বগুড়ার থ্রি স্টার মাদুর সারা দেশের বাজারে
বগুড়ার ছাতনি গ্রামে তৈরি প্লাস্টিক মাদুর মাত্র তিন বছরে দেশের সব জেলাতেই বাজার দখল করেছে। নারী উদ্যোক্তা নাহিদ সুলতানা তৃপ্তির ওই প্রতিষ্ঠানে তৈরি মাদুরের মান ও দামে খুশি সারা দেশের পাইকারি ক্রেতারা।
ফেনী জেলার মহিপাল বায়তুস সড়কে মসজিদ সংলগ্ন দোকানে প্রায় নয় বছর মাদুরের ব্যবসা করেন মো: ইমরান শেখ। অন্তত চার ধরনের মাদুর আছে তার দোকানে কিন্তু বেচা-কেনা বেশি হয় 'থ্রি স্টার ম্যাটস'। মো: ইমরান শেখের প্রতিষ্ঠান মেসার্স সোহেল স্টোর মাসে গড়ে বগুড়ার ওই কোম্পানি থেকে মাদুর কেনে ১০ হাজার পিস।
'থ্রি স্টার কোম্পানির মাদুরের মান ও রং সাধারণ ক্রেতাদের বেশ পছন্দ আর সে কারনেই বেচা-কেনাও হয় অন্য কোম্পানির পন্যের চেয়ে বেশি' বললেন মো: ইমরান শেখ।
উত্তরাঞ্চলীয় জেলা পঞ্চগড়ে অনেক বছর ধরেই মাদুরের ব্যবসা করেন শ্রীমান সুফল কুমার মন্ডল। তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান 'মেসার্স বড়দল পাটি ঘর' বগুড়া থেকে মাসে পাইকারি মাদুর কেনে ৮ হাজার পিস। রমজানকে কেন্দ্র করে ২/৩ মাস আগে তার দোকানে চাহিদা থাকে মাসে গড়ে ২৫ হাজার পিস।
'দামে এবং মানে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের চেয়ে ভাল হওয়ায় থ্রি স্টার কোম্পানির মাদুরের চাহিদা তুলনামূলকভাবে বেশি', বললেন শ্রীমান সুফল কুমার মন্ডল। তার আরও একটি মাদুরের দোকান আছে ভোলার লালমোহন উপজেলায়, সেখানেও বগুড়ায় তৈরি মাদুরের বেচা-কেনা ভাল বলে জানালেন সুফল কুমার মন্ডল।
মেহেরপুর জেলার গাংনি উপজেলায় সিন্দুর কৌটা বাজারে নানা ধরনের মাদুর বেচা-কেনা করেন মো: জিনারুল ইসলাম। বর্ষাকালসহ অন্যান্য সময়ে মাসে গড়ে ৫ লাখ টাকার প্লাসটিক ম্যাট বিক্রি হলেও রমজান মাসে গড়ে বেচা-কেনা হয় ১৫ লাখ টাকা। গত ১ বছরে ৫৫ লাখ টাকার মাদুর বিক্রি করেছেন মো: জিনারুল ইসলাম।
বগুড়ার আদমদিঘী উপজেলার ছাতনি গ্রামে ২০১৭ সালে মাদুরের ব্যবসা শুরু করেন নাহিদ সুলতানা তৃপ্তি। তার প্রতিষ্ঠানে তৈরি মাদুর তিন বছরেই দখল করেছে দেশের সবগুলো জেলার বাজার।
প্রতিবেশী দেশ ভারতের মুম্বাই থেকে আনা মেশিনে দিনে যে ৪ হাজার পিস মাদুর তৈরি হয় তার প্রায় সবটাই বিক্রি হয় দিনেই। তবে ফেব্রুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত কখনো কখনো এ মাদুরের চাহিদা দিনে গিয়ে পৌছে ১২ হাজার পিসে। নামাজ আদায়সহ নানা ধরনের প্রয়োজনে বিভিন্ন সাইজ ও মানের যে মাদুর ওই গ্রামে তৈরি হয় সেসব মাদুরের সর্বনিম্ন পাইকারী দর ৪৫ টাকা আর সবোর্চ্চ ৪২০ টাকা।
দেশের বাজারগুলোতে মাসে গড়ে চাহিদা ১ লাখ ২০ হাজার পিস মাদুর, এ তথ্য দিয়ে নাহিদ সুলতানা তৃপ্তি জানান, বিগত বছরগুলোতে বাৎসরিক লেন-দেন হয়েছে গড়ে প্রায় ২২ কোটি টাকা তবে করোনার কারণে এবার বেচা-কেনা কিছুটা কম। কিন্তু তারপরেও বছর শেষে লেন-দেন পৌছাবে ১৫ কোটি টাকায়।
বগুড়া, পাবনা, ময়মনসিংহ ও নারায়নগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার পুরুষ কর্মিদের পাশাপাশ দেশী নারী কর্মীদের সঙ্গে কাজ করছেন ভারতীয় নারী কর্মীরাও। প্রায় দেড়শ কর্মী এখন কাজ করছেন ছাতনি গ্রামে নাহিদ সুলতানা তৃপ্তির মাদুর কারখানায়।
থ্রি স্টার ম্যাটস কোম্পানির ফিনিসিং বিভাগে কাজ করেন মোছা: রাজিয়া সুলতানা বন্যা। মাসে তিনি পান ৬ হাজার টাকা। আগে কখনো কাজ করতে কখনো থাকতেন বেকার। মাসে তখন আয় হতো গড়ে ৩ হাজার টাকা। এ টাকায় বাবা-মা আর ২ কন্যাকে নিয়ে সংসার চালাতে তার কষ্ট হতো। এখন আমি মাসে পাই ৬ হাজার টাকা সংসারও চলছে আগের চেয়ে ভাল" বললেন মোছা: রাজিয়া সুলতানা বন্যা। বন্যার সঙ্গে ফিনিসিং বিভাগে কাজ করেন আরও ৩০ জন। তাদের সবারই সংসার চলছে ভালভাবে। তাদের সাথে কাজ করছেন প্রতিবেশি দেশ ভারত থেকে আসা কয়েকজন নারী কর্মী।
মো: সুজন আলী থ্রি স্টার ম্যাটস কোম্পানিতে ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করছে প্রতিষ্ঠানটির শুরু থেকেই। তিনি বলেন, 'আমাদের প্রতিষ্ঠানে কাজের পরিবেশ খুবই ভাল। এছাড়া প্রতি বছরই কিছু না কিছু বেতন বৃদ্ধি করে কর্তৃপক্ষ'।
থ্রি স্টার ম্যাটস কোম্পানিতে কাজ শুরু করার আগে মাসে ১০ হাজার টাকা বেতনে চালের আড়তে কাজ করেছেন মো: সুজন আলী। বেতন বেশি পাওয়ার পাশাপাশি পরিবেশ ভাল হওয়ায় তিনি ভাল আছেন এ কোম্পানিতে।
প্রায় ২০ বছর আগে মাত্র ১৫ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে নাহিদ সুলতানা তৃপ্তি শুরু করেন মুরগির ব্যবসা। এখন তার সম্পদ প্রায় ১৫ কোটি টাকার।
নাহিদ সুলতানা তৃপ্তি বলেন, 'ব্যবসায় ভাল করতে গেলে পরিশ্রম যেমন করতে হবে তেমনি সৎ থাকতে হবে কথা এবং কাজে'।
বগুড়ায় তৈরি এই মাদুর এখন সাউথ আফ্রিকা, সুদান, থাইল্যান্ড ও সোমালিয়াসহ সাতটি দেশে পাঠানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা।
"প্রাথমিকভাবে সপ্তাহে শুধুমাত্র সাউথ আফ্রিকাতেই চাহিদা রয়েছে ২০ হাজার পিস। এ ছাড়া মিয়ানমারসহ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশেও প্লাসটিক মাদুরের চাহিদা রয়েছে প্রচুর" বলে জানান তিনি।
"দর-দামে না পোষালেও আমার চাওয়া দেশের পাশাপাশি আর্ন্তাজাতিক বাজারেও বগুড়ার গ্রামে তৈরি পণ্য ভাল অবস্থান, রপ্তানীকারকদের তালিকায় দেখতে চাই আমার নাম আর সে কারণেই কিছুটা ছাড় দিয়ে হলেও রপ্তানী করতে চাই আমার প্রতিষ্ঠানে তৈরি মাদুর" বললেন নাহিদ সুলতানা তৃপ্তি।