মার্কিন আর্থিক সাম্রাজ্যের উত্থান ও পতন
২০২০ সালে যদি কিছু প্রমাণ হয়, তাহলে সেটা হলো বৈশ্বিক অর্থনীতিতে মার্কিন ডলারের কেন্দ্রীয় ভূমিকা। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক এবং কৌশলগত নিয়ন্ত্রণ হ্রাস পাওয়া সত্ত্বেও, ডলার ধারণার চাইতেও বেশি টেকসই মুদ্রা হিসেবে আরও একবার নিজ গুরুত্বের জানান দিয়েছে। সঙ্গে ইঙ্গিত দেয় যুক্তরাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত আর্থিক ব্যবস্থা আরও দীর্ঘদিন থাকার দিকেও। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক- ফেডারেল রিজার্ভের ডলার ভিত্তিক আর্থিক ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার সহযোগী পদক্ষেপ নিয়ে আশাবাদী হওয়া গেলেও আসন্ন আগামী নিয়ে শঙ্কিত ও হতাশ হওয়ার অনেক কারণও উঁকি দিচ্ছে।
প্রধান কারণ হয়তো রাশিয়া এবং চীন। প্রভাবশালী দেশ দুটি ডলার ভিত্তিক আন্তর্জাতিক লেনদেনের আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে বিকল্প বিনিময় ব্যবস্থা চালু করতে চায়। আর ইউরোপে প্রাধান্য পাচ্ছে আর্থিকভাবে স্বতন্ত্র ও স্বনির্ভর থাকার কৌশলগত মন্ত্র। সবকিছু এমন সময় হয়েছে, যখন ওয়াশিংটনের আগ্রাসী অর্থনৈতিক বিধি-নিষেধ এবং ট্রাম্প প্রশাসনের অনিশ্চিত আচরণ আস্থা কমিয়েছে মার্কিন মুদ্রায়। ঘটনাগুলো তাই অপ্রত্যাশিত বলা যায় না। বরং, তা যেন ডলারকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করারই পাল্টা প্রতিক্রিয়া।
২০২০-এর দশকে ডলারের আধিপত্য আমেরিকার জন্য একাধারে অনুমোদিত আশীর্বাদ, বৈষম্য এবং শিল্পকেন্দ্র যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে স্থানান্তর হয়ে উচ্চমানের চাকরি সংখ্যা কমানোর কারণ রূপে দেখা দেয়। তাই ডলারের শক্তিশালী বিনিময় হার এবং ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা বিপরীতমুখী ঘটনা নয়, বরং ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। একের কারণেই অপরটির মাত্রা বাড়ে।
ট্রাম্প ডলারের মান কমিয়ে চাকরির বাজার ও উৎপাদন খাত শক্তিশালী করতে আগ্রহী ছিলেন। হয়তো একারণেই, বিশ্বের সর্ববৃহৎ ও দূরদর্শী হেজ ফান্ড রে অ্যান্ড ডেলিও বিনিয়োগকারীদের ডলার পরবর্তী ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানায়। প্রতিষ্ঠানটি এজন্য উপযুক্ত মনে করছে চীনা আর্থিক ব্যবস্থাকে। তাদের ব্যাখ্যায়, এইধারা ব্যতিক্রম নয় বরং বিগত ৫শ' বছরে বহুবার এভাবে শক্তিশালী আর্থিক সাম্রাজ্যের পতনের মধ্য দিয়ে নতুনের জন্ম হয়েছে।
কিন্তু, ইতিহাসের শিক্ষা কী এই মুহূর্তে অলঙ্ঘনীয়। এক শতাব্দির বেশি সময় বিশ্ব অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি মার্কিন ডলার। । এই সময়ে পৃথিবী দেখেছে বৃহত্তম জনসংখ্যা বিস্ফোরণ, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের নাটকীয় গতি, রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রের সংঘর্ষের ভয়ঙ্কর সব পরিণতি। মানবজাতির ইতিহাসে নজিরবিহীন প্রতিটি ঘটনাবলী ছিল যেকোন মুদ্রা ব্যবস্থায় ধ্বস নামানোর পক্ষে যথেষ্ট। তাই প্রকৃত অর্থনীতি এবং আন্তর্জাতিক শক্তি ভরকেন্দ্র অদল-বদলের সূচকে ডলার প্রভাবিত একটি মুদ্রাব্যবস্থা খুব জোর দিয়ে এমন দাবি করা যায় না।
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রণীত কৌশলগত অবস্থান আর মুদ্রানীতির আলোকে অবশ্যই ডলার প্রভাবিত হয়েছে, কিন্তু তেমন সময় দীর্ঘস্থায়ী ছিল না। বরং, বিপরীত ঘটনাই দেখা গেছে বেশি। তাই হাল আমলের গতিপ্রকৃতি সবচেয়ে প্রবল প্রভাব ফেলবে এমন নিশ্চয়তা কী আদৌ দেওয়া সম্ভব? ডলারের ইতিহাস সঙ্কট পাড়ি দেওয়ার ইতিহাস। আর আজ নয়, অর্ধ-শতাব্দী আগে ১৯৭০ এর দশকে প্রথমবার ডলারের নিয়ন্ত্রণ হ্রাস পাওয়ার প্রসঙ্গ জোরেশোরেই উঠেছিল। অথচ তারপরও ডলার বিশ্বকে একক ক্ষমতায় শাসন করে গেছে।
প্রতিকূল দশায় ডলারের ব্যবস্থাপনা শক্তি অসামান্য। মার্কিন ব্যবসা সমূহের লেনদেন আর নীতিনির্ধারকদের প্রণোদনায় পৃথিবীময় ডলারের উপস্থিতি। তাই বলা যায়, দুনিয়ার প্রধানতম এই মুদ্রার ভবিষ্যৎ জানতে অবশ্যই আমাদের অতীতের দিকে, ইতিহাসের পরিক্রমায় চোখ রাখতে হবে। তবে ইতিহাসকে আইনের মতো অলঙ্ঘনীয় চক্র মানাটা হয়তো এক্ষেত্রে উচিৎ হবে না।
আমাদের পৃথিবী অনেক জটিল, অনুঘটকগুলোও পরিবর্তনশীল আর চরম প্রতিক্রিয়াশীল। ডলারের ইতিহাস আবিষ্কার, মহাযুদ্ধের ধবংস ক্ষমতা, বিশ্বযুদ্ধের প্রচণ্ডতা আর ইউরোপীয় শক্তিগুলোর আমেরিকার সাহায্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে ওঠার গল্প। যে গল্পে ডলার আবির্ভূত হয়েছিল ত্রাতার ভূমিকায়। এই ইতিহাস ক্ষমতার লড়াই আর অর্থের প্রতিপত্তির। যার আলোকে নিশ্চিত ভবিষ্যৎ বাণী দেওয়ার সময় এখনও আসেনি। মুদ্রাটি এখনও সমানতালেই প্রাসঙ্গিক। দাবার বোর্ডে শেষদানের পালা এখনও বাকি।
- সূত্র: ফরেন পলিসি