হস্তশিল্প রপ্তানিতে লাগেনি মহামারির ছোঁয়া
করোনা সংকটেও বেড়েছে হস্তশিল্প রপ্তানি। চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসেই আগের বছরের ১২ মাসের পরিমাণ ছুঁয়েছে দেশ থেকে হস্তশিল্প পণ্য রপ্তানি।
সরকারের রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের সাত মাসে (জুলাই- জানুয়ারি) এ খাতে রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ১৯ দশমিক ৬১ মিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ৪৮ দশমিক ২২ শতাংশ বেশি। অন্যদিকে তার আগের বছর ১২ মাসে রপ্তানি হয়েছিল ২০ দশমিক ৫২ মিলিয়ন ডলার।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনার কারণে ইউরোপীয় দেশগুলোর চীন বিমুখতা ও ন্যাচারাল পণ্য ব্যবহারে আগ্রহ বাড়ার কারণে বাংলাদেশের হস্তশিল্পের জন্য সুযোগ তৈরি হয়েছে। বর্তমানে ইউরোপেই ৬০ শতাংশ হস্তশিল্প রপ্তানির হয়।
বাংলাদেশ হস্তশিল্প প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বাংলাক্রাফট) সেক্রেটারি মো. শাহ জালাল দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, বিদেশে হস্তশিল্পের চাহিদা বাড়ছে। এখন দেশের হস্তশিল্পকে এগিয়ে নিতে কারুপল্লী গড়ে তোলা জরুরি। থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, ভারত, চীন-সহ প্রতিবেশী দেশগুলো সরকারের সহায়তায় কারুপল্লী গড়ে তোলা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, 'এতে সুবিধা হলো বায়াররা যখন আসেন, তখন একই জায়গা থেকে তারা পণ্যগুলো পেয়ে যাচ্ছেন এবং স্পট অর্ডার দিয়ে যাচ্ছেন। আমাদের দেশে এমন ব্যবস্থা নেই, সেজন্য আমাদের দেশে বায়াররা আসছেন না। দেশে যেন দ্রুত একটি কারুপল্লী গড়ে তোলা হয়, যেখানে আমাদের সদস্যদের প্রতিষ্ঠান থাকবে- সরকারের কাছে এমন দাবি জানাই।'
বাংলাক্রাফ্টের সহ-সভাপতি শাহিদ হোসেন শামীম সেক্রেটারি মো. শাহ জালাল দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'আরও রপ্তানি বাড়াতে আমরা সরকারের কাছে নগদ সহায়তা আগের মতো ২০ শতাংশ দেওয়ার দাবি জানিয়েছি। হস্তশিল্প রপ্তানিতে আমরা আগে এটা পেতাম; হঠাৎ করে ২০১৯ -২০২০ অর্থবছরে তা ২০ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। হস্তশিল্প রপ্তানিতে ২০ শতাংশ প্রণোদনা চাই আমরা।'
তিনি আরও বলেন, 'বিশ্বব্যাপী ক্রেতারা এখন ন্যাচারাল পণ্য ব্যবহারে উৎসাহিত হচ্ছেন। আমাদের এ মার্কেট ধরতে হবে।'
বাংলাদেশ থেকে ৫০টির বেশি দেশে হস্তশিল্প রপ্তানি করা হয়। সাধারণত পাটের তৈরি পণ্য, হোগলাপাতা দিয়ে তৈরি বিভিন্ন আকারের ঝুড়ি, বাঁশ ও বেতের তৈরি বিভিন্ন ধরনের বাস্কেট, ফ্লোর কাভারিংয়ের ম্যাট বা কার্পেট, নকশি কাঁথা ও নকশি বেডশিট এবং পুনঃপ্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে তৈরি কিছু পণ্য বেশি রপ্তানি হয়।
চলতি অর্থবছরে দেশের হস্ত ও কুটির শিল্প থেকে রপ্তানি টার্গেট ধরা হয়েছে ২৮ মিলিয়ন ডলার। হস্তশিল্পের প্রধান রপ্তানি বাজারের মধ্যে রয়েছে উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো।
বাংলাদেশ বহুমুখি পাটপণ্য সমিতির আহ্বায়ক ও এসএমই ফাইন্ডেশনের সদস্য রাশেদুল করিম মুন্না দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'কোভিডের কারণে আমেরিকা ও ইউরোপীয় দেশগুলো চীন থেকে পণ্য আমাদানিতে নিরুৎসাহিত হচ্ছে। সবাই চীনের অলট্রানেটিভ সাপ্লাই চেইন খোঁজার চেষ্টা করছে। এজন্য বাংলাদেশ কিছুটা বেনিফিট পাওয়ার সুযোগ পেয়েছে।'
তিনি বলেন, 'আমাদের দেশে হস্তশিল্পের সম্ভাবনা অনেক। এখানে অল্প টাকায় দক্ষ শ্রমিক পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। এখন আমাদের হস্তশিল্প নিয়ে গবেষণা ও ডিজাইন উন্নয়নের জন্য ট্রেনিং ইনস্টিটিউট স্থাপন করা প্রয়োজন।'
তবে রপ্তানি বাড়লেও এখনো সংকট কাটেনি ছোট উদ্যোক্তাদের। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বড় উদ্যোক্তারাই তাদের পণ্য রপ্তানি করতে পারলেও ছোট উদ্যোক্তারা পিছিয়ে রয়েছেন। তাদের উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করতে না পেরে তারা সংকটে রয়েছেন।
হস্তশিল্প পণ্য নিয়ে কাজ করেন ইশরাত জাহান। তার প্রতিষ্ঠান 'তুলিকা' থেকে ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী পাটের তৈরি ব্যাগসহ বিভিন্ন হস্তশিল্প পণ্য রপ্তানি হয়। করোনার আগে উত্তরার যে ফ্ল্যাটে অফিস ছিল, এখন সেটি পরির্তন করেছেন।
তিনি বলেন, 'নিচ তলায় আগের চেয়ে কম ভাড়ায় অফিস নিয়েছি। আমার প্রতিষ্ঠানে ১৫ জন বেতনভুক্ত কর্মচারি ছিলেন। আগের মতো অর্ডার না পেয়ে এখন দুই-তিনজন রেখেছি।'
ইশরাত জাহান গত ছয় মাসে ২৫ হাজার ডলারের হস্তশিল্প রপ্তানি করেছেন। এখন তার হাতে ১০ হাজার ডলারের একটি অর্ডার রয়েছে। তিনি বলেন, 'আমরা করোনার শুরুতে দুই মাস অফিস বন্ধ রেখেছিলাম। এরপর যখন অফিস খুলি, তখন কর্মীদের অফিসে থাকার ব্যবস্থা করেছি। কাঁচামাল সংকট ছিল, বিভিন্ন জায়গায় যোগাযোগ করে এগুলো সংগ্রহ করতে হয়েছে। অনেক চ্যালেঞ্জ ছিল।'
তিনি আরও বলেন, 'আন্তর্জাতিক বাজারে হস্তশিল্পের অনেক চাহিদা রয়েছে। কিন্তু ছোট উদ্যোক্তারা সেখানে কিভাবে পণ্য পৌঁছে দেবেন, তারা তা জানেন না। আমি অনেক যোগাযোগ করে সম্প্রতি ইতালি থেকে ১০ হাজার ডলারের একটি অর্ডার পেয়েছি।'
সম্ভাবনার এ খাতকে আরও এগিয়ে নেওয়ার জন্য ছোট উদ্যোক্তাদের পণ্য রপ্তানির সুযোগ করে দিতে একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা প্রয়োজন বলে মনে করেন ইশরাত। তিনি বলেন, 'এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশে নিযুক্ত দূতাবাসগুলো ভূমিকা রাখতে পারে।'
এছাড়াও দেশের বিভিন্ন জায়গায় বাংলাক্রাফটের সদস্যদের পণ্য নিয়ে নিয়মিত মেলার আয়োজন করার মরামর্শ তার।
বাংলাক্রাফটের সেক্রেটারি মো. শাহ জালাল বলেন, 'বাংলাক্রাফটের সদস্যসংখ্যা ৪৫০; এরমধ্যে রপ্তানি করে ১২৫টি প্রতিষ্ঠান। কোভিড সংকটে ছোট উদ্যোক্তাদের বিক্রির অবস্থা খুবই খারাপ। সরকারের দেওয়া প্রণোদনার টাকা ব্যাংক থেকে উঠাতে তারা অনেকে চেষ্টা করেছেন। কিন্তু আমাদের অনেক সদস্যের অভিযোগ, তারা ব্যাংক থেকে কোনো ঋণ নিতে পারেননি। ব্যাংক যে ডকুমেন্ট চায়, সেটা তারা দিতে পারছেন না।'