সার্টিফিকেট দেওয়া গেলে খাদ্যপণ্য রপ্তানি ১০ গুণ বাড়বে
একটি আন্তর্জাতিক মানের ল্যাব প্রতিষ্ঠা করে ক্রেতা দেশগুলোর চাহিদা অনুযায়ী পরীক্ষা করে 'ফিট ফর হিউম্যান কনসাম্পশন' সার্টিফিকেট দেওয়া গেলে কৃষিজাত ও খাদ্যপণ্য রপ্তানি ১০ গুণ বেড়ে বাংলাদেশ প্রতি বছর ১৩ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে পারে।
বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের এক প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়েছে।
তবে এ ধরনের সার্টিফিকেট দেওয়ার মতো কোনো প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে নেই। এমনকি কোন দেশের জন্য কী ধরনের মান নিশ্চিত করে পণ্য রপ্তানি করতে হয়, সে তথ্যও নেই সরকারের কোনো সংস্থার কাছে।
আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিত করে সার্টিফিকেট ইস্যু করার মতো এক্রিডেটেড ল্যাবও দেশে নেই। সঠিকভাবে মান নির্ধারণ ছাড়া রপ্তানির কারণে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ও ভারি ধাতুর উপস্থিতির পেয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন পান, রাশিয়া আলু, চীন কাঁকড়া ও কুচিয়া এবং খাদ্যে শুকরের হাড় ও মুরগির বিষ্ঠার উপস্থিতির কারণে সৌদি আরব মিঠা পানির মাছ আমদানি বন্ধ রেখেছে।
ফলে সবজি, মাছসহ বিভিন্ন কৃষি ও খাদ্যপণ্য উৎপাদনে শীর্ষ দেশগুলোর কাতারে থাকলেও এসব পণ্য রপ্তানিতে বাংলাদেশ তলানিতে পড়ে থাকা একটি দেশ। বছরে প্রায় ১৬০০ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি বাজারে বাংলাদেশের অংশ মাত্র ০.০৬ শতাংশ।
বাংলাদেশের কৃষিজাত ও খাদ্যপণ্যের দ্বিতীয় বৃহত্তম ক্রেতা সৌদি আরব আগামী জুলাই থেকে এসব পণ্য আমদানিতে নতুন শর্তারোপ করতে যাচ্ছে। মানসম্পন্ন ল্যাবের অভাব ও তাদের নতুন শর্তানুযায়ী সার্টিফিকেট ইস্যু করতে না পারলে সেখানে রপ্তানি ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। গত দুই অর্থবছরে সৌদি আরবে কৃষিজাত ও খাদ্যপণ্য রপ্তানির পরিমাণ যথাক্রমে ১৬৩ ও ১৪৬ মিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশে কৃষিপণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে সনদ দেয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, মাছ রপ্তানিতে মৎস্য অধিদপ্তর, মাংস ও পশুজাত পণ্য রপ্তানিতে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর। মধ্যপ্রাচ্যে পণ্য রপ্তানিতে হালাল সার্টিফিকেট ইস্যু করে ইসলামিক ফাউন্ডেশন ও উৎপাদন পর্যায়ে ১৮১টি পণ্যের বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী সনদ দেয় বিএসটিআই। এসব প্রতিষ্ঠানের কারও ক্রেতা রাষ্ট্রগুলোর নির্ধারিত প্যারামিটার অনুযায়ী 'ফিট ফর হিউম্যান কনসাম্পশন' সার্টিফিকেট ইস্যুর সক্ষমতা নেই।
এ অবস্থায় রপ্তানির বিশাল সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর পাশাপাশি দেশে কৃষিপণ্যের অপচয় রোধ ও ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন এক্রিডেটেড ল্যাব স্থাপনসহ মান নির্ধারণী বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি একক 'হেলথ সার্টিফিকেশন অথরিটি' প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করেছে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন।
স্বাস্থ্য সনদ বিষয়ক মতামত প্রণয়ন কমিটির আহ্বায়ক এবং বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের সদস্য আবদুল বারী বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হেলথ সার্টিফিকেশন ইস্যুর মাধ্যমে কিভাবে কৃষিজাত ও খাদ্যপণ্য রপ্তানি বাড়ানো সম্ভব, সে বিষয়ে সুপারিশসহ একটি প্রতিবেদন আমরা মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছি। ভারতের এক্সপোর্ট প্রমোশন কাউন্সিল এ ধরনের সনদ ইস্যু করে, যা বিভিন্ন দেশ গ্রহণ করে।'
গত সপ্তাহে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া প্রতিবেদনে ট্যারিফ কমিশন বলেছে, বাংলাদেশ কৃষিজাত ও খাদ্যপণ্যের মান নিশ্চিত করা ও আমদানিকারক দেশগুলোর কাছে গ্রহণযোগ্য হেলথ সার্টিফিকেশন ইস্যুর মাধ্যমে বিশ্ববাজারের মাত্র আধা শতাংশ (০.৫%) দখল করা গেলে এ জাতীয় রপ্তানি প্রায় ১০ গুণ বৃদ্ধি পাবে।
গত তিন অর্থবছরে বাংলাদেশ গড়ে ১.৩০ বিলিয়ন ডলারের কৃষি ও খাদ্যপণ্য রপ্তানি করেছে। বর্তমানে ১৩০টি দেশে এসব পণ্য রপ্তানি হয়। কৃষিজাত ও খাদ্যপণ্যের মধ্যে বাংলাদেশ মূলত ক্রাসটাসিনস, চিংড়ি, কাঁকড়া, হিমায়িত মাছ, শুটকি মাছ, শাক-সবজি, ফলমূল, এরোমেটিক রাইস, গুড়া মশলা, শুকনা খাবার, ফলের জুস, চা, সয়াবিন ও সরিষার তেল, গুড়, তিল রপ্তানি করে থাকে।
হেলথ সার্টিফিকেট দেওয়ার সক্ষমতা নেই বাংলাদেশের
আমদানিকারক দেশগুলোর পণ্যমান সম্পর্কিত যে প্যারামিটার নির্ধারণ করে থাকে, তার হালনাগাদ কোনো তথ্য নেই বাংলাদেশের কাছে। এজন্য প্রয়োজনীয় আন্তর্জাতিক মানের এক্রিডিটেড ল্যাবও দেশে নেই বলে ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
অনেক দেশ পণ্যের দুই পর্যায়ের প্রাতিষ্ঠানিক সার্টিফিকেশন চায়। এক প্রতিষ্ঠান দেবে মান পরীক্ষার সার্টিফিকেট, আরেক প্রতিষ্ঠান স্বাস্থ্য সার্টিফিকেট। কিন্তু দেশে এ ধরনের কোনো ব্যবস্থা নেই।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ থেকে কৃষিজাত ও খাদ্যপণ্য আমদানিতে দেশভিত্তিক পণ্যমাণ কী, তার কোনো তথ্য সরকারের কাছে নেই। সরকারের কোনো সংস্থা থেকে এ ধরনের সার্টিফিকেশন দেওয়ার ব্যবস্থা না থাকায় কৃষি ও খাদ্যপণ্য রপ্তানিতে স্কয়ার ও প্রাণ গ্রুপ নিজেদের প্যাডে নিজেরাই 'ফিট ফর হিউম্যান কনজাম্পশন' ঘোষণা দিয়ে দেয়।
বিএসটিআইসহ বাংলাদেশের যেসব সংস্থা বিভিন্ন পণ্যের সনদ দেয়, রপ্তানিকারকদের চাহিদা অনুযায়ী খাদ্যপণ্যের বিভিন্ন প্যারামিটার পরীক্ষার সক্ষমতা তাদের নেই।
ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঘি, লাচ্ছি, রসমালাই, মিষ্টি, কালোজাম, ছানা, গরুর লেজের লোম, বুলিস্টিক, হাঁসের পালক, গরু-মহিষের কান, ওমাসাম, জিলেটিন, একদিনের মুরগির বাচ্চা, গরু ও হাঁস-মুরগির মাংস, ফ্রোজেন চিকেন প্রোডাক্টসের রপ্তানি সনদ দিতে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর ১৮-২১ দিন সময় নেয়। মৎস্য অধিদপ্তর দুই-তিন দিনের মধ্যে হিমায়িত মাছের সনদ দিতে পারলেও সনদের মেয়াদ থাকে ১৫ দিন।
বিএসটিআই এখন পর্যন্ত ১৮১টি পণ্যের উৎপাদন পর্যায়ে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডের সার্টিফিকেট দেয়। এসব পণ্যের মান সনদ পেতে ১০-১২ দিন সময় লাগে। বিএসটিআইয়ের সনদ বিভিন্ন দেশ গ্রহণও করে না। পাশের দেশ ভারত ২১টি পণ্যের ক্ষেত্রে বিএসটিআইয়ের সনদ গ্রহণ করে।
বিএসটিআইয়ের সনদপ্রাপ্ত একটি কোম্পানির হলুদের গুড়া ইউরোপীয় ইউনিয়ন ফেরত পাঠিয়েছে। রপ্তানিযোগ্য খাদ্যপণ্যের মান সনদ দেয় নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ। কিন্তু সংস্থাটির নিজস্ব কোনো ল্যাব নেই।
তাছাড়া, শুটকি মাছ, চাটনি, তিলের তেলসহ রপ্তানিযোগ্য প্রক্রিয়াজাত অনেক খাদ্যপণ্যই বিএসটিআইয়ের তালিকায় নেই। রপ্তানিকারকের চাহিদা অনুযায়ী খাদ্যপণ্যের বিভিন্ন প্যারামিটার পরীক্ষার সক্ষমতাও নেই সংস্থাটির।
বিএসটিআইয়ের প্রোডাক্ট সার্টিফিকেশন তালিকায় কৃষিজাত ও খাদ্যপণ্যেও অন্তর্ভুক্তি বাড়াতে বলেছে কমিশন।
হেলথ সার্টিফিকেট অথরিটি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ
এক্রিডিটেড ল্যাবে আন্তর্জাতিকমানের পরীক্ষা নিশ্চিত করে ওয়ান স্টপ সার্ভিস সেন্টারের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের চাহিদা অনুযায়ী হেলথ সার্টিফিকেট ইস্যু করা গেলে বাংলাদেশের কৃষিজাত ও খাদ্যপণ্য রপ্তানি ১০ গুণ বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানিয়েছে ট্যারিফ কমিশন।
কমিশন বলেছে, এজন্য একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রতিষ্ঠান থাকা প্রয়োজন।
পরীক্ষাগুলো একক কোনো প্রতিষ্ঠানের পক্ষে করা সম্ভব নয়। সনদ ইস্যুকারী সংস্থাগুলোর সমন্বয়ে একটি সিঙ্গেল আমব্রেলা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে সার্টিফিকেশন পদ্ধতি সহজ করতে হবে।
কৃষি ও খাদ্যপণ্যের সম্ভাবনা কাজে লাগাতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় একটি অথরিটি প্রতিষ্ঠা করতে যাচ্ছে। তবে তার আগ পর্যন্ত রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো রপ্তানি পণ্যের ক্ষেত্রে হেলথ সার্টিফিকেট ইস্যু করবে। এজন্য ইতোমধ্যে স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউরের (এসওপি) খসড়া তৈরি করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে সংস্থাটি।
প্রস্তাবিত হেলথ সার্টিফিকেশন অথরিটির নিজস্ব ইন্সপেকশন ক্ষমতা ও সার্টিফিকেট ইস্যুর সক্ষমতা থাকবে। অথরিটির অধীনে থাকা মান নির্ধারণী সংস্থাগুলো প্রাধিকারের ভিত্তিতে পণ্যের বিভিন্ন প্যারামিটার পরীক্ষা করে অথরিটির নিকট সুপারিশ করবে। অথরিটি বিভিন্ন দেশের মান বিষয়ে প্রত্যয়নসহ ফিট ফর হিউম্যান কনজাম্পশন সার্টিফিকেট দেবে।
এ রকম অথরিটি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে বাণিজ্য সচিব মো. জাফর উদ্দিন সম্প্রতি টিবিএসকে বলেছিলেন, ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়াসহ অনেক দেশই কৃষি ও খাদ্যপণ্য রপ্তানি করে বিপুল অর্থ উপার্জন করছে, সেই তুলনায় এই খাতে বাংলাদেশের উপার্জন নগণ্যই রয়ে গেছে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) রিসার্চ ডিরেক্টর খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম টিবিএসকে বলেন, 'বাংলাদেশ উদ্বৃত্ত কৃষিপণ্যের দেশে রূপান্তর হচ্ছে। তাই কৃষি ও খাদ্যপণ্য রপ্তানি বাড়াতে এমন একটি অথরিটি গঠন করা খুবই জরুরি।'
তিনি বলেন, প্রস্তাবিত অথরিটির অবশ্যই আন্তর্জাতিক মানের ল্যাব ও বিশেষজ্ঞ জনবল থাকতে হবে। সনদ প্রদানকারী বৈশ্বিক এজেন্সিগুলোর সঙ্গে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের ভিত্তিতে এ ধরনের অথরিটি প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করা গেলে তাদের ইস্যু করা হেলথ সার্টিফিকেট বিদেশে গ্রহণযোগ্যতা পাবে।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ও পরিকল্পনা কমিশনের সাবেক সদস্য আবদুস সাত্তার মন্ডল টিবিএসকে বলেন, কৃষি ও খাদ্যপণ্যের বিপুল রপ্তানি সম্ভাবনা কাজে লাগাতে হলে উৎপাদন পর্যায়ে গুড এগ্রিকালচারাল প্র্যাকটিস করতে হবে। রপ্তানি পর্যায়ে আন্তর্জাতিক মানের ল্যাবে পরীক্ষা করে আমদানিকারক দেশের চাহিদা অনুযায়ী সার্টিফিকেট ইস্যুর সক্ষমতা অর্জন করতে হবে।
তিনি বলেন, চাষাবাদে কোন মানের পানি ব্যবহার হচ্ছে, বিদেশি ক্রেতারা এখন সে সম্পর্কেও তথ্য জানতে চান। এজন্য রপ্তানি বাড়াতে হলে কমপিটেন্ট অথরিটির সার্টিফিকেশন লাগবে।
বাংলাদেশ অ্যাগ্রো প্রসেসরস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এএফএম ফখরুল ইসলাম মুন্সি জানান, বিশ্বমানের হেলথ সার্টিফিকেট দেওয়ার ব্যবস্থা না থাকায় বাংলাদেশ থেকে কৃষি ও খাদ্যপণ্য রপ্তানিতে তারা সমস্যায় পড়ছেন। এজন্য পৃথক ল্যাব স্থাপন করে মান যাচাই নিশ্চিত করে সার্টিফিকেট ইস্যুর কোনো কোনো বিকল্প নেই বলে দাবি তার।