হস্তনির্মিত গহনা বাণিজ্যে স্বাবলম্বী বগুড়ার নারীরা
বগুড়া শহরের ধরমপুর পূর্বপাড়া। বাড়ির দরজায় বসে অ্যান্টিকের গহনা তৈরি করছেন খুশি বেগম (২০)। বিকেলের হালকা রোদে বসে ব্যস্ত খুশি বেগম তামা ও পিতল মনোমুগ্ধকর নকশা তৈরিতে। নিজের শিল্পমনন কাজে লাগিয়ে বানাচ্ছেন দুল।
কথা বলার মাঝেই এগিয়ে এলেন খুশির জা (ভাসুরের বউ) ফেন্সি বেগম (২৮)। তিনি সীতাহারের নকশার কাজ করেন। এ কাজ করেই তারা এখন সংসারের হালও ধরেছেন।
কেবল খুশি-ফেন্সি-ই নন; অ্যান্টিকের গহনাকে কেন্দ্র করে বগুড়ার অন্তত ৪০ হাজার শ্রমিক কাজ করেন। তাদের মধ্যে অন্তত ৩৫ হাজারের বেশি নারী শ্রমিক রয়েছেন বলে জানান ধরমপুর বাজার দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. জাকির হোসেন।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, ধরমপুর এলাকার 'গহনা গ্রামের' ইতিহাস অনেক পুরোনো। প্রায় দেড়শ বছর আগে এখানে গহনার কাজ শুরু হয়। সে সময় পিতলের গহনা তৈরি হতো। পরে এক পর্যায়ে সোনার গহনার চাহিদা বাড়তে থাকে। কিন্তু ১৯৮০-এর দশকের শেষে আবার সোনার গহনার চাহিদা পড়তে থাকে। তখন থেকে একটু একটু করে অ্যান্টিক শিল্পের দিকে ঝুঁকতে থাকেন কারিগররা।
এরপর ২০০৬ থেকে ২০০৭ সালের দিকে পুরোদমে শুরু হয় অ্যান্টিকের গহনা তৈরি। পরে ধরমপুর বাজারে মোকাম গড়ে ওঠে।
বগুড়ার 'গহনা গ্রাম'খ্যাত ধরমপুরে ব্যবসায়িক মোকামও গড়ে উঠেছে। এই বাজারে ২৩৮টি গহনার দোকান রয়েছে। ধরমপুর বাজার মালিক-শ্রমিক মিলে প্রায় ৩ হাজার লোক এখানে কাজ করেন। এখানে তৈরি গহনার ঢাকা, চট্টগ্রাম, রংপুর, খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কদর রয়েছে। এসব গহনা তৈরি করতে বগুড়ারের বিভিন্ন অঞ্চলে কুটির শিল্পের আদলে গড়ে উঠেছে কারখানা।
ধরমপুর বাজার দোকান মালিক সমিতির সভাপতি রমজান আলী সরদার জানান, বর্তমানে এই বাজারে প্রতিদিন অন্তত ৫০ লাখ টাকার গহনা পাইকারি বিক্রি হয়। সে হিসেবে মাসে সাড়ে ১৫ কোটি টাকার লেনদেন হয় গহনাকে কেন্দ্র করে। বছর শেষে এর পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ১৮০ কোটি টাকায়।
ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কাজের অর্ডার নিয়ে নারীরা ঘরে বসেই বানান গহনা। এর মধ্যে কেউ কেউ ঘরেই গড়ে তুলেছেন ছোট কারখানা। সেখানে একসঙ্গে পাড়ার একাধিক নারী তৈরি করেন অ্যান্টিকের গহনা।
শুরুটা ধরমপুরে হলেও এ শিল্পের বিস্তার ঘটেছে সদরের নিশিন্দারা, ঝোপগাড়ী, ফুলবাড়ী ও বারোপুরসহ আরও অনেক এলাকায়। এসব এলাকায় নারী-পুরুষ কারিগরদের কর্মসংস্থানের উৎস তৈরি হয়েছে গহনাকে কেন্দ্র করেই।
অ্যান্টিকের গহনা তৈরির আয় থেকে এ এলাকার নারীরা নিজেদের আর্থিকভাবে সাবলম্বী করেছেন। অনেকে সংসারের হাল ধরেছেন। গড়েছেন নিজের বাড়িঘরও।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, ঘরকেন্দ্রিক এসব ছোট ছোট কারখানা থেকে তৈরি হওয়া গহনাই তারা সরবরাহ করছেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।
কারিগরদের কাছে জানা গেছে, বিয়ে-শাদিসহ যেকোনো অনুষ্ঠানে সোনার মতোই দেখতে এই অ্যান্টিক ও সিটিগোল্ড গহনার ব্যাপক চাহিদা। নারীদের পছন্দের সীতাহার, শাড়ীমালা, কান্দা, লহর, হাশলি, জড়ো, টাইরা, টিকলি, চুড়ি, বালা, মানতাসা, নূপুর, বিছাসহ আরও বিভিন্ন দৃষ্টিনন্দন গহনা তৈরির কাজ করেন তারা। ধরমপুরে প্রায় ১০০ ধরনের গহনা পাওয়া যায় বলে জানান ব্যবসায়ীরা।
ধরমপুরের পাশেই বারপুর গ্রামের কারখানায় কাজ করেন সুফিয়া বেগম। তিনি এর আগে শহরে বিড়ির কারখানায় কাজ করতেন। মানুষের মুখে সুফিয়া শুনেছেন, বিড়ির কারখানায় কাজ করলে বড় অসুখ হবে। এই কারণে তিনি বর্তমানে গহনার কারখানায় কাজ করেন।
তার সঙ্গেই কাজ করেন রমিচা বেওয়া। তিন বছর হলো বিড়ি তৈরি কাজ ছেড়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন, 'স্বামী মারা যাওয়ার পর থেকে গহনার কাজ করি। সংসারের সব খরচ আমাকেই মেটাতে হয়। এখানে কাজ করে প্রতি মাসে তিনি ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা আয় হয়। এই টাকা দিয়েই সংসার চলে।'
ধরমপুর এলাকার গহনার কারিগর খুশির বিয়ে হয়েছে সাড়ে চার বছর আগে। তখন থেকে দেখতেন, পাড়ার সবাই এসব বানান। এরপর তিনিও রপ্ত করে নেন এই কাজ। স্বামীর সঙ্গে শুরু করেন গহনা তৈরি। শুরুতে স্বামী আবু বক্করের উৎসাহ ছিল না। তবে ২০১৮ সালে আবু বক্কর সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হলে সংসারের হাল ধরেন খুশি। এরপর অ্যান্টিক গহনা তৈরির আয়ের দুই লাখ টাকা দিয়ে নিজেদের বাড়ি তৈরি করেছেন।
খুশি বেগম জানান, সকালবেলা তিনি সংসারের কাজ শেষ করে শুরু করেন গহনা তৈরি। প্রতিদিন গড়ে ৪০০ টাকা রোজগার হয়। এ এলাকার সব নারী কাজের অবসরে এ কাজ করে বাড়তি আয় করেন।
খুশি বেগমের জা ফেন্সি বেগম অ্যান্টিক গহনার কাজ করছেন ছয় বছর ধরে। তার কাজ সীতাহারের তামার প্যান দিয়ে ঝালাই করা। তার স্বামী জহুরুল ইসলামও একই কাজ করেন। প্রতিদিন দুজনে এ কাজ করে প্রায় এক হাজার টাকা আয় করেন।
ফেন্সি বলেন, 'ঘরে বসে থাকার চেয়ে এসব হাতের কাজ করা আমাদের শখ। যে টাকা আয় হয়, তা সঞ্চয় করি। এ থেকে আমি ইটের বাড়ি করেছি। তিন শতক জমি কিনেছি। ছেলেমেয়েদের পড়ালেখা খরচ চালাই। স্বামী সংসারের অন্য খরচ সামলান।'
ধরমপুর, নিশিন্দারা, ঝোপগাড়ি, আটাপাড়া এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে শুধু গৃহবধুরা নন, অনেক শিক্ষার্থী পড়ালেখার পাশাপাশি এই হাতের কাজ করছেন। সরকারি মুজিবর রহমান মহিলা কলেজের সম্মান দ্বিতীয় বর্ষের ইসলামের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী আদুরী আক্তার। নিশিন্দারা উত্তর পাড়ার এই বাসিন্দা জানান, তিনিও অ্যান্টিকের গহনা তৈরি করে নিজের লেখাপড়ার খরচ যোগান।
পল্লী মঙ্গল এলাকার উচ্চমাধ্যমিক পড়ুয়া সাদিয়া বলেন, 'শখ থেকে মূলত এই কাজ শুরু। এখন সময় কাটে, টাকাও উপার্জন হয়।'
নিশিন্দারার এলাকার মিম, জান্নাতী, সাথী, ছোট কুমিড়ার সানজিদা পড়াশোনার পাশাপাশি অ্যান্টিকের কাজ করেন। তাদের কথা, বসে থেকে সময় নষ্ট করার চেয়ে এ কাজ করলে বাড়তি টাকা আয় হয়। তবে তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, পুরুষের চেয়ে এ কাজে নারীদের আগ্রহই বেশি। এ কারণে অ্যান্টিকের গহনা তৈরির কারিগর তুলনামূলকভাবে পুরুষের চেয়ে নারী বেশি।
ধরমপুর বাজারের শফিক গোল্ড অ্যান্ড অ্যান্টিক জুয়েলার্সের মালিক শফিকুল ইসলাম। বাজারে ব্যবসা করেন ১৫ বছর হলো। তিনি সাধারণত পণ্যগুলো পাইকারি বিক্রি করেন। তার কাছ থেকে সারা দেশের ক্রেতারা এসে এসব গহনা কিনে নেন।
শফিকুল জানান, যশোর, বরিশাল ও রংপুরে তিনি প্রতি মাসে অন্তত ৩০ লাখ টাকার পণ্য বিক্রি করেন।
শফিক গোল্ড অ্যান্ড অ্যান্টিক জুয়েলার্সের কর্মচারী শহিদুল বলেন, 'এখানে কাজ করে সংসার ও দুই সন্তানকে স্কুলে পড়াশোনা করাচ্ছি।'
সম্প্রতি ঢাকার গাজীপুরের টঙ্গি এলাকা থেকে এসব অ্যান্টিক গহনা পাইকারি দরে কিনতে আসেন মো. জীবন মিনসা। তিনি জানান, গাজীপুরের টঙ্গি বাজারে তার দোকান রয়েছে। বর্তমানে এসব পণ্যের চাহিদা বেড়েছে। বগুড়ায় তৈরি গহনার সুনাম থাকায় তিনি দূর হলেও এখানে এসেছে।
ধরমপুর বাজার দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন বলেন, 'করোনার প্রভাব কাটিয়ে ব্যবসা কিছুটা ভালোর দিকে। বগুড়ার গহনার বেশ সুনাম রয়েছে। এ কারণে প্রতিদিন কারিগরের সংখ্যা বাড়ছে। নতুন নতুন কারখানা তৈরি হচ্ছে। সোনার দাম বেশি হওয়ার কারণে অ্যান্টিকের গহনার চাহিদা ভারতেও রয়েছে।'
'সরকারিভাবে কম সুদে ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা গেলে অনেক নারীই সফল ব্যবসায়ী হয়ে উঠতে পারবেন,' বলেন তিনি।
৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ধরমপুর এলাকায় গহনার ব্যবসা করেন রমজান আলী সরকার। ধরমপুর বাজার দোকান মালিক সমিতির সভাপতি রমজান বলেন, 'গহনার কাজে পুরুষের চেয়ে নারীরা বেশি ভালো। কম বেতনে তাদের পাওয়া যায়। আবার ঘরের কাজ করে নারীরা এসব কাজ করতে পারেন। এ কারণে এ শিল্পে বগুড়ায় অন্তত ৪০ হাজার নারী কাজ করে সংসার চালান।'
নারীদের বিভিন্ন কাজে দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ও ঋণ দেয় মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর। গহনা গ্রামের নারীদের আলাদা কোনো প্রশিক্ষণ বা ঋণের ব্যবস্থা আছে কি না, জানতে চাইলে জেলা মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, 'ধরমপুরকে কেন্দ্র করে কয়েক হাজার নারী নিজেদের উদ্যোগে কাজ করেন। তাদের বিষয়টি মাথায় রেখে সরকারিভাবে ঋণের ব্যবস্থা করা যায় কি না, তা মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর গুরুত্ব সহকারে বিবেচনায় এনেছে।'
সাধারণত ক্ষুদ্র, অতিক্ষুদ্র, কুটির ও মাঝারি শিল্পে উৎপাদন সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কম সুদে ঋণ দেওয়ার সুযোগ রয়েছে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুঠির শিল্প সংস্থার (বিসিক)। এই সংস্থা ১০ থেকে ৯ শতাংশ সুদে ২০ হাজার থেকে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত কুটির শিল্পের জন্য ঋণ দিয়ে থাকে।
বগুড়া বিসিকের উপ ব্যবস্থাপক মো. জাহেদুল ইসলাম বলেন, 'ধরমপুরকে কেন্দ্র করে ঐতিহাসিকভাবেই গহনার ব্যবসা গড়ে উঠেছে। বিভিন্নভাবে খোঁজ নেওয়ার পর তাদের মধ্যে অনেকে ঋণের জন্য আমাদের সাথে যোগাযোগও করেছেন। কিন্তু তারা আমাদের শর্ত মানতে চান না। এই কারণে এখনো কাউকে ঋণ দেওয়া সম্ভব হয়নি। কিন্তু বগুড়ার গহনা শিল্পের মাধ্যমে নারীরা নিজেরে দেশের কাছে তুলে ধরতে পারেন।'