পদ্মাসেতু প্রকল্পে ‘নিজস্ব অর্থায়ন’ যেভাবে মুদ্রাবাজার সংকট ও মূল্যস্ফীতির সূচনা করে
হাইলাইট:
- রিজার্ভ ও স্থানীয় ব্যাংকগুলো থেকে বড় অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা নেওয়া হয়
- এ অর্থ মূলত যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানি এবং বিদেশি কর্মীদের বেতন পরিশোধে ব্যয় হয়
- স্থানীয় মুদ্রায় ৭-৮ শতাংশ সুদহারে ট্রেজারি বিল ও বন্ডের মাধ্যমে ঋণ নিতে হয়েছিল
- উচ্চ সুদহারে ঋণ নেয়ার খরচ জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির রূপে জনগণের ওপর করের বোঝা বাড়িয়েছে
- এতে জ্বালানির দাম বারবার বাড়াতে হয়, ফলে আরও বেড়ে যায় মূল্যস্ফীতি
- ডলার বিক্রির কারণে ২০২৪ সালের অক্টোবর পর্যন্ত রিজার্ভ নেমে দাঁড়িয়েছে ১৯.৮ বিলিয়ন ডলারে
পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য প্রায় ১.৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় করেছিল সরকার, যা দেশের অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে নেওয়া প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার সমতুল্য। এ পরিমাণ ব্যয় বৈদেশিক মুদ্রা এবং স্থানীয় মুদ্রা উভয় বাজারেই সংকট তৈরি করেছিল, যার ধারাবাহিক প্রভাবে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে।
রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন অগ্রণী ব্যাংক স্থানীয় বাজার থেকে বৈদেশিক মুদ্রার সম্পূর্ণ অংশের ব্যবস্থা করেছিল। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এটি বিগত দুবছর ধরে দেশে চলমান মুদ্রাবাজার সংকটের একটি প্রধান কারণ।
মূলত প্রকল্পের মূলধনী যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানি এবং বিদেশি কর্মীদের বেতন পরিশোধের জন্য ডলারের অংশ থেকে ব্যয় করা হয়েছিল। ব্যাংকটির তথ্যমতে, মোট ১.৯ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে এখনো ২০০ মিলিয়ন ডলারের একটি পেমেন্ট বাকি রয়েছে।
২০১২ সালে দুর্নীতির কথা উল্লেখ করে পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য বিশ্বব্যাংক তার ১.২ বিলিয়ন ডলার অর্থায়ন প্যাকেজ বাতিল করে। এর ফলে সরকারকে নিজস্ব সংস্থান থেকে এ বিশাল বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়োজনীয়তা মেটাতে হয়েছিল।
বিশ্বব্যাংকের স্বল্পমূল্যের ঋণ বাতিলের পরপরই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা করেছিলেন, বাংলাদেশ নিজস্ব অর্থ ব্যয় করে ৬.১৫ কিলোমিটারের অত্যন্ত ব্যয়বহুল এ দীর্ঘ সড়ক-রেল সেতু প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে।
বিশ্বব্যাংকের ঋণের সর্বোচ্চ ১ শতাংশ খরচের তুলনায় সরকারকে স্থানীয় মুদ্রায় ৭ শতাংশ থেকে ৮ শতাংশ সুদের হারে ট্রেজারি বিল ও বন্ডের মাধ্যমে ঋণ সংগ্রহ করতে হয়েছিল।
এছাড়াও, স্থানীয় বিভিন্ন ব্যাংক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ করা হয়, যার ফলে অন্যান্য খাতে বিনিয়োগ কমিয়ে আনতে হয়েছিল।
উচ্চ সুদহারে ঋণ গ্রহণের এ খরচ জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির রূপে সাধারণ জনগণের ওপর করের বোঝা বাড়িয়েছে। এটি শেষ পর্যন্ত মূল্যস্ফীতি বাড়িয়ে তুলেছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
স্ব-অর্থায়নে পদ্মা সেতুর দাম চুকিয়েছে দেশ
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, পদ্মা সেতুর স্ব-অর্থায়ন ছিল একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, যা বিশাল অর্থনৈতিক ব্যয়ের কারণ হয়েছে। অন্য খাতের বিনিয়োগে আপোস করে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে অর্থায়ন করা হয়েছে।
তিনি আরও উল্লেখ করেন, দুর্বল শাসনের কারণে প্রকল্পের ব্যয় বেড়েছে, যা নির্মাণ ব্যয়কে উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়েছে। মেগা প্রকল্পে বহুজাতিক দাতা সংস্থার অংশগ্রহণ থাকলে সাধারণত প্রকল্প বাস্তবায়নে সুশাসন এবং 'চেক ও ব্যালেন্স' ঠিক থাকে, যা পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রে হয়নি।
বেশি সুদ দিয়ে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ নেওয়ার খরচ আর্থিক চাপ বাড়িয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটি শেষ পর্যন্ত সাধারণ জনগণের ওপর পড়েছে। যেমন, উচ্চ নির্মাণ ব্যয়ের কারণে পদ্মা সেতুর টোল ফি বেশি নির্ধারণ করা হয়েছে।
তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, যে কোনো উন্নয়নশীল দেশ সাধারণত কম খরচে অর্থায়ন এবং অর্থ পরিশোধের ক্ষেত্রে নমনীয় শর্তের জন্য মেগা অবকাঠামো প্রকল্পের ক্ষেত্রে বহুপাক্ষিক দাতা সংস্থার কাছ থেকে অর্থায়ন চায়।
'পদ্মা সেতুর কাজ শেষ হয়েছে, যা নিঃসন্দেহে একটি ইতিবাচক অর্জন। কিন্তু এ সাফল্য কিসের দামে?' প্রশ্ন তোলেন তিনি।
দেশের কর-জিডিপি অনুপাত তুলনামূলকভাবে কম থাকায় সরকারকে উচ্চ ব্যয়ে তহবিল সংগ্রহ করতে হয়েছে, যা সাধারণ জনগণের ওপর বেশি করের বোঝা চাপিয়ে মূল্যস্ফীতিকে বাড়িয়ে তুলেছে বলে পর্যবেক্ষণ জানান ফাহমিদা খাতুন।
প্রাথমিকভাবে, এ প্রকল্পের আনুমানিক ব্যয় ছিল ১০ হাজার ১৬১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। সমাপ্তির তারিখ ধরা হয়েছিল ২০১৫ সালের ৩০ জুন। কিন্তু ২০২২ সালে ২৫ জুন সেতুটি যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করার সময়ে এসে মোট ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৩১ হাজার ১০৫ কোটি টাকায়।
অভ্যন্তরীণ অর্থায়ন যেভাবে সংকট তৈরি করেছে
অগ্রণী ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এটি ২০১৩ সালে পদ্মা সেতুর জন্য প্রথমে ৬.২৬ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করতে শুরু করে। তখন ডলারের মূল্য ছিল ৭৭.৫০ টাকা।
প্রকল্পের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় শুরু করার সময় দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ১৭–১৮ বিলিয়ন ডলার।
তবে ২০২১ সাল পর্যন্ত দেশ বড় কোনো সংকট অনুভব করেনি। ওই বছর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রেকর্ড ৪৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছায়। এর বড় কারণ ছিল কোভিড-১৯ মহামারির সময় বিদেশি দায় পরিশোধ বন্ধ থাকা এবং প্রচুর পরিমাণে রেমিট্যান্স আসা।
এদিকে, ২০২১ সালের মধ্যেই প্রকল্পে ১.৪ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়ে যায়। ততদিনে ডলারের দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৮.৮০ টাকায়।
মহামারির পর আমদানি এবং অন্যান্য বৈদেশিক বকেয়া পুনরায় পরিশোধ শুরু হলে ২০২২ সালের মাঝামাঝি থেকে বাস্তবতা কঠোর হয়ে ওঠে। মহামারির সময় জমে যাওয়া বিদেশি বকেয়ার চাপের কারণে ব্যাংকিং খাত মারাত্মক ডলার সংকটে পড়ে। ফলে টাকার দ্রুত অবমূল্যায়ন হয়।
এ অবমূল্যায়ন চাপ এবং বিনিময় হারের অস্থিরতা সামাল দিতে বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২১–২২ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি শুরু করে। ওই অর্থবছরে বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ৭.৩ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করে। তার আগের বছর এটি ৭.৭ বিলিয়ন ডলার কিনেছিল।
রিজার্ভে ক্ষয়, মূল্যস্ফীতির উত্থান
ওই সময় থেকেই দেশের রিজার্ভ ক্ষয়ের সূচনা হয়। কারণ বিদেশি দায় পরিশোধের জন্য ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ডলারের জন্য হাত পাততে শুরু করে।
এর ধারাবাহিক প্রভাব পড়ে অভ্যন্তরীণ তারল্য, বিনিয়োগ এবং মূল্যস্ফীতির ওপর।
যেমন, ডলার বিক্রির ফলে দেশীয় মুদ্রা তারল্য সংকটে পড়ে, কারণ ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে টাকার বিনিময়ে ডলার কিনছিল। ব্যাংকগুলো তারল্য সংকটে পড়ায় বন্ডের সুদহার বেড়ে যায়, যা সরকারের ঋণকে আরও খরুচে করে তোলে।
এদিকে সরকারের রাজস্ব আহরণ লক্ষ্যমাত্রাও পূরণ হচ্ছিল না। একইসময়ে সরকার অগ্রণী ব্যাংকের মাধ্যমে ডলার কিনছিল এবং বন্ড ও ট্রেজারি বিলের মাধ্যমে উচ্চ সুদে ঋণ নিচ্ছিল।
এ উচ্চ সুদ সরকারের ঋণ বোঝা আরও বাড়ায়, যার কারণে শেষ পর্যন্ত জ্বালানির দাম বারবার বাড়াতে হয়। এতে মূল্যস্ফীতি আরও ফুলে ওঠে এবং জনগণের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি হয়।
প্রবল ডলার সংকটের মধ্যেও অগ্রণী ব্যাংক ২০২২ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত পদ্মা সেতু প্রকল্পে প্রায় ৩০০ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছিল।
ডলারের মূল্য ৯০ টাকা থেকে ১১০ টাকায় ওঠার ফলে বাংলাদেশ ব্যাংককে ২০২১–২২ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে ২০২২–২৩ অর্থবছর পর্যন্ত ২০ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ বিক্রি করতে হয়েছে। ২০২৩–২৪ অর্থবছরে ডলারের মূল্য ১২০ টাকায় পৌঁছানোর মাধ্যমে টাকার অবমূল্যায়ন অব্যাহত থাকে।
বিশাল অঙ্কে ডলার বিক্রির কারণে ২০২৪ সালের ৮ অক্টোবর পর্যন্ত হিসাবে দেশের রিজার্ভ নেমে দাঁড়িয়েছে ১৯.৮ বিলিয়ন ডলারে।
অন্যদিকে, এ বিপুল ডলার বিক্রির ফলে বাংলাদেশ ব্যাংক গত দুই বছরে দেশীয় বাজার থেকে প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকা তুলে নিয়েছে, যার ফলে তীব্র তারল্য সংকট দেখা দিয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক এক লাখ কোটি টাকা ছাপিয়ে সরকারের কাছে অর্থ সরবরাহ করতে বাধ্য হয়েছে, যা মূল্যস্ফীতিকে আরও উসকে দিয়েছে।