বাণিজ্যে রাশিয়ার সঙ্গে ‘সোয়াপ’ করবে বাংলাদেশ
রাশিয়ার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে দ্বি-পাক্ষিক বাণিজ্য জোরদার করতে বিকল্প পথে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে বাংলাদেশ। এরই অংশ হিসেবে রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক সোয়াপ স্বাক্ষরের উদ্যোগ নিয়েছে। এটি হলে দুই দেশের মধ্যে করেসপন্ডিং ব্যাংকিং চালু না করেও আমদানি-রপ্তানি করা সম্ভব হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের একটি টিম রাশিয়া সফর করে এসে প্রস্তাবিত সোয়াপ চুক্তির খসড়া তৈরি করেছে। এ নিয়ে রোববার বাণিজ্য সচিব মো. জাফরউদ্দিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে বৈশ্বিক বাণিজ্য পরিস্থিতি ও রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ককে বিবেচনায় নিয়ে চুক্তির প্রভাব পর্যালোচনায় একটি কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
চুক্তি স্বাক্ষর হলে এটিই হবে কোন দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রথম সোয়াপ। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি চীনও বাংলাদেশের সঙ্গে সোয়াপ স্বাক্ষরের প্রস্তাব দিয়ে রেখেছে। চীন ১১টি দেশের সঙ্গে সোয়াপ সই করলেও তা খুব বেশি কার্যকর নয় বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স এন্ড এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশনের সিনিয়র সহ-সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'আমরা চাই, যতো দ্রুত সম্ভব রাশিয়ার সঙ্গে সোয়াপ স্বাক্ষর হোক। রাশিয়ায় আমাদের রপ্তানি সম্ভাবনা ইউরোপের অনেক দেশের চেয়ে বেশি।'
তিনি বলেন, 'রাশিয়ানদের ক্রয় ক্ষমতাও ইউরোপের অনেক দেশের তুলনায় বেশি। সোয়াপ স্বাক্ষর হলে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ এই বাজারে কয়েক বছরের মধ্যেই বাংলাদেশের রপ্তানি কয়েকগুণ বাড়ানো সম্ভব হবে।
২০১৫ সালে ইউক্রেনের ক্রিমিয়া দখল করার পর যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের অবরোধের মুখে রাশিয়া বাংলাদেশ থেকে মাছ, সবজি, আলু আমদানিতে আগ্রহ দেখায়। দেশটির বাজারে বাংলাদেশের নিটওয়্যার, ওষুধ, চিংড়ি, চামড়াজাত পণ্যেরও বিপুল চাহিদা রয়েছে।
এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ রাশিয়ার সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বাড়াতে নানা উদ্যোগ নেয়। এরই অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে স্বাক্ষরিত টিকফা চুক্তির মতোই রাশিয়ার সঙ্গে একটি চুক্তি সই করেছে বাংলাদেশ। এছাড়াও রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন ইউরেশীয় ইকোনমিক কমিশনের সঙ্গেও দু বছর আগে চুক্তি সই করেছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড এন্ড টেস্টিং ইন্সটিটিউশনের (বিএসটিআই) সঙ্গে রাশিয়ার মান নিয়ন্ত্রণ সংস্থা দ্য ফেডারেল এজেন্সি অন টেকনিক্যাল রেগুলেটিং এন্ড মেট্রোলজির মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরের প্রস্তুতিও চলছে।
কিন্তু রাশিয়ার বিভিন্ন ব্যাংক ও প্রতিষ্ঠানের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা থাকায় দেশটির ব্যাংকগুলোর সঙ্গে সরাসরি করেসপন্ডিং ব্যাংকিং সুবিধা চালু করতে পারছে না বাংলাদেশ। কারণ, বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর নস্ট্রো অ্যাকাউন্ট (nostro account) যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকগুলোতে। তাই যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার মুখে থাকা রাশিয়ার ব্যাংকগুলোর সঙ্গে লেনদেন করলে বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোও যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এ প্রেক্ষিতেই বিকল্প লেনদেনের পন্থা হিসেবে সোয়াপ স্বাক্ষরের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে জানিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেন এক্সচেঞ্জ পলিসি ডিপার্টমেন্টের কর্মকর্তারা জানান, সোয়াপ স্বাক্ষরিত হলে বাংলাদেশের কোন এক্সপোর্টার রাশিয়ায় পণ্য রপ্তানি করলে তার রপ্তানিমূল্য বাংলাদেশ ব্যাংক টাকায় পরিশোধ করবে। ওই পরিমাণ অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংক রাশিয়ার সেন্ট্রাল ব্যাংকের কাছে পাওনা থাকবে।
একইভাবে, রাশিয়া থেকে বাংলাদেশ কোন পণ্য আমদানি করলে রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংক ওই পণ্যের রপ্তানি মূল্য স্থানীয় মুদ্রা রুবলে নিজ দেশের রপ্তানিকারককে পরিশোধ করবে। ওই পরিমাণ অর্থ রাশিয়ার সেন্ট্রাল ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে পাওনা থাকবে। তিন মাস পর পর দুই দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেনা-পাওনার হিসাব সমন্বয় করবে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ রপ্তানির তুলনায় রাশিয়া থেকে আমদানি করে বেশি। সেক্ষেত্রে আমদানি মূল্য থেকে রপ্তানি মূল্য বাদ দেয়ার পর রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অবশিষ্ট পাওনা সুদসহ তিন মাস অন্তর অন্তর তৃতীয় কোন বৈদেশিক মুদ্রায় পরিশোধ করবে বাংলাদেশ ব্যাংক।
২০১৯-২০ অর্থবছরে রাশিয়ায় বাংলাদেশের রপ্তানি ছিল ৪৮৭ মিলিয়ন ডলারের। একই সময়ে রাশিয়া থেকে আমদানির পরিমাণ ছিল ৭৮২ মিলিয়ন ডলার। বর্তমানে রাশিয়ায় ব্যবসা করা গ্লোবাল ব্রান্ডগুলো হংকং ও সিঙ্গাপুর অফিস থেকে বাংলাদেশের আমদানি মূল্য পরিশোধ করছে।
রাশিয়ার বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক, ওষুধ ইলেক্ট্রনিকস পণ্য, ফলমূল ও সবজি রপ্তানির বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে বলে গতমাসে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে মস্কোতে নিযুক্ত বাংলাদেশের কমার্শিয়াল কাউন্সিলর মোল্লা সালেহীন সিরাজ।
নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'রাশিয়ার সঙ্গে পণ্য বিনিময়ের মাধ্যম সোয়াপ হলে বাংলাদেশের লোকসান হবে না। তা না করে পণ্যমূল্য লেনদেনে সোয়াপ হলে বাংলাদেশের লোকসান হবে। কারণ, বাংলাদেশ রাশিয়ায় যে পরিমাণ রপ্তানি করে, তার প্রায় দ্বিগুণ আমদানি করে। এ কারণে প্রতি তিন মাস পর পর বাংলাদেশকে অবশিষ্ট আমদানি মূল্যের পাশাপাশি সুদও গুণতে হবে'।
তিনি জানান, ভারত নির্দিষ্ট পণ্য বিনিময়ের মাধ্যমে ইরানের সঙ্গে সোয়াপের আওতায় আমদানি-রপ্তানি করছে। ভারত ইরানের পেট্রোলিয়ামের অন্যতম বড় ক্রেতা। এর বিনিময়ে ইরানের যেসব পণ্য আমদানি করা দরকার, ভারত সমমূল্যের সেসব পণ্য ইরানে রপ্তানি করে। ভারতের নিজের সেসব পণ্য না থাকলে চীন থেকে আমদানি করে ইরানে পাঠায়। রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশ এ ধরণের সোয়াপ করলে তা লাভজনক হবে বলে মত দেন ওই কর্মকর্তা।