বেসরকারি পর্যায়ে চাল আমদানিতেও হতাশা, আরেক দফা শুল্ক কমানোর প্রস্তাব
- চালের আমদানি শুল্ক ২৫ থেকে কমে ১৫ শতাংশে নামছে
- বরাদ্দ পাওয়া প্রায় অর্ধেক আমদানিকারক এলসিই খোলেনি
- বরাদ্দ পেয়ে যারা এলসি খোলেনি তাদের বরাদ্দ বাতিল
- ভারতে চালের দাম বেশি হওয়ার আমদানিকারকদের আগ্রহ নেই
- সরকারের খাদ্যশস্যের মজুদ তলানিতে
- কমানো হয়েছে খাদ্যশস্যের মোট বিতরণ লক্ষমাত্রা, তাতেও চাপে সরকার
- টিআর, কাবিখা, ওএমএস কার্যক্রম চলছে নামমাত্র
সরকারি পর্যায়ে চাল আমদানিতে গতি নেই। ভারতের বাজারে দাম বেশি হওয়ার কারণে বেসরকারি পর্যায়ে অনুমতি পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যেও আগ্রহ কম। ফলে আমদানি করা চাল দিয়ে স্থানীয় বাজার নিয়ন্ত্রণের যে উদ্দেশ্য তা পুরোপুরি ব্যর্থ। এই পরিস্থিতিতে চাল আমদানিতে শুল্কহার আরও কমানোর কাজ চলছে বলে খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
জানা গেছে, সিদ্ধ চাল ও আতপ চাল আমদানিতে বর্তমানে ২৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক বিদ্যমান। এই শুল্ক আরও ১০ শতাংশ কমিয়ে ১৫তে নামিয়ে আনার সুপারিশ করেছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। যাতে করে কম খরচে দ্রুত চাল আমদানি করে স্থানীয় বাজারের উচ্চমূল্য নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়। এর আগে বেসরকারিভাবে চাল আমদানির সুযোগ দেয়ার সময় আমদানি শুল্ক ৬২.৫০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশ করা হয়।
সম্প্রতি খাদ্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের সভাপতিত্বে একটি মিটিং হয়। এতে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব, কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) একজন সদস্য মন্ত্রীর দপ্তরে এই মিটিং করে। এই মিটিং এ চালের আমদানি শুল্ক কমানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
মিটিংয়ে খাদ্য মন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার চাল আমদানির বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য উপস্থাপন করেন। এতে বলা হয়, বেসরকারিভাবে ৩২০ জন আমদানিকারককে ১০১৭৫০০ মেট্রিক টন চাল আমদানির অনুমতি দেয়া হয়। কিন্তু এলসি খোলার সময়সীমা দুইবার বাড়ানোর পরও গত ফেব্রুয়ারীর ১৫ তারিখ পর্যন্ত অনেকেই এলসি খোলেনি। আবার অনেকে এলসি খুললেও চাল আমদানি করেনি।
খাদ্যমন্ত্রী বলেন, 'এলসি খোলা ও আমদানির পরিমাণ হতাশাজনক। যে কারণে নির্ধারিত সময়ে যারা এলসি খুলেনি তাদের বরাদ্দ বাতিল করা হয়েছে। এই বরাদ্দ ইতোমধ্যে যারা এলসি খুলেছে তাদের মধ্যে পুনর্বরাদ্দ হিসেবে দেয়া হচ্ছে।'
জানা গেছে, বর্তমানে ভারতের বাজারে চালের দাম চড়া। খাদ্য মন্ত্রণালয়য়ের দৈনিক খাদ্যশস্য পরিস্থিতির হালনাগাদ তথ্যে দেখা গেছে ভারত থেকে প্রতি কেজি সিদ্ধ চাল আনতে খরচ পড়ছে প্রায় ৫০ টাকা। তাই ভারত থেকে চাল এনে আমদানিকারকরা কম দামে বিক্রি করতে পারছে না। কারণ চালের প্রকারভেদে প্রতি কেজিতে ৮-৯ টাকা পর্যন্ত আমদানি শুল্ক প্রদান করতে হয়।
জানা গেছে, এ পর্যন্ত বেসরকারি আমদানিকারকদের মাধ্যমে মাত্র ৬১৬৩৭৩ টন চাল আমদানির এলসি খোলা হয়েছে। যা মোট বরাদ্দের অর্ধেকের কিছু বেশি। আর চাল দেশে এসেছে মাত্র ১.৫২ লাখ টন।
খাদ্য সচিব মোছাম্মত নাজমানারা খানুম বলেন, বেসরকারিভাবে আমদানিকৃত চালের পরিমাণ আশানুরূপ না হওয়ায় বাজারমূল্য নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। আমদানির সিদ্ধান্তের শুরুতে কিছুটা দাম কমলেও পুনরায় ধান ও চালের দাম বাড়ছে।
এদিকে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মেসবাহুল ইসলাম জানান, সরকারি মজুত আশংকাজনকভাবে হ্রাস পাওয়ায় ব্যবসায়িরা সুবিধা গ্রহণ করছে এবং তারা আরো মূল্য বৃদ্ধির চেষ্টা করতে পারে। এ সময় সরকারি মজুদ বৃদ্ধির সর্বাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। প্রয়োজনে বেসরকারি পর্যায়ে আমদানি শুল্ক আরো কমিয়ে বাজারে চালের সরবরাহ বাড়াতে হবে।
তিনি বলেন, এ বছর বোরোর আবাদের জমির পরিমাণ ও আবাদের লক্ষ্যমাত্র বাড়ানো হয়েছে। প্রায় দুই লাখ হেক্টর জমিতে হাইব্রীড ধান আবাদের জন্য কৃষকদের প্রণোদনা দেয়া হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে এবার ভালো ফলন হবে। তাই কৃষক যাতে ভালো দাম পায় সেদিকে চিন্তা করে আমদানি সীমিত রাখতে হবে। এবং কোনভাবেই এপ্রিলের শেষে আর আমদানি করা যাবে না।
এদিকে সভায় সিদ্ধ চাল ও আতপ চালের শুল্ক কমানোর পাশাপাশি সরকারি মজুদ যথেষ্ট না থাকায় বেসরকারিভাবে দ্রুত সরবরাহ বাড়ানোর বিষয়ে গুরুত্বারোপ করা হয়।
এ সময় এনবিআরের সদস্য (শুল্ক নীতি) সৈয়দ গোলাম কিবরিয়া বলেন, 'আমদানি শুল্ক আরোপ করা হয় কৃষকের স্বার্থে। কিন্তু সব মানুষের খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়েও নজর দেয়া প্রয়োজন। এই সভা থেকে যেসব সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে এনবিআর সব ধরনের সহায়তা করতে প্রস্তুত।'
বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারি মজুদ বৃদ্ধির কোন বিকল্প নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, শুধু একটি দেশের উপর নির্ভরশীল না থেকে ব্যাকআপ হিসেবে অন্যান্য দেশ থেকেও আমদানির উদ্যোগ নেয়া উচিত।
সরকারের স্টক কম থাকায় টিআর, কাবিখার বরাদ্দ কমেছে
প্রতিবছর টিআর, কাবিখা, ওএমএস সহ বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে খাদ্যশস্য বিতরণের একটি লক্ষ্যমাত্রা থাকে সরকারের। কিন্তু এবার সেই লক্ষ্যমাত্রা একদফা কমিয়েও বিভিন্ন কর্মসূচি চালু রাখতে পারছে না খাদ্যমন্ত্রণালয়।
জানা গেছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে মূল চাহিদা ৩১.৩৬ লাখ মে. টন থেকে কমিয়ে সংশোধিত বিরতণ চাহিদা ২৪.৫৫ লাখ টন নির্ধারণ করা হয়। যার মধ্যে ১৮.৬৪ লাখ টন চাল ও ৫.৯০ লাখ টন গম।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র বলছে, সর্বশেষ বোরো ও আমন মৌসুমে বাজারে ধানের দাম বেশি থাকায় সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি সরকার। যে কারণে খাদ্যের স্টক এখন তলানিতে।
জানা গেছে, গত ফেব্রুয়ারির ১৮ তারিখ পর্যন্ত ১০.৬৯ লাখ টন চাল ও ৩.৩২ লাখ টন গম সহ মোট ১৪.০১ লাখ টন খাদ্যশস্য বিতরণ করা হয়েছে। আগামী জুনের মধ্যে ৭.৯৫ লাখ টন চাল ও ২.৫৮ লাখ টন গম বিতরণ করতে হবে। একই সঙ্গে অর্থবছর শেষে জুন ২০২১ এ নীতিমালা অনুযায়ী মজুদ রাখতে হবে কমপক্ষে ১০ লাখ টন।
এই হিসেবে মোট চাহিদা রয়েছে ১৫.৯৫ লাখ টন চাল ও ৪.৫৮ লাখ টন গম। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, ১ মার্চ পর্যন্ত খাদ্যশস্যের সরকারি মোট মজুদের পরিমাণ ৬.৩৪ লাখ টন। যেখানে ৫.২৯ লাখ টন চাল ও ১.০৫ লাখ টন গম রয়েছে। এর ফলে যেসব সামাজিক কর্মসূচিতে খাদ্যশস্য বিতরণ করা হয় সেগুলো ঝুঁকিতে পড়েছে। অর্থাৎ সরকার খাদ্যশস্য সংগ্রহ নিয়ে ব্যাপক চাপের মধ্যে পড়েছে।
খাদ্য সচিব মোছাম্মত নামজানারা খানুম বলেন, 'ভারত থেকে ধীরগতিতে চাল আসায় পর্যাপ্ত মজুদ গড়ে তোলা যাচ্ছে না। বাজারমূল্য নিয়ন্ত্রণের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ ওএমএসও বিতরণ করা যাচ্ছে না। শুধু মহানগরী ও জেলা শহরগুলোতে সীমিত পরিমাণে ওএমএস কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে।
কনজ্যুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এর সভাপতি গোলাম রহমান টিবিএসকে বলেন, বাজারে যখন চালের দাম বাড়ে তখন ওএমএস কর্মসূচি জোরদার করতে হয়। এতে করে নিম্নআায়ের মানুষের ওপর চাপটা কিছুটা কমে। কিন্তু এই ক্ষেত্রে সরকার ভূমিকা রাখতে না পারলে মানুষগুলোর কষ্টের সীমা থাকবে না।