মহামারি মোকাবিলা করেও প্রাচীন যে বাণিজ্য চাঙ্গা আছে
মশলার বাণিজ্য হাজার হাজার বছর ধরে বিশ্বব্যাপী চলছে- তবে চলমান বিশ্বমারি এটিকে প্রায় এক স্থবিরতায় নিয়ে এসেছিল। দেশে দেশে যখন প্রথম লকডাউন ঘোষণা করা হয় তখন পণ্যটি উৎপাদন, পরিবহন আর প্রক্রিয়াকরণের নেটওয়ার্ক এক বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্যে পড়ে।
এই অবস্থায় কে করবে শস্যের চাষ? প্রক্রিয়াকরণ কারখানায় বা কে কাজ করবে? কীভাবেই বা দেশ-বিদেশের ভোক্তার দ্বারে মশলা পৌঁছে দিতে কেইবা তা বন্দর পর্যন্ত পরিবহন করবে?- এমন অজস্র জটিলতা দেখা দেয়।
তবে মহামারির সময়েই বিশ্বব্যাপী মশলার চাহিদা বাড়তে থাকে। দীর্ঘ সময় ঘরে অবস্থানের প্রস্তুতি নিতে অনেক ভোক্তাই দারুচিনি, লবঙ্গ, কালো এলাচের মতো মশলা কিনে মজুত করেন। আবার ওষুধি গুণের জন্য সমাদৃত যেমন; আদা ও হলুদের বিক্রিও বেড়ে যায় ভোক্তাদের আরও বেশি স্বাস্থ্য সচেতন হয়ে ওঠার উদ্যোগে।
এসব বিষয় বিশ্বের সবচেয়ে বড় মশলা উৎপাদক ও ভোক্তা ভারতেই বেশি লক্ষ্য করা যায়। মার্চেই লকডাউনের আওতায় আসে দেশটি। ফলে পরিযায়ি শ্রমিক নির্ভর মশলা চাষি ও প্রক্রিয়াকরণ কারখানা মালিকেরা সরবরাহ চক্র ঠিক রাখতে শ্রম সঙ্কটের মধ্যে পড়েন। এই অবস্থায় স্থানীয় রন্ধনশৈলীর গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ মশলার দর সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে রাখতে রপ্তানি বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয় ভারত। আরেক বৃহৎ উৎপাদক ভিয়েতনামও একই পথে হাঁটে।
অবশ্য তাতে তৈরি হয় হিতে-বিপরীত অবস্থা। স্থানীয় বাজারে মশলার সরবরাহ বেড়ে যায় আর বন্দরে জমে যায় মশলার স্তূপ। ফলে ভারতে এলাচের দাম ৫০ শতাংশ কমে। ভিয়েতনামে গোলমরিচের দাম কমে ১০ শতাংশ। তবে এটা ছিল সাময়িক বিপত্তি। অচিরেই আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সক্রিয় হয়ে ওঠায় মশলার বাণিজ্য আগের অবস্থায় ফিরে আসে এবং তারপর থেকে আরও চাঙ্গা হয়ে ওঠে।
মহামারি মোকাবিলার এমন ক্ষমতা বিশ্ববাজারের খুব কম প্রচলিত পণ্যের ক্ষেত্রেই দেখা গেছে।
ভারতীয় মশলার চাহিদার কদর আছে বিশ্ববাজারে। দেশটির মশলা উৎপাদনের ইতিহাস অনেক সমৃদ্ধ, পাশাপাশি অনুকূল জলবায়ু ও ভূপ্রকৃতির সংযোগ তো আছেই। সবমিলিয়ে সুতীব্র গন্ধের শস্যটি উৎপাদনের এক উপযুক্ত পরিবেশ।
মহামারির মধ্যে চলতি বছরের জুন নাগাদ ২০১৯ সালের একই সময়ের তুলনায় ভারতের মশলা রপ্তানি ৬৭ মিলিয়ন ডলার বেড়ে ৩৫৯ মিলিয়নে উন্নীত হয়। অ্যাসোসিয়েটেড চেম্বার্স অব কমার্স অব ইন্ডিয়া এই তথ্য জানিয়েছে।
ভারতের লাখো মশলা চাষির জন্য এমন অবস্থা সুখবরের মতোই শোনায়। তবে কৃষক পর্যায়ে উচ্চমূল্যের সুবিধা নেই বলে অভিযোগ করেন মশলা উৎপাদক সমবায় ভিত্তিক জোট- স্পাইস ট্রেড অ্যালায়েন্স অব কেরালার প্রতিষ্ঠাতা টমি ম্যাথিউ।
বেশিরভাগ মশলা চাষির উপর ভারতে জারি করা লকডাউনের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। কমেছে তাদের চাষাবাদের পুঁজি। এদের অনেকেরই আত্মীয়-স্বজন শহরে চাকরি হারিয়ে গ্রামে ফিরে এসেছেন। মূলত, অপ্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতিতে ধ্বস নামার কারণেই এমন অবস্থা তৈরি হয়।
''মশলা চাষিদের এখন আরও বেশি মানুষের অন্ন্যের সন্ধান করতে হচ্ছে, তাছাড়া শহরে চাকুরে আত্মীয়রা যে বাড়তি দুপয়সা পাঠাতেন- সেই পথও এখন বন্ধ হয়ে গেছে। তাই আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দর বৃদ্ধির সুবিধা যদি কৃষকের ঘরে পৌঁছে তাহলে খুবই ভালো হবে। বাণিজ্য সমতার প্রয়োজন মহামারির সঙ্কট অন্য যেকোনো সময়ের চাইতে বেশি স্পষ্ট করেই তুলে ধরেছে,'' ম্যাথিউ বলছিলেন।
অন্যদের জন্য অবশ্য মশলার বাণিজ্য মহামারির ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার পক্ষেই সহায়ক হয়।
ভারতের অন্যতম বড় মশলা গুড়ো প্রক্রিয়াকরণ শিল্প প্রতিষ্ঠান সিনহাইট ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ভিজু জ্যাকব বলেন, ''আমাদের বাজারজাত মশলার চাহিদা এপ্রিল ও মে মাসে ১৫ শতাংশ বাড়ে। ঈশ্বরকে শত শত ধন্যবাদ যে এই মুহূর্তে আমরা সঠিক ব্যবসায়ের সঠিক অবস্থানে আছি। সরবরাহ চক্রের অন্যরা কষ্ট করছেন একথাও অস্বীকার করার উপায় নেই।''
ভারতের অধিকাংশ মশলা উৎপাদন করে ক্ষুদ্র চাষি পরিবারগুলো। উত্তর প্রদেশের শুকনো মরিচ উৎপাদক থেকে কেরালার এলাচ উৎপাদক ১০ হাজার চাষির কাছ থেকে মশলা কেনে সিনহাইট।
বিক্রির উদ্দেশ্যে সিনহাইটের স্থানীয় প্রক্রিয়াকরণ কারখানায় শস্য নিয়ে হাজির হন চাষিরা। এরপর তার মান যাচাই করে, প্রক্রিয়াকরণের পর প্যাকেটজাত করে দেশ-বিদেশে পাঠানো হয়।
ভিজু জানান, ''মহামারির কারণে প্রচলিত এই সরবরাহ ব্যবস্থায় বিঘ্ন ঘটে। ভারতের কিছু অঞ্চলে এখনও করোনাভাইরাস জনিত নিষেধাজ্ঞা থাকায় পরিবহন একটি বড় সমস্যা। এবং সেই খরচও চাষিদের লাভের ভাগ কমিয়েছে। কারখানা পর্যায়েও বাড়তি ব্যয়ের খাতা খুলেছে।''
তার দাবি, ''এখনও আমরা বন্দর পর্যন্ত পণ্য পৌঁছাতে সমস্যার মুখে পড়ছি। কিছুদিন আগে কলম্বোগামী একটি জাহাজে মশলার চালান বোঝাই করা পিছিয়ে যায়। আমরা চাষিদের মতো সঙ্কটে নেই ঠিকই, কিন্তু ব্যবসা পরিচালনায় নানাবিধ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে।''
তবে ধীরে বাধা-বিপত্তি কেটে যাওয়ার লক্ষ্মণ দেখা যাচ্ছে বলেও স্বীকার করেন ভিজু। মশলার যোগান ঠিক রাখতে ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়া থেকে হলুদ ও গোলমরিচ আমদানি করছে সিনহাইট। পাশাপাশি বাড়িয়েছে স্থানীয় চাষিদের সংখ্যা।
- সূত্র: বিবিসি ফিউচার