বিশ্বের বৃহত্তম মুক্ত বাণিজ্য জোটে যোগদানের সিদ্ধান্ত নিল বাংলাদেশ
বিশ্বের বৃহত্তম মুক্তবাণিজ্য জোট রিজিওনাল কম্প্রেহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ—আরসিইপিতে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ। ২০২৬ সালে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উত্তরণের পর বিশ্বের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ অর্থনীতির বাজারে শুল্কমুক্ত বাণিজ্যসুবিধা পেতেই নেওয়া হলো এ সিদ্ধান্ত।
চীনের নেতৃত্বাধীন এই জোটের সদস্যপদ পেতে বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক আগ্রহের কথা জানিয়ে সংস্থাটির সদর-দপ্তরে খুব শিগগিরই চিঠি পাঠাবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। গত রোববার (৫ সেপ্টেম্বর) বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড'কে নিশ্চিত করেছেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ও ডাব্লিউটিও সেলের মহাপরিচালক মো. হাফিজুর রহমান।
তিনি বলেন, এ বিষয়ে সংস্থাটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রস্তাব পাঠানো হবে।
মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, আগামী বছরের শুরুতে আরসিইপি কার্যকর হলে আপাতত বাংলাদেশের রপ্তানিতে তেমন কোনো প্রভাব পড়ার আশঙ্কা নেই। কারণ, এ জোটভূক্ত ১৫ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের প্রধান দুই বাজার জাপান ও চীন। স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে দেশ দুটিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা ভোগ করছে বাংলাদেশ।
এর বাইরের নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়াতেও শুল্কমুক্ত সুবিধা পায় ঢাকা। তবে ২০২৬ সালে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হলে এ সুবিধা হারাতে হবে। তখন বিশ্বের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ অর্থনীতির নিয়ন্ত্রক আরসিইপিভূক্ত দেশগুলোতে বাংলাদেশের রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থেকে এই জোটে শরীক হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
তাছাড়া, বাংলাদেশ যদি আরসিইপিতে যোগ না দেয় বা এর সদস্য দেশগুলোর সঙ্গে পৃথক মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি সম্পন্ন না করতে পারে, তাহলে এ চুক্তি কার্যকর হলে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের প্রতিদ্বন্দ্বী ভিয়েতনাম জাপান ও চীনে শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা পাবে। তাই আরসিইপির কারণে ২০২৬ সালের পর ভিয়েতনামের কাছে বাংলাদেশের বাজার হারানোর আশঙ্কা করছেন কর্মকর্তারা।
মূলত আরসিইপি জোটে যোগ না দেওয়ার সম্ভাব্য বাণিজ্যিক ক্ষতির মূল্যায়ন করেই বাংলাদেশ এ বাণিজ্য জোটে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানান তারা।
উল্লেখ্য, ২০২০ সালের ১৫ নভেম্বর চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড এবং অ্যাসোসিয়েশন অব সাউথইস্ট এশিয়ান নেশনস (আসিয়ান) জোটের ১০ সদস্য: ব্রুনেই, ভিয়েতনাম, লাওস, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড, মায়ানমার, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইনসহ মোট ১৫টি দেশ বিশ্বের বৃহত্তম এ বাণিজ্যিক জোটে যোগদানের চুক্তি স্বাক্ষর করে। জোটভুক্ত দেশগুলোর মোট জনসংখ্যা ২২০ কোটি। আর সম্মিলিত জিডিপির পরিমাণ ২৬ লাখ ২০ হাজার কোটি ডলার।
এ চুক্তির মূল লক্ষ্য সদস্য দেশের মধ্যে আন্তঃবাণিজ্যে শুল্কের পরিমাণ হ্রাস, বাণিজ্য সেবার উন্মুক্তকরণ এবং উদীয়মান অর্থনীতির সদস্য দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমে বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আর্থসামাজিক উন্নতি সাধন।
বিশেষ করে, আরসিইপি'র মাধ্যমে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের খরচ ও সময় কমিয়ে এ জোটের যেকোন সদস্য দেশে পণ্য রপ্তানির সুযোগ করে দেওয়ার লক্ষ্য রয়েছে। এক্ষেত্রে প্রতিটি দেশের আলাদা বিধিমালার ঝামেলা এড়ানোর সুযোগ পাবে কোম্পানিগুলো।
চুক্তি স্বাক্ষরকারী ১৫ দেশের এক-পঞ্চমাংশ বা ছয়টি আসিয়ান ও তিনটি নন-আসিয়ান দেশের পার্লামেন্টে আনুষ্ঠানিক অনুমোদনের ৬০ দিনের মধ্যে এটি কার্যকর হবে। এরমধ্যেই জাপান, সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ড তাদের পার্লামেন্টে আরসিইপিতে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত পাস করিয়েছে। এই প্রেক্ষিতে আগামী বছরের জানুয়ারি থেকে কার্যক্রম শুরুর লক্ষ্য রয়েছে জোটটির।
২০১২ সালে আরসিইপি গঠনের পরিকল্পনা প্রথম সামনে আসে, আর ২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ (টিপিপি) চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর এটি গঠনের উদ্যোগ গতি পায়।
তাছাড়া, কোভিড-১৯ মহামারি হানা দেওয়ার আগেই যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্য যুদ্ধের ফলে আঞ্চলিক অর্থনীতি পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছালে নতুন গতি পায় আরসিইপির উদ্যোগ।
এরপর, ২০১৯ সালে থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে ১৬ জাতির আলোচনায় এ চুক্তিতে আনুষ্ঠানিকভাবে অংশগ্রহণের ইচ্ছাপ্রকাশ করে ভারত। ২০২০ সালে দেশটির এ চুক্তিতে স্বাক্ষর করার কথা থাকলেও পরবর্তীতে বাণিজ্যের অমীমাংসিত কিছু সমস্যার কথা উল্লেখ করে এ উদ্যোগ থেকে সরে যায় নয়াদিল্লি।
এসময় বিশ্বের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক জোট আরসিইপির সম্পূর্ণ আলোচনা প্রক্রিয়া থেকে দূরে সরেছিল বাংলাদেশ। এরপর বিশেষজ্ঞরা অভিমত ব্যক্ত করেন যে, চীনের নেতৃত্বাধীন হওয়ায় এর ফলে বাংলাদেশ বাণিজ্য সুবিধা হারানোর পাশাপাশি সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ পেতেও সমস্যার সম্মুখীন হবে। তারা বাংলাদেশের আরসিইপিতে যোগদান অথবা জোটের সাথে কোন প্রকার চুক্তির পরামর্শ দেন, যাতে করে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের পরও অর্থনৈতিক সুবিধা নিশ্চিত করা যায়।
তবে আরসিইপি চুক্তি স্বাক্ষরের এক সপ্তাহের মধ্যে বাংলাদেশের রপ্তানিতে সম্ভাব্য নেতিবাচক প্রভাব পর্যালোচনা করতে একটি কমিটি গঠন করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এছাড়া, বাংলাদেশ এ জোটে যোগদান করলে তার প্রভাব কেমন হবে, সেটি নির্ধারণের দায়িত্ব পায় ৯ সদস্যের ওই কমিটি।
কমিটি বলেছে, আসিয়ানভুক্ত ১০টি দেশ ইতোমধ্যেই নিজেদের মধ্যে শুল্কমুক্ত বাণিজ্য চালু করেছে। স্বাক্ষরকারী বাকি ছয় দেশের ভেতর শুল্কমুক্ত সুবিধা থাকায় চীন ও জাপান বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বাজার। অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডসহ বাকি চারটি দেশে বাংলাদেশের রপ্তানি বেশ কম। তাই আরসিইপি অচিরেই বাংলাদেশের জন্য বড় মাথাব্যথার কারণ হয়ে ওঠবে না বলে মনে করছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তবে বাংলাদেশ যখন উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উত্তরণ করবে তখন সামগ্রিক রপ্তানি ও সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হতে পারে।
আরসিইপি চুক্তি স্বাক্ষরের সাত দিনের মাথায় বাংলাদেশের রপ্তানিতে এ চুক্তি কতোটা প্রভাব ফেলবে এবং বাংলাদেশ নতুন এই জোটে যোগদান করলে বাংলাদেশের প্রভাব কেমন হবে, তা পর্যালোচনা করতে ৯ সদস্যের কমিটি গঠন করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। আরসিইপি চুক্তিতে কী রয়েছে, সেগুলো পর্যালোচনা করে কমিটি মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে বলে বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড'কে জানান কমিটির সদস্য এবং বাংলাদেশ ট্রেড এন্ড ট্যারিফ কমিশনের সদ্য বিদায়ী সদস্য ড. মোস্তফা আবিদ খান।
তিনি বলেন, আরসিইপির কারণে বাংলাদেশের রপ্তানিতে কতোটা প্রভাব পড়তে পারে কিংবা আরসিইপিতে যোগদান করলে বাংলাদেশের লাভ-ক্ষতি কেমন হবে, তা নিয়ে এখনও কোনও কাজ হয়নি। আরসিইপিতে যোগদানের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে প্রস্তাব পাঠানোর আগেই এসব বিষয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ প্রয়োজন।
'আরসিইপিতে যোগ দিয়ে বাংলাদেশ কতোটুকু সুবিধা পাবে এবং বাংলাদেশ অন্য দেশগুলোকে কতোটা সুবিধা দিতে পারবে, তার হিসাব করতে হবে। চুক্তিতে যে ট্যারিফ সিডিউল রয়েছে, তা বিশ্লেষণ করলেই স্পষ্ট হবে যে, আমরা কি পরিমাণ সুবিধা পাবো। তাতে বাংলাদেশের বাড়তি লাভের সম্ভাবনা দেখা দিলে তার সুফল পেতে অ্যাকশন প্লান তৈরি করে কাজ করতে হবে'- জানান তিনি।
মোস্তফা আবিদ বলেন, সদস্য পদের জন্য এখনই প্রস্তাব পাঠাতে হবে, এমন নয়। চুক্তিটি কার্যকর হওয়ার ৬ মাস পর থেকে নতুন সদস্য অন্তর্ভূক্ত করবে জোটটি। আর এই সময়সীমার মধ্যেই বাংলাদেশকে যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে হবে। লাভ-ক্ষতির বিশ্লেষণ না করে সদস্য হওয়ার জন্য আবেদন করলে তা কোন সুফল দেবে না বলে মনে করেন তিনি।
২০১৫ সালে যখন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ১২ জাতি ট্রান্স প্যাসেফিক পার্টনারশিপ (টিপিপি) চুক্তি স্বাক্ষরের খসড়া তৈরি করে, তখন ওই চুক্তির প্রভাব বাংলাদেশের উপর কতোটা পড়বে এবং তা থেকে উত্তরণের উপায় জানতে বিভিন্ন দেশে নিযুক্ত বাংলাদেশ দূতাবাসের মতামত সংগ্রহ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
ওই সময় ব্রাসেলসে বাংলাদেশের কমার্শিয়াল কাউন্সিলর হিসেবে নিয়োজিত থাকা বর্তমান বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ টিপিপির সম্ভাব্য প্রভাব মোকাবেলায় চীনের নেতৃত্বাধীন আরসিইপিতে যোগদানের পক্ষে লিখিত মতামত দিয়েছিলেন। যদি আরসিইপিতে যোগদান করা সম্ভব না হয়, তাহলে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার পর চীনের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করার পরামর্শ দিয়েছিলেন তিনি।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, বাংলাদেশ বর্তমানে তিনটি বহুপাক্ষিক অর্থনৈতিক জোটের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে, এগুলো হলো; ডেভেলপিং এইট (ডি-৮), এশিয়া-প্যাসিফিক ট্রেড এগ্রিমেন্ট (এপিটিএ) এবং সাউথ এশিয়ান ফ্রি ট্রেড এরিয়া (সাফটা)।