পিছিয়ে আছে। এ কারণে আগামী বছর স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে যানবাহন চলাচলের জন্য সেতুটি খুলে দেয়ার পরিকল্পনা থেকে সরকার সরে এসেছে। তবে এ সময়ের মধ্যে দেশের প্রথম মেট্রো রেল (এমআরটি-৬) চালু করতে চায় সরকার।
পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সচিব প্রদীব রঞ্জণ চক্রবর্তী জানান, ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন কাজ কাঙ্খিত গতিতেই বাস্তবায়ন হচ্ছে। আর্থিক অগ্রগতি কম দেখা গেলেও ভৌত অগ্রগতি এ সময়ে বেড়েছে।
তিনি জানান, অনেক ঠিকাদারের বিল জমা পড়ে আছে। যাচাই-বাছাই করে বিল দিতে হয় বলে ঠিকাদারের বিল পরিশোধে সময় লাগে। এ কারণে আর্থিক অগ্রগতিও কম।
তবে ইআরডির প্রতিবেদন অনুযায়ী শুধু আর্থিক অগ্রগতিই নয়, ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্পগুলোর ভৌত অগ্রগতিও অনেক পিছিয়ে আছে।
মেট্রোরেল প্রকল্পে (এমআরটি-৬) অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে বরাদ্দের মাত্র ৬ শতাংশ ব্যয় হয়েছিল। কিন্তু ওই সময়ে ভৌত অগ্রগতি দেখানো হয়েছিল ৫৩.৩৭ শতাংশ। বছরের পাঁচ মাস পর হিসাব করে দেখা গেছে ভৌত অগ্রগতি আরো কম, ৫২.২৪ শতাংশ। যদিও এ সময়ে বরাদ্দের প্রায় ১২ ভাগ অর্থ ব্যয় হয়।
এক বছর বাড়ছে পদ্মা সেতু প্রকল্পের মেয়াদ
সর্বশেষ স্প্যানটি কিছুদিন আগে বসানোর পর পদ্মা সেতুর শতভাগ দৃশ্যমান হলেও সেতু বিভাগ বলছে, স্লিপার বসিয়ে সেতুটিকে যান চলাচলের জন্য খুলে দিতে আরো এক বছরের বেশি সময় লাগতে পারে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্য অনুযায়ী, এই প্রকল্পে চলতি অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ৫ হাজার কোটি টকা। নভেম্বর পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে মাত্র ১১ ভাগ বা ৫৫২ কোটি টাকা। নভেম্বর পর্যন্ত মূল সেতুর অগ্রগতি ৯১ ভাগ। আর নদী শাসনের কাজ হয়েছে ৭৬ ভাগ।
পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরিচালক শকিফুল ইসলাম জানান, বর্ষার কারণে সাধারণত অর্থ ব্যয় কম হয়ে থাকে। বিশেষভাবে নদী শাসনের কাজ করা তখন সম্ভব হয় না। তবে অর্থ বছরের বাকি সময়ে প্রকল্পে ব্যয় বাড়বে।
এদিকে, আগামী বছরে জুনে কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তুতি শুরু করেছে সেতু বিভাগ। মেয়াদ ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হবে বলে জানিয়েছেন সেতু বিভাগের কর্মকর্তারা।
কাজের গতি ধীর, তবে নির্ধারিত সময়েই মেট্রোরেল চালুর চিন্তা
স্বাধীনতার সূবর্ণ জয়ন্তীতে উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রো রেলের অংশ (এমআরটি-৬) চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করার ঘোষণা থাকলেও প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাজ চলছে খুবই ধীর গতিতে। ফলে ঘোষিত সময়ে কাজ শেষ হওয়া নিয়ে সংশয় রয়েছে। তবে সরকার ঘোষিত সময়েই তা চালু করতে চায়।
এই প্রকল্পে চলতি অর্থ বছরের প্রথম পাঁচ মাসে বরাদ্দ ছিল ৫৫৪৩ কোটি টাকা। ব্যয় হয়েছে মাত্র ৬৪২ কোটি টাকা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা মাস র্যাপিড ট্রানজিট কোম্পানী লিমিটেডের উর্ধতন এক কর্মকর্তা জানান, কোভিডের কারণে জাপানের সব পরামর্শক এখনো বাংলাদেশে ফেরেননি। এ কারণে কাজের গতি কম। স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সব ধরণের নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেয়া হলেও জাপানের অনেক বিশেষজ্ঞ এখনো ফেরেননি।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি ৩২ ভাগ
চলতি অর্থবছরে রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পে বরাদ্দ ছিল ১৫৬৯১ কোটি টাকা। এর মধ্যে পাঁচ মাসে ব্যয় হয়েছে বরাদ্দের মাত্র ১১ ভাগ বা ১৬৫৯ কোটি টাকা। দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ব্যয়বহুল এই প্রকল্পের কাজ ২০২৫ সালে শেষ করার লক্ষ্য থাকলেও এখন পর্যন্ত প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি ৩২ ভাগ।
প্রকল্প পরিচালক শৌকত আকবর বলেন, রূপপুর প্রকল্পের কাজের গতি কমেনি। অগ্রগতি কম দেখানো হচ্ছে, কারণ বৈদেশিক ঋণ ব্যবহারের হিসাব এখনো করা হয়নি।
মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ প্রকল্পের অগ্রগতি সবচেয়ে ভালো
অর্থবছরের প্রথম ৫ মাসে ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্পগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালো অগ্রগতি মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ প্রকল্পের। 2*600 মেগাওয়াট আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল কোল পাওয়ার প্রকল্পে প্রথম তিন মাসে যেখানে বরাদ্দের ৩০ শতাংশ অর্থ ব্যয় হয়েছিল, পাঁচ মাসে তা বেড়ে ৪২ শতাংশ হয়েছে।
তবে ২০১৪ সালে শুরু হওয়া প্রকল্পটি সার্বিক কাজের অগ্রগতি লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেকে পিছিয়ে আছে। নভেম্বর পযন্ত ভৌত কাজের অগ্রগতি মাত্র ৪০ ভাগ
অন্যান্য প্রকল্প
রামপালে ২০৬৬ মেগাওয়াট মৈত্রী সুপার থার্মাল পাওয়ার প্রকল্পে মোট বরাদ্দের মাত্র ১৯ শতাংশ অর্থ প্রথম ৫ মাসে ব্যয় হয়েছে। ২০০৯ সালে শুরু হওয়া প্রকল্পটির ভৌত কাজের অগ্রগতি এখনো ৪৫ ভাগ বাকি। প্রকল্পটি বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড এবং ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার কোম্পানি, ইন্ডিয়া যৌথ উদ্যোগে বাংলাদেশ ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশীপ পাওয়ার কোম্পানী বাস্তবায়ন করছে।
দশ বছরেও ভূমি অধিগ্রহণ নিয়ে জটিলতা কাটেনি চট্টগ্রামের দোহাজারি থেকে কক্সবাজার হয়ে গুনদুম পযন্ত রেল লাইন নির্মাণ প্রকল্পের। এ কারণে প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে খুবই ধীর গতিতে। চলতি অর্থবছরের এ প্রকল্পে ১৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ থাকলেও নভেম্বর পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে মাত্র ২২২ কোটি টাকা।
প্রকল্প পরিচালক জানান, ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতা দূর না হলে প্রকল্পে অগ্রগতি হবে না। নানা উদ্যোগ নিয়েও এ সমস্যার সমাধান হচ্ছে না।
পায়রা গভীর সমুদ্র বন্দরের প্রয়োজনীয় অবকঠামো উন্নয়ন প্রকল্পে বছরে মোট ৩০০ কোটি টাকা বরাদ্দের বিপরীতে ব্যয় হয়েছে মাত্র ৭৫ কোটি টাকা। পায়রা বন্দরে প্রথম টার্মিনাল নির্মাণে নেয়া পৃথক প্রকল্পে চলতি অর্থবছরে অগ্রগতি প্রায় ৩৯ ভাগ।