কূপ খনন থেকে চলতি বছর প্রতিদিন আরও ৩২ কোটি ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে আনতে চায় সরকার
প্রাকৃতিক গ্যাসের ক্রমবর্ধমান সংকট মেটাতে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ— চলতি বছরেই দেশের বিভিন্ন এলাকায় অবস্থিত ৩৪টি গ্যাস কূপ খনন, অনুসন্ধান, উন্নয়ন এবং ওয়ার্কওভারের পরিকল্পনা নিয়েছে। যার মাধ্যমে দৈনিক ৩২ কোটি ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
দেশে দৈনিক ৩৮০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা রয়েছে। এই চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। পেট্রোবাংলা সরবরাহ করতে পারছে ২৫০ থেকে ২৮০ কোটি ঘনফুট পর্যন্ত। এরমধ্যে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে উচ্চ দামে এলএনজি আমদানি করে দৈনিক প্রায় ১০০ কোটি ঘটনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হয়।
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান রেজানুর রহমান এ বিষয়ে টিবিএসকে বলেন, ২০২৫ সালে অনুসন্ধান, খনন ও উন্নয়ন এবং ওয়ার্কওভার মিলিয়ে মোট ৩৪টি কূপের কাজ শেষ করার লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। এসব কূপের কাজ করা গেলে এলএনজি আমদানির চাপ কমেবে। কূপ খনন ও ওয়ার্কওভারের মাধ্যমে দেশীয় গ্যাস উত্তোলন বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। থ্রিডি সিসমিক সার্ভের মাধ্যমে যে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে— সেই পরিমাণ উত্তোলন করা গেলে এলএনজি আমদানির পরিমাণ অনেক কমে যাবে।
জ্বালানি বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, বাপেক্সের মাধ্যমে ১৪টি কূপ খনন ও ওয়ার্কওভার করা হবে। এর বাইরে এবছরই আরও ২০টি কূপে অনুসন্ধান ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ড করা হবে আন্তর্জাতিক উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতিতে বিদেশি কোম্পানি দিয়ে।
ওয়ার্কওভার হচ্ছে– বিদ্যমান কূপকে পুনরায় খনন ও উন্নয়নের মাধ্যমে তার উৎপাদনশীলতা বজায় রাখা ও বাড়ানো। অর্থাৎ, যেসব কূপে গ্যাসের উৎপাদন কমে গেছে বা বন্ধ হয়ে গেছে, সেখানে সংস্কারের মাধ্যমে উৎপাদন বাড়ানো।
প্রাথমিকভাবে এসব প্রকল্পের ব্যয় ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি ধরা হয়েছে। গত ২২ জানুয়ারি এনিয়ে জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানের সভাপতিত্বে সচিবালয়ে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভার কার্যবিবরণী সূত্রে যা জানা গেছে।
বেশিরভাগ কূপের দরপত্র ইতোমধ্যেই আহ্বান করা হয়েছে
জানা গেছে, কূপ খনন ও ওয়ার্কওভারের কারিগরি বিশ্লেষণ ও অগ্রাধিকার নির্ধারণের জন্য পাঁচ সদস্যের একটি উপকমিটি গঠন করা হবে। এই কমিটি যে কূপ যেভাবে খনন ও উন্নয়নের পরামর্শ দেবে— কোম্পানিগুলো সেভাবে কাজ করবে। কূপখনন কার্যক্রম যথাযথভাবে বাস্তবায়নের জন্য এই কমিটি নিয়মিত তদারকি ও পরিদর্শন করবে।
জ্বালানি বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এরমধ্যে বাপেক্স ৯টি কূপের ওয়ার্কওভার, আর পাঁচটি কূপের অনুসন্ধানের কাজ করবে। বাকি ২০টি কূপ অনুসন্ধান ও খনন করা হবে আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে বিদেশি প্রতিষ্ঠান দিয়ে।
'ইতিমধ্যে বেশিরভাগ কূপের দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। সিলেট গ্যাসফিল্ডসহ কয়েকটি কূপের কার্যাদেশ দেওয়া হচ্ছে' - যোগ করেন তিনি।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বদরুল ইমাম এ বিষয়ে টিবিএসকে বলেন, "গ্যাসের উৎপাদন বাড়ানোর জন্য ওয়ার্কওভার একটি ভালো পদ্ধতি। যেসব কুপে গ্যাস উৎপাদন কমে গেছে বা বন্ধ হয়ে গেছে, সেখানে ওয়ার্কওভার করে গ্যাসের উৎপাদন বাড়ানো হয়। এতে কম খরচে দ্রুত গ্যাস পাওয়া যায়। ফলে গ্যাসের চাহিদা ও সরবরাহের বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকার একটি যথাযথ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে এক বছরে ৩৪টি কূপ ওয়ার্কওভার করা বেশ বড় কর্মযজ্ঞ। বাপেক্স এত বড় প্রোগ্রাম আগে কখনও করেছে বলে জানা নেই। সেক্ষেত্রে দক্ষ জনবল, প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিসহ সামগ্রিকভাবে প্রস্তুতি দরকার। কিন্তু এটা অসম্ভব নয়"-- বলেন তিনি।
এলএনজির দাম নিয়ে উদ্বেগ
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান রেজানুর রহমান বলেন, প্রতিনিয়ত দেশের গ্যাসের উৎপাদন কমছে। সেটা এলএনজি আমদানির মধ্য দিয়ে কাভার করা হচ্ছে। প্রতি ইউনিট (এমএমসিএফডি) এলএনজিতে দাম পড়ে ৭০ থেকে ৭১ টাকা। আর প্রতি এমএমসিএফডি দেশে উত্তোলিত গ্যাসের দাম পড়ে ৪ টাকা। এজন্য ব্লেন্ডেড প্রাইজ হয় ২৪ টাকার সামান্য বেশি।
তবে শিল্প ও বাণিজ্যখাতে ৩০.৫০ টাকা বা ৩১.৫০ টাকা দর নিয়ে পেট্রোবাংলা পায় কমবেশি ২২ টাকা। রেজানুর রহমান বলেন, এলএনজির দাম বাড়লে বিপদ বেশি। কারণ গত জুন মাসে প্রতি ইউনিটে পেট্রোবাংলার ঘাটতি ছিল ৯৮ পয়সা। ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে ঘাটতি প্রতি ইউনিটে সাড়ে ৬ টাকা হয়ে গেছে।
চাহিদা ও সরবরাহ
পেট্রোবাংলা ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মোট ৮৩ কার্গো এলএনজি আন্তর্জাতিক বাজার থেকে আমদানি করেছে। এরমধ্যে স্পট মার্কেট থেকে ২৬ কার্গো, এবং বাকি ৫৭ কার্গো দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায়– কাতার ও ওমান থেকে আমদানি করা হয়েছে। ২০১৮ সাল থেকে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় এলএনজি আমদানি করা হচ্ছে। আর স্পট মার্কেট থেকে আমদানি করা হচ্ছে ২০২০ সাল থেকে।
এরকম পরিস্থিতিতে বিশেষজ্ঞরা দেশের গ্যাস উত্তোলন বাড়ানোর পরামর্শ দিচ্ছেন। সরকারও সেরকম উদ্যোগ নিচ্ছে। যদিও সরকার গভীর সমুদ্র থেকে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করলেও— তাতে বৈশ্বিক কোনো সংস্থা অংশ নেয়নি।
পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ই জ্বালানি বিভাগ নতুন ও পুরানো মিলিয়ে— ২০২৫ থেকে ২০২৮ সালের মধ্যে সারাদেশে ১০০টি কূপ খননের পরিকল্পনা নিয়েছিল। এরমধ্যে ৬৯টি ছিলো নতুন কূপ খনন, আর ৩১টি ছিল ওয়ার্কওভার। এসব কূপ খনন ও ওয়ার্কওভার করা সম্ভব হলে— প্রায় ১৫০ কোটি ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে বলে আগের সরকার জানিয়েছিল।
সক্ষমতা বৃদ্ধি
গত ২২ জানুয়ারির বৈঠকে অনুসন্ধান কূপ থেকে গ্যাস পাওয়া গেলে তা দ্রুত জাতীয় গ্রিযে যুক্ত করার জন্য এক বা একাধিক পোর্টেবল প্রসেস প্ল্যান্ট কেনার প্রয়োজনীয়তা যাচাইয়ের নির্দেশ দিয়েছেন জ্বালানি উপদেষ্টা। পাশাপাশি বিদ্যমান যেসব প্রসেস প্ল্যান্ট রয়েছে, সেগুলো প্রয়োজনে স্থানান্তর করা যায় কিনা— সেটি পরীক্ষা করারও নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি।
নতুন প্রকল্প নেওয়ার ক্ষেত্রে তৃতীয় পক্ষ দিয়ে সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষা (ফিজিবিলিটি স্টাডি) সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে সময় কমিয়ে আনার জন্য কয়েকটি প্রকল্পে তা গুচ্ছ আকারে সম্পাদন করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এছাড়া, দেশের মধ্যে যেসব জায়গায় গ্যাসের বড় মজুদ পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে— সেসব অঞ্চলে অগ্রাধিকারভিত্তিতে অনুসন্ধান কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হবে।
এছাড়া বাপেক্সের কাছে বর্তমানে যেসব রিগ রয়েছে, সেগুলো ব্যবহার করে দেশীয় গ্যাসের বড় রিজার্ভ অনুসন্ধান করা হবে। বর্তমানে বাপেক্সের কাছে ৫টি রিগ রয়েছে। এছাড়া গভীর কূপখননের জন্য আরও দুটি রিগ কেনার কথা ভাবছে সরকার। এজন্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর থেকে ঋণ নেওয়ার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে ওই সভায়।
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান বলেন, একটি ২০ হর্সপাওয়ারের রিগ কেনা হবে। এর প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। আর একটি কেনা হবে ডিপ ড্রিলিংয়ের জন্য। এতে বাপেক্সের সক্ষমতা আরও বাড়বে। আরও বেশি কূপ খনন করা যাবে।
পেট্রোবাংলা সূত্র জানিয়েছে, ইতোমধ্যে ১৬টি গ্যাস কূপে ওয়ার্কওভার করা হয়েছে। এসব কূপ থেকে ১৮ কোটি ৪০ লাখ ঘনফুট গ্যাস পাওয়া গেছে। তবে জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে মাত্র ৭ কোটি ২০ লাখ ঘনফুট। কারণ ভোলার তিনটি গ্যাস কূপ থেকে গ্যাস সঞ্চালন লাইন না থাকায়— গ্যাস পাওয়ার পরেও জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করা যায়নি।
এই তিন কূপে ৬ কোটি ঘনফুট গ্যাস পাওয়া গেছে। এছাড়া সিলেট, বেগমগঞ্জ গ্যাস কূপের গ্যাস এখনও জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করা যায়নি। এসব কূপের গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।