ভ্যাটের ৪৫ শতাংশই দিয়েছে ১০ কোম্পানি
সদ্য-সমাপ্ত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রাজস্ব খাতের প্রধান উৎস মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) খাতে প্রায় ৪৫ শতাংশই যোগান দিয়েছে শীর্ষ দশটি কোম্পানি।
সরকারের নিরুৎসাহিত পণ্য হলেও শীর্ষ এ তালিকায় সবচেয়ে বেশি অবদান আবার তামাকজাত দ্রব্য খাতের কোম্পানিগুলোর। এছাড়া সেলফোন সেবাদানকারী বহুজাতিক তিন কোম্পানির বাইরে এ তালিকার বাকী প্রতিষ্ঠানগুলো পাওয়ার ও পেট্রোলিয়াম খাতের।
রাজস্ব আহরণকারী সংস্থা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তারা বলছেন, কিছু পণ্যে উচ্চ কর-আরোপ, বিদ্যুৎ-জ্বালানি এবং টেলিযোগাযোগ খাতের ব্যবসা বড় হওয়ার কারণে অল্প কয়েকটি কোম্পানিই রাজস্বে মূল অবদান রাখছে।
২০১৮-১৯ অর্থবছরে ভ্যাটখাতে ৮৭ হাজার ৬১০ কোটি টাকা আহরণ করেছে এনবিআর। এর মধ্যে শীর্ষ ১০টি কোম্পানিই দিয়েছে ৩৯ হাজার ৮০ কোটি টাকা। এটি মোট রাজস্বের ৪৪ দশমিক ৮৮ শতাংশ। অর্থাৎ ভ্যাট রিটার্ন জমা দেয়া বাকী দেড় লাখ প্রতিষ্ঠান দিয়েছে ৫৫ শতাংশ।
এনবিআর চেয়ারম্যান ও অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "মানুষের নিত্য ব্যবহার্য পণ্যের অধিকাংশ ভ্যাটমুক্ত। তামাক, টেলিযোগাযোগসহ বিলাস পণ্যের ব্যবসা কয়েকটি কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে থাকায় তারাই সবচেয়ে বেশি জমা দেয়।"
"ফাঁকি বন্ধ করে নতুন আইনে ভ্যাটের আওতা বাড়ানো হয়েছে। এর ফলে অন্যান্য খাতেও ভ্যাট আহরণ বাড়বে", বলছেন মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া।
তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, সর্বশেষ অর্থবছরে ভ্যাটখাতে একক কোম্পানি হিসেবে ১৯ হাজার ৬৯৬ কোটি টাকা দিয়ে শীর্ষে রয়েছে বহুজাতিক কোম্পানি ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ কোম্পানি। মোট রাজস্বে এ কোম্পানির অবদান ২২.৪৪%।
দেশের শীর্ষ টার্নওভারের কোম্পানি হওয়ার পাশাপাশি কমপ্লায়েন্সেও সেরা এ প্রতিষ্ঠানটি। যদিও তামাক খাতে সরকারের উচ্চ করারোপের কারণে কয়েক বছর ধরেই শীর্ষ ভ্যাট প্রদানকারীর স্বীকৃতি পেয়ে আসছে বিএটি বাংলাদেশ।
২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১৬ হাজার ৫৩৯ কোটি টাকার ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক দিয়েছে বিএটি বাংলাদেশ।
এ কারণে দেশের শেয়ারবাজারেও সর্বোচ্চ কদর এ কোম্পানির। ১৮০ কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধনের কোম্পানিটির ১০ টাকার শেয়ারের সর্বশেষ বাজার দর ১২০৫ টাকা। প্রতিবছর বিনিয়োগকারীদের ৫০০ শতাংশের বেশি ডিভিডেন্টও দিয়ে আসছে এ কোম্পানি।
বিএটি বাংলাদেশের চেয়ারম্যান গোলাম মইন উদ্দিন দ্য বিজনেস স্টান্ডার্ডকে বলেন, "সম্পূরক শুল্ক ও মূসক বাবদই দৈনিক ৫৫ কোটি টাকা এনবিআরকে পরিশোধ করছে বিএটি। এর বাইরে করপোরেট কর, স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ ও উন্নয়ন সারচার্জও দিতে হয় আমাদের।"
তিনি আরো বলেন, "বিএটি শতভাগ কমপ্লায়েন্স মেনে রাজস্ব পরিশোধ করছে। বেশি টার্নওভার ও সরকার নির্ধারিত করহারের কারণে আমাদের কোম্পানি ভ্যাট প্রদানে শীর্ষে রয়েছে।"
সিগারেট পণ্যে উৎপাদনের পর স্ল্যাবভেদে টার্নওভারের সর্বোচ্চ ৬৫ শতাংশ পর্যন্ত সম্পূরক শুল্ক ও ১৫ শতাংশ হারে মূসকসহ প্রায় ৭৫ শতাংশ ভ্যাট ধার্য হওয়ায় ভ্যাট প্রদান শীর্ষ তালিকায় দ্বিতীয় স্থানেও এ খাতের ইউনাইটেড ঢাকা টোব্যাকো লিমিটেড। আর পঞ্চম স্থানে রয়েছে আবুল খায়ের টোব্যাকো লিমিটেড।
২০১৮-১৯ অর্থবছরে ইউনাইটেড টোব্যাকো ৫ হাজার ৮৪৮ কোটি টাকা ও আবুল খায়ের টোব্যাকো লিমিটেড ২ হাজার ২৩৪ কোটি টাকা ভ্যাট দিয়েছে। এর আগের বছরও যথাক্রমে ৩ হাজার ৭০৩ কোটি ও ১ হাজার ৬৭২ কোটি ভ্যাট দিয়েছিল এ দুটি প্রতিষ্ঠান। যদিও ওই বছর তাদের অবস্থান ছিল ৩ ও ৭ নম্বরে।
তামাক কোম্পানিগুলোর পরই শীর্ষ ভ্যাট প্রদানকারীদের তালিকায় আধিপত্য টেলি-কমিউনিকেশন খাতের কোম্পানির। শীর্ষ তালিকায় রয়েছে এ খাতে তিন প্রাইভেট কোম্পানি গ্রামীণফোন, রবি আজিয়াটা ও বাংলালিংক ডিজিটাল কমিউনিকেশন লিমিটেড।
টেলি কমিনিউকেশন খাতে সেলফোনে ১৫% ভ্যাট, ৭% সম্পূরক শুল্ক ও ২% সারচার্জসহ মোট ২৭ দশমিক ৫০% শতাংশ ভ্যাট বাবদ দিতে হয় গ্রাহকদের। গ্রাহকদের বিল থেকে কেটে এনবিআরকে এ অর্থ জমা দেয় কোম্পানিগুলো।
২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২ হাজার ৬৪৬ কোটি টাকা ভ্যাট দিয়ে সর্বশেষ অর্থবছরে ৪র্থ স্থানে রয়েছে এ খাতের শীর্ষ কোম্পানি গ্রামীণফোন লিমিটেড। ১ হাজার ৩০৬ কোটি টাকা জমা দিয়ে ৬ষ্ঠ স্থানে রবি আজিয়াটা ও ৯১৮ কোটি দিয়ে অস্টম স্থানে বাংলালিংক। যদিও এনবিআরকে দেয়া এ রাজস্বের বাইরে বিটিসিএল ও করপোরেট করসহ সেলফোন অপারেটরদের আরো রাজস্ব পরিশোধ করতে হয় বলে দাবি কোম্পানিগুলোর।
এর আগে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে গ্রামীণফোন ২ হাজার ৪০১ কোটি টাকা, রবি ১ হাজার ২৩ কোটি টাকা ও বাংলালিংক ৬৭৫ কোটি টাকা জমা দিয়েছে।
শীর্ষ ভ্যাট প্রদানকারী কোম্পানির তালিকায় থাকায় পাশাপাশি শেয়ারবাজারেও ভালো অবস্থান ধরে রেখেছে মুনাফায় থাকা একমাত্র টেলিকম কোম্পানি গ্রামীণফোন।
১৩৫০ কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধনের কোম্পানিটির ১০ টাকা ফেইস ভ্যালুর একটি শেয়ারের সর্বশেষ দর ৩২০ টাকা। শেয়ারহোল্ডারদের প্রতিবছর ২০০ শতাংশের বেশি ডিভিডেন্ট দেয় এ কোম্পানিটি।
বেশি করারোপের পাশাপাশি কমপ্লায়েন্সের কারণে মোবাইল কোম্পানিগুলো এগিয়ে বলে মনে করছে সেলফোন অপারেটরদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব মোবাইল টেলিকম অপারেটরস অব বাংলাদেশ (অ্যামটব)।
সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল (অব.) এস এম ফরহাদ হোসেন দ্য বিজনেস স্টান্ডার্ডকে বলেন, "মোবাইল কোম্পানিগুলো আন্তর্জাতিক মানদন্ড মেনে চলে আর্থিক প্রতিবেদন তৈরি করে। আহরিত সব কর সঠিকভাবে পরিশোধ করে।"
তামাক ও সেলফোন অপারেটরের বাইরে ভ্যাটে সবচেয়ে বেশি অবদান পেট্রোলিয়াম ও গ্যাস খাতের।
২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৪ হাজার ৪৫৬ কোটি টাকা জমা দিয়ে শীর্ষ তালিকায় তৃতীয় স্থানে রাষ্ট্রায়ত্ত তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ করপোরেশন পেট্রোবাংলা। আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানি (আইওসি) থেকে কেনা পণ্যের বিপরীতে এ ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক প্রদান করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
এর বাইরে গ্যাস বিতরণের ওপর ভ্যাট প্রদান করে শীর্ষ দশে স্থান করে নিয়েছে পেট্রোবাংলার অধীনস্থ তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের অধীন মেঘনা পেট্রোলিয়াম ও বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড (বিপিডিবি)।
২০১৮-১৯ অর্থবছরে এই তিন প্রতিষ্ঠান যথাক্রমে ১ হাজার ৮৭ কোটি, ৪৭০ কোটি টাকা ও ৪২১ কোটি টাকার ভ্যাট জমা দিয়েছে।