লকডাউনে অনিশ্চিত ঈদের বিকিকিনি, স্থবির খাতুনগঞ্জের মসলার বাজার
ঈদুল আজহার বাকি আর ১৩ দিন। পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে এখন মসলাপণ্য ব্যবসার ভর মৌসুম। কিন্তু করোনায় দেশব্যাপী লকডাউনের কারণে অনেকটা ক্রেতা শূন্য খাতুনগঞ্জ। ফলে আমদানি ও সরবরাহ বৃদ্ধি করলেও স্থবির হয়ে আছে ঈদুল আজহাকে ঘিরে বিকিকিনি হওয়া মসলার বাজার।
খাতুনগঞ্জের মসলা ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, আসন্ন কোরবানির ঈদকে কেন্দ্র করে দেশি-বিদেশি সব মসলার সরবরাহ বৃদ্ধি করেছে ব্যবসায়ীরা। আশা করছিল অন্যান্য বছরের ন্যায় কোরবানিকে ঘিরে মসলার ব্যবসা হবে এবারও। কিন্তু দেশব্যাপী চলমান লকডাউনে তাদের সেই আশায় গুঁড়ে বালি। মসলার দাম বৃদ্ধি তো দূরের কথা। বিকিকিনি না হওয়ায় উল্টো অনেক পণ্যের দাম কমেছে। এমনকি বাকি কয়েকটি দিনেও বিকিকিনি বাড়বে কি না তা নিয়ে শঙ্কায় আছেন এই খাতের ব্যবসায়ীরা।
খাতুনগঞ্জের কাঁচা মসলাপণ্য (পেঁয়াজ, রসুন ও আদা) ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে বাজারে পাইকারি পর্যায়ে প্রতিকেজি আদার দাম কমেছে কমপক্ষে ৪০-৭০ টাকা। বিকিকিনি কম থাকলেও কোরবানিকে ঘিরে সরবরাহ বৃদ্ধি পাওয়ায় আদার অস্বাভাবিক দরপতন হয়েছে। তবে এই সময়ের মধ্যে পেঁয়াজ ও রসুনের দাম কিছুটা ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে।
গত মঙ্গলবার খাতুনগঞ্জে পাইকারিতে প্রতিকেজি চীনা আদা বিক্রি হয়েছে ১২০-১৩০ টাকা দামে। যা গত সপ্তাহে ১৯০-২০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। একইভাবে গত সপ্তাহে ভারতীয় ক্যারেলা আদার দাম ছিল কেজিপ্রতি ১৩০-১৪০ টাকা। যা বর্তমানে ৯০-৯৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
কেজিতে ২-৩ টাকা বেড়ে বর্তমানে বাজারে মানভেদে প্রতিকেজি ভারতীয় পেঁয়াজ ৩০-৪০ টাকা, মিয়ানমারের ২৫-৩৪ টাকা এবং দেশি পেঁয়াজ ৪২-৪৫ টাকা দামে বিক্রি হচ্ছে। গত সপ্তাহে ভারতীয় পেঁয়াজ ২৮-৩৮ টাকা, মিয়ানমারের ২০-৩০ টাকা এবং দেশি পেঁয়াজ ৪০-৪২ টাকার মধ্যে বিক্রি হয়েছে।
একইভাবে কেজিতে ৫ টাকা বেড়ে বর্তমানে বাজারে প্রতিকেজি চীনা রসুন ১০০-১১০ টাকা এবং দেশি রসুন ৪৫-৬০ টাকার মধ্যে বিক্রি হচ্ছে। গত সপ্তাহে চীনা রসুন ১০০-১০৫ টাকা এবং দেশি রসুন ৪০-৫৫ টাকার মধ্যে বিক্রি হয়েছে।
খাতুনগঞ্জের কাঁচা মসলা পণ্যের (পেঁয়াজ, রসুন ও আদা) পাইকারি জোন হামিদুল্লাহ মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. ইদ্রিচ মিয়া বলেন, "কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে যেই বিকিকিনি হওয়ার কথা ছিল তা হচ্ছে না। বিভিন্ন জেলা-উপজেলা থেকে ক্রেতারা বাজারে আসছে না। ফলে যেসব পণ্যের বাড়তি সরবরাহ হয়েছে সেইসব পণ্যের দাম কমে যাচ্ছে। এরমধ্যে কাঁচা এবং পচনশীল পণ্য হিসেবে গত দুই সপ্তাহে আদার দাম কমেছে কেজিতে ৭০ টাকা পর্যন্ত। এটা খুবই অস্বাভাবিক। এভাবে চললে এবারে ব্যবসায়ীদের বড় লোকসান হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে"।
সরবরাহের চেয়ে বিকিকিনি কম হওয়ায় শুকনো মসলা পণ্যের মধ্যে গোল মরিচ, দারুচিনি এবং তেজপাতা ছাড়া বেশিরভাগ পণ্যের দাম নিম্নমুখী। স্থির রয়েছে কয়েকটি পণ্যের দাম।
গত এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে খাতুনগঞ্জে নিম্নমুখী রয়েছে মসলা পণ্য মরিচ, হলুদ, ধনিয়া, এলাচ, লং ও জায়ফলের বাজার।
এসব পণ্যের মধ্যে কেজিতে ২৫ টাকা পর্যন্ত কমে বর্তমানে ভারতীয় শুকনা মরিচ ১৭০ টাকা এবং দেশি ৯৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কেজিতে ১০-১৫ টাকা পর্যন্ত কমে বর্তমানে প্রতিকেজি দেশি হলুদ ৯০ টাকা এবং ভারতীয় হলুদ ১০৫ দামে বিক্রি হচ্ছে। একই সময়ে কেজিতে ১০ টাকা কমে বর্তমানে প্রতিকেজি ধনিয়া বিক্রি হচ্ছে ৯০ টাকা দরে।
আমদানিকৃত শুকনা মসলা পণ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দাম কমেছে লং এর। গত এক সপ্তাহে প্রতিকেজিতে ১৪০ টাকা কমে বর্তমানে লং বিক্রি হচ্ছে ৯৪০ টাকায়। একই সময়ে কেজিতে ৮০ টাকা পর্যন্ত কমে বর্তমানে প্রতিকেজি জায়ফল বিক্রি হচ্ছে ৬০০-৬২০ টাকা দরে। দীর্ঘদিন স্থির থাকলেও গত একসপ্তাহে ৫০ টাকা পর্যন্ত কমেছে এলাচের দাম। বর্তমানে বাজারে গুয়েতেমালা থেকে আমদানিকৃত প্রতিকেজি এলাচ ১,৯৮০-২,০০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
তবে দীর্ঘদিন ধরে স্থির থেকে বর্তমানে প্রতিকেজি ভারতীয় জিরা ২৬৫-২৭০ টাকা এবং জত্রিক ২৩০০-২৩৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
এদিকে গত এক সপ্তাহ ধরে কিছুটা ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে গোলমরিচ, দারুচিনি ও তেজপাতার দাম। এরমধ্যে কেজিতে ৩০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে বর্তমানে প্রতিকেজি গোলমরিচ ৫১০ টাকা, ১৫ টাকা বেড়ে দারুচিনি ৩১৫ টাকা এবং তেজপাতা ৭০ টাকা দামে বিক্রি হচ্ছে।
চট্টগ্রাম বন্দরের তথ্যমতে, কোরবানির ঈদকে কেন্দ্র করে প্রতিবছর প্রায় ৫০ হাজার টন মসলা আমদানি হয়। যার আমদানি মূল্য ৬০০-৭০০ কোটি টাকা। মসলা পণ্যের মধ্যে ধনিয়া ছাড়া বাকি সব পণ্য কম-বেশি বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়।
খাতুনগঞ্জের মসলা ব্যবসায়ী ও মেসার্স নাজিম এন্ড বাদার্সের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন বলেন, "কোরবানির ঈদকে ঘিরে বছরের অন্যান্য সময়ের তুলনায় এই সময়ে বাড়তি মসলা আমদানি করে এই খাতের ব্যবসায়ীরা। ফলে স্বাভাবিক সময়ে কোরবানির ঈদের দুই-তিন সপ্তাহ আগে থেকে মসলা পণ্যের বিকিকিনি শুরু হয়। কিন্তু করোনার কারণে দেশব্যাপী লকডাউন চলায় এবারে বাজারের চিত্র সম্পূর্ণ উল্টো। গত কয়েকদিনে বাজারে জেলা-উপজেলার পাইকার ও ছোট ব্যবসায়ীরা মসলা কিনতে আসে নি বললেই চলে। ফলে বিকিকিনি না থাকায় বাজারে বেশিরভাগ মসলা পণ্যের দাম নিম্নমুখী কিংবা স্থির রয়েছে"।
খাতুনগঞ্জের মসলা আমদানিকারক অসীম সাহা বলেন, "প্রতিবছরের ন্যায় এবারেও কোরবানিকে ঘিরে মসলার আমদানি বাড়িয়েছে ব্যবসায়ীরা। কিন্তু সেই হারে বাজারে ক্রেতা নেই। ফলে আমদানিকারক ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের গুদামে স্তুপ হয়ে আছে মসলা পণ্য। এতে এবারে মসলা আমদানিকারকদের বড় লোকসান হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে"।