ভ্যাট রিটার্নে ফেসবুক, গুগলের প্রকৃত উপার্জনের প্রতিফলন নেই
গুগল, ফেসবুক, অ্যামাজনসহ ডিজিটাল মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে বছরে অন্তত ২ হাজার কোটি টাকার বিজ্ঞাপন যায় বলে দীর্ঘদিন ধরেই অভিযোগ করছে সরকার। তবে তারা বাংলাদেশে নিবন্ধন ও ভ্যাট রিটার্ন দাখিলের পর ভিন্ন চিত্র দেখছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড।
সম্প্রতি বিদেশি কোম্পানি হিসাবে বাংলাদেশে ভ্যাট রিটার্ন জমা দিয়েছে বর্তমান সময়ের বৈশ্বিক জায়ান্ট প্রতিষ্ঠান গুগল, ফেসবুক ও অ্যামাজন। গুগল ও ফেসবুক দুই মাসের এবং অ্যামাজন এক মাসের রিটার্ন ও ভ্যাট জমা দিয়েছে এনবিআরে।
মঙ্গলবার জুলাই মাসের রেভিনিউয়ের বিপরীতে সরকারকে ২.৬৫ কোটি টাকা ভ্যাট দিয়েছে ফেসবুক। এনবিআর বলছে, ১৬.৬৭ কোটি টাকার রেভিনিউয়ের বিপরীতে এই ভ্যাট দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
এর আগে জুন মাসের জন্য ২.৪৪ কোটি টাকা ভ্যাট দেয় প্রতিষ্ঠানটি। ফেসবুকের ভ্যাট রিটার্ণের তথ্যানুযায়ী জুন মাস বাংলাদেশ থেকে তাদের আয় ১৬.২৭ কোটি টাকা।
এনবিরের কর্মকর্তারা বলছেন, ভ্যাট প্রদানের এ হারই অব্যাহত থাকলে ফেসবুক থেকে বছরে ৩০-৩২ কোটি টাকা পেতে পারে সরকার। আর রিটার্নে প্রদত্ত তথ্যানুসারে বছর শেষে রেভিনিউ হতে পারে ২০০-২২০ কোটি টাকা।
ঢাকা দক্ষিণ ভ্যাট কমিশনারেটের কমিশনার এস এম হুমায়ুন কবির বলেন, আগেও সরকার তাদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্নভাবে ভ্যাট পেত। ক্রেডিট কার্ডে বিলের বিপরীতে ব্যাংক এ ভ্যাট কেটে রাখত। তবে প্রত্যাশার তুলনায় প্রাপ্তির পরিমাণ কমই ছিল। এখন নিবন্ধনের আওতায় আসায় প্রক্রিয়াটি স্বচ্ছ হলো।
চলতি বছর নিবন্ধন নেওয়ার আগে গত বছরও সরকারি কোষাগারে ভ্যাট দিয়েছে ফেসবুক। ২০২০-২১ অর্থবছরে এইচটিটিপুলের মাধ্যমে ১৬ কোটি ১৭ লাখ টাকা ভ্যাট দেয় তারা । বিজ্ঞাপন, বুস্টিংসহ ও অন্যান্য খাত থেকে প্রাপ্ত এ আয়ের ওপর ১৫ শতাংশ হারে দিয়েছে তারা। ভ্যাটের সঙ্গে রেভিনিউয়ের হিসেব করলে ওই বছর কোম্পানিটির টার্নওভার হয় ১০৭ কোটি টাকা।
এনবিআর কর্মকর্তারা বলছেন, ফেসুবকের দেওয়া এ ভ্যাট এইচটিটিপুলের মাধ্যমে যেসব বিজ্ঞাপন ফেসবুক পেয়েছে শুধু তার হিসাব। এর বাইরে ব্যক্তি পর্যায়ে দেওয়া বিজ্ঞাপনের কিছু অর্থ হুন্ডি বা ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে হয়েছে, যার হিসাব এনবিআরের কাছে নেই।
যদিও বৈশ্বিক প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০২০ সালে ৮৬ বিলিয়ন ডলার রেডিনিউ দেখিয়েছে ফেসবুক।
গুগল অ্যামাজনের রেভিনিউ
ফেসবুকের সঙ্গেই গত মে মাসে বাংলাদেশে নিবন্ধন নেয় গুগল অ্যামাজন। এরপর দুই মাসের রিটার্নে ফেসবুকের চেয়েও অনেক কম রেভিনিউ দেখিয়েছে গুগল ও অ্যামাজন।
মে-জুন মাসে বিজ্ঞাপন, ক্লাউড সার্ভিসসহ বিভিন্ন সেবার বিপরীতে মাত্র ১৫.৩৫ কোটি টাকা রেভিনিউ দেখিয়েছে গুগল। আর ভ্যাট দিয়েছে ২.২৯ কোটি টাকা। অ্যামাজনের রেভিনিউ মাত্র ৩.৫২ কোটি টাকা। অর্থাৎ বছর শেষে এ দুটি প্রতিষ্ঠানের বাংলাদেশ থেকে রেভিনিউ হতে পারে যথাক্রমে ৯০-১০০ কোটি এবং ৪০ কোটি টাকার মতো।
উভয় কোম্পানির বৈশ্বিক রিপোর্ট বলছে, ২০২০ সালে গুগল বৈশ্বিকভাবে ১৮১ বিলিয়ন ডলার আয় করেছে। বিশ্বের প্রায় সব দেশ থেকে আয় করার পাশাপাশি সরাসরি অফিস রয়েছে ১৭টি দেশে। অন্যদিকে অ্যামাজনের বার্ষিক আয় ২১.৩ বিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশে মূল্য সংযোজন কর নিবন্ধন করেছে তিন বৃহৎ প্রযুক্তি কোম্পানি। গুগল, অ্যামাজনের পর সবশেষ যোগ দিয়েছে ফেসবুক। তাদেরকে করের আওতায় আনার ক্ষেত্রে এটিকে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে দেখছে কর্তৃপক্ষ ও প্রযুক্তি সংশ্লিষ্টরা।
সরকারের আগের তথ্য
বাংলাদেশে নিবন্ধন নিয়ে ভ্যাট রিটার্ন দাখিল শুরু করার আগে ডিজিটাল ফ্লাটফর্মে কত টাকার বিজ্ঞাপন চলে যায়, এমন একটি প্রাক্কলন করেছিল সরকার।
২০১৯ সালের এপ্রিলে ব্যারিস্টার হুমায়ুন কবির পল্লব উচ্চ আদালতে একটা রিট করেছিলেন। সেই রিটের প্রেক্ষিতে আদালতের নির্দেশে বিটিআরসি জানিয়েছিল, গত ৫ বছরে তিনটি বেসরকারি মোবাইল ফোন অপারেটর গ্রামীণফোন, রবি ও বাংলালিংক অনলাইন বিজ্ঞাপন বাবদ ৪৩৫ কোটি টাকা। বিজ্ঞাপন প্রচার বাবদ ফেসবুক, গুগল, ইউটিউব, ইমো, হোয়াটসঅ্যাপ এই অর্থ আদায় করেছে।
মোবাইল কোম্পানিগুলোর বাইরে বিভিন্ন ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিখাত থেকে বিপুল পরিমাণ টাকাও ডিজিটাল বিজ্ঞাপন বাবদ ব্যয় হতো বলে ধারণা করেছে এনবিআর। আর টেলিভিশন মালিকদের সংগঠন অ্যাটকো এবং বিজ্ঞাপনী সংস্থাগুলো এটিকে ২-৩ হাজার কোটি টাকা বলে দাবি করে আসছিল।
বাংলাদেশের একটি আন্তর্জাতিক বিজ্ঞাপনী সংস্থার প্রধান পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, 'আমরা কিছু খোঁজ খবর রাখার চেষ্টা করি। সুনির্দিষ্ট করে তো বলা যাবে না, তবে এই বাজারটা তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার।'
অবৈধ পথে বিজ্ঞাপন বন্ধ হয়েছে?
গুগল, ফেসবুক বা অ্যামাজান ভ্যাট রেজিস্ট্রেশনের পর সব বিজ্ঞাপন বৈধ পথে যাচ্ছে কি না, এমন প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন এনবিআরের ভ্যাট নিরীক্ষা ও গোয়েন্দা বিভাগের মহাপরিচালক ড. মইনুল খান।
তিনি বলেন, 'এখন সব বিজ্ঞাপন বৈধ পথে যাচ্ছে, সেটা বলা যাবে না। তবে প্রক্রিয়াটা তো শুরু হলো। আমাদের কাছে এখন পরিষ্কার একটা ধারণা থাকবে। সেগুলো বিশ্লেষণ করে আমরা পরবর্তী পদক্ষেপগুলো নিতে পারব। যারা দেশ থেকে বিজ্ঞাপন দেয়, তাদের সঙ্গে এসব প্রতিষ্ঠানের হিসাব মিলিয়ে দেখতে পারব।'
'সরকার এখন থেকে সঠিক হিসাব পাবে'
ভ্যাট আদায়ের পাশাপাশি কোম্পানিগুলোর আয়ের সঠিক হিসাব পাওয়াকে বড় করে দেখছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।
বেসিসের প্রেসিডেন্ট সৈয়দ আলমাস কবীর বলেন, 'এতদিন তো সরকার কোনো টাকাই পেত না। এখন অন্তত একটা হিসাব তো এনবিআর করতে পারবে? আস্তে আস্তে অবৈধ পথগুলো বন্ধ হবে। ভ্যাট নিবন্ধন নেওয়া এবং রিটার্ন দেওয়ায় বিষয়টা একধাপ এগোলো। এরপর অফিস করার জন্যও তাদের চাপ দেওয়া যাবে। এই কাজগুলো করতে গেলে এনবিআরের হাতে কিছু তথ্য-উপাত্ত তো থাকতে হবে। সেই তথ্য-উপাত্ত পাওয়ার পথ প্রশস্ত হলো।'
একই কথা বলছেন এনবিআরের কর্মকর্তা এস এম হুমায়ুন কবির। তিনি বলেন, 'তারা নিবন্ধন নেওয়ার ফলে এখন থেকে তাদের সেবা প্রদানের মাধ্যমে আয়-ব্যয় কিংবা প্রকৃত ভ্যাট দিচ্ছে কি না, তা যাচাই করার সুযোগ তৈরি হয়েছে। সার্বিকভাবে প্রতিষ্ঠানগুলো দেশে সেবা প্রদানের বিপরীতে হিসাব নিকাশের ক্ষেত্রে আরো বেশি কমপ্লায়েন্ট হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে এবং এর মাধ্যমে সরকারের বেশ ভালো অংকের রাজস্ব আয়ের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।'