কুর্স্কে ইউক্রেনের দ্বিতীয় আক্রমণ, পরাস্ত করতে সেরা জেনারেলকে পাঠালেন পুতিন
রাশিয়ার কুর্স্ক অঞ্চলের কিছু এলাকা এখনো নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখেছে ইউক্রেনীয় বাহিনী। অঞ্চলগুলো মুক্ত করতে রুশ বাহিনী অভিযান চালাচ্ছে, আর তাতে সাফল্য আসছে বলেও মনে করছে দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। তবে এরমধ্যেই আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে আসা পরিবর্তন ও যুদ্ধবিরতির আলোচনায় বসতে হতে পারে— এমন সম্ভাবনা মাথায় রেখেই নির্ভার হতে পারছেন না রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।
তাঁর দুর্ভাবনার কারণও আছে। গত রোববার হঠাৎ করেই কুর্স্কে পাল্টা-আক্রমণ অভিযান শুরু করেছে ইউক্রেন। এই অবস্থায়, সেখানে তাঁর অন্যতম বিশ্বস্ত ও কঠোর সেনানায়ক হিসেবে পরিচিত জেনারেল ইউনূস-বেক ইয়েভকুরভকে পাঠিয়েছেন পুতিন। তিনি এই আক্রমণ ঠেকাতে রুশ বাহিনীকে সংগঠিত করতে ভূমিকা রাখবেন।
২০২৪ সালে এই জেনারেলকে পদোন্নতি দিয়ে রাশিয়ার সীমান্ত প্রতিরক্ষা ও আফ্রিকায় ভাড়াটে যোদ্ধাদের মিশন পরিচালনার ভার দেন পুতিন। ইউক্রেন আক্রমণ শুরু করার কয়েক ঘন্টা পরেই তিনি পুতিনের নির্দেশে কুর্স্কে আসেন।
জানা যাচ্ছে, কুর্স্কে রুশ সেনাদের অবস্থানগুলোর দিকে এগোচ্ছে ইউক্রেনের সাঁজোয়া যান ও ট্যাংক। ফলে দ্রুতই তাদের ঠেকানো জরুরি হয়ে পড়েছে। এই অবস্থায়, জেনারেল ইয়েভকুরভকে পাঠিয়ে— পুতিন তার নিজের জড়িত হয়ে পড়ার বিষয়টি স্পষ্ট করেছেন।
যদিও ইউক্রেনের এই আক্রমণ প্রচেষ্টা আদতে কতটুকু সফল হবে— তা নিশ্চিত নয়, তবে পুতিন যে এবিষয়ে চিন্তিত তা স্পষ্ট।
২০২৪ সালে ঝটিকা এক অভিযান চালিয়ে কুর্স্কে ঢুকে পড়ে ইউক্রেনীয় বাহিনী। ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রথমবারের মতো রাশিয়ার কোনো ভূখণ্ড বিদেশি সেনাদের দখলে যায়। এরপর অঞ্চলটির অনেক অংশই দখলমুক্ত করতে পেড়েছে রাশিয়া, তবে এখনও বেশকিছু এলাকা ইউক্রেনের হাতে রয়েছে। এই অবস্থায়, নতুন আক্রমণ অভিযান চিন্তারই কথা। এটি সফল হলে ইউক্রেন আরও কিছু এলাকা দখল করবে।
রাশিয়া হয়তো তাদেরকে পরে ঠেকাতেও পারবে, বা এলাকাগুলো একটা সময় দখলমুক্ত করতে পারবে। কিন্তু, সমস্যা হচ্ছে সময় নিয়ে। রাশিয়া ও ইউক্রেন— যুদ্ধমান দুই পক্ষের কাছেই সময় খুব কম। আগামী ২০ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিবেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি একটি শান্তিচুক্তির জন্য আলোচনায় বসতে রাশিয়া ও ইউক্রেনের ওপর চাপ সৃষ্টি করবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
কিন্তু, ইউক্রেনের হাতে রাশিয়ার কিছু এলাকা থাকা অবস্থায় যদি আলোচনায় বসতে হয়— তাহলে দর কষাকষিতে পুতিনের অবস্থান দুর্বল হবে। সেই ভূখণ্ডের পরিমাণ যতই কম হোক না কেন— সেটি পুতিনকে পুনরুদ্ধার করতেই হবে। বিনিময়ে ইউক্রেন তাঁর ভূখণ্ডের বড় একটি অংশের দখল ছাড়তে মস্কোর ওপর চাপ দেবে। অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও তাতে দেশবাসীর কাছে মান হারাবেন পুতিন।
জেলেনস্কি এসব ভালো করেই বুঝছেন। হয়তো সেকারণেই ইউক্রেনীয় নেতা ইউক্রেনের প্রধান যুদ্ধক্ষেত্রের বাইরে অবস্থিত কুর্স্কে তার সেনাদের আক্রমণ অভিযানে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। এই কৌশলকেই তিনি হয়তো সেরা উপায় ভাবছেন।
যদি তাঁর সেনারা মাত্র দুই বা তিন সপ্তাহ কুর্স্কের দখলকৃত এলাকাগুলো ধরে রাখতে পারে—- তাহলে দর কষাকষিতে তাঁর অবস্থান শক্তিশালী হবে, জেলেনস্কির চিন্তাধারা হয়তো তাই। তবে এই মুহূর্তে তাঁর জন্য ঝুঁকিটাও অনেক বেশি। রোববারের পাল্টা-আক্রমণ অভিযানই হয়তো হতে পারে (যুদ্ধবিরতির আগে) তাঁর শেষ চাল।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইউক্রেনে আগ্রাসন চালায় রাশিয়া। তখন থেকেই যুদ্ধের ময়দানে রাশিয়াকে রুখে দেওয়ার অনমনীয় প্রতিশ্রুতির ওপর তাঁর প্রেসিডেন্ট পদে থাকাকে বাজি ধরেছেন তিনি। কিন্তু, গতবছরের গ্রীষ্মকাল থেকেই যুদ্ধের ময়দানে নাকাল হচ্ছে ইউক্রেনীয় সৈন্যরা। এতে স্পষ্ট হয় যায়, সামরিকভাবে রাশিয়াকে পরাস্ত করতে পারবে না কিয়েভ। তখন থেকে জেলেনস্কির প্রত্যয়ী সুরেও যেন ভাটা পড়েছে। আগের মতো রাশিয়ার বিরুদ্ধে কঠোর সুরে তাঁকে বক্তব্য দিতে দেখাও যাচ্ছে না।
এরপর যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয়— জেলেনস্কির জন্য আরেক ধাক্কা হয়ে আসে। ট্রাম্প নির্বাচনী প্রচারণার সময় এবং তাঁর আগেও বলেছেন, তিনি নির্বাচিত হলে ইউক্রেনকে যুদ্ধবিরতির আলোচনায় বসতে বাধ্য করবেন। ফলে ভলোদিমির জেলেনস্কি বুঝতে পারেন, বিদায়ী বাইডেন প্রশাসনের মতো অবিচল সমর্থন তিনি আর পাচ্ছেন না ওয়াশিংটন থেকে।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পরে ট্রাম্প ও তাঁর সহযোগীরা অবশ্য ইউক্রেনের বিষয়ে ততোটা কঠিন হওয়ার বার্তা দেননি। বরং রাশিয়াকে চাপ দিতে ইউক্রেনকে দেওয়া সহযোগিতা বাড়ানোর কথা বলছেন তাঁরা। যদি না প্রথমে রাশিয়ায় যুদ্ধবিরতির আলোচনায় আসতে চায়।
কিন্তু, এদিক থেকে কিছুটা আশ্বস্ত হতে পারলেও — আরেকটি চাপও তাঁর ওপর রয়েছে। ইউক্রেনের জনগণ এই যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে হতাশ হয়ে পড়েছে, তাঁদের অনেকেই এখন চায় রাশিয়ার সাথে শান্তিচুক্তি।
এই অবস্থায়, কুর্স্কের আক্রমণ অভিযান সফল হলে জনগণের মনোবল চাঙ্গা হবে, পশ্চিমা মিত্রদেরও বোঝানো যাবে যে, ইউক্রেন এখনও নিজের হয়ে লড়ার শক্তি রাখে, ফলে দেশটিকে সামরিক সহায়তা দেওয়া অব্যাহত রাখা উচিৎ।
তবে পুতিনের জন্য এই আক্রমণ প্রচেষ্টা বিরক্তিকর। এই সময়ে এসে এটি মাথাব্যথা হয়ে দাঁড়াক তা তিনি চান না।
ইউক্রেনীয় বাহিনী আবারো রাশিয়ার ভূখণ্ডে হামলা করছে– এটিও পুতিনের জন্য অপমানজনক। তবে তিনি দৃঢ়ভাবেই বিশ্বাস করেন, রাশিয়া সেনাশক্তি, অস্ত্রবলের ভারে এই সংগ্রামেও ইউক্রেনীদের একটা সময় পরাজিত করবে।
তবে সেই সময়টা 'কখন' আসবে— সেটা নিয়েই পুতিন চিন্তিত। দ্রুত জয় নিশ্চিত করতেই হয়তো একারণে পাঠালেন জেনারেল ইউনূস-বেক ইয়েভকুরভকে। ঘড়ির কাঁটার সাথেসাথে এগিয়ে আসছে ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদ ও সম্ভাব্য শান্তি আলোচনা। ফলে কুর্স্ক নিয়ে কালক্ষেপণের বিলাসিতা পুতিন করতে পারেন না।
জেলেনস্কির জন্য কুর্স্কের দ্বিতীয় আক্রমণ অভিযান হয়তো নিছকই এক জুয়া, যা কৌশলগতভাবে চতুর ও মরিয়া উভয়ই।