২০২৫ সাল নাগাদ আইটি খাত থেকে ৫০০ কোটি ডলার রপ্তানি আয়ের রোডম্যাপ
তথ্যপ্রযুক্তি খাতে দেশে তৈরি ডিজিটাল ডিভাইসের রপ্তানি আয় বর্তমানের প্রায় এক বিলিয়ন ডলার থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে ৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে চায় সরকার। একই সময়ে আইসিটি পণ্য ও আইটি-এনাবল সার্ভিসের অভ্যন্তরীণ বাজারও ৫০০ কোটি ডলারে পৌঁছাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
আগামী চার বছরের মধ্যে দেশে-বিদেশে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের ১০ বিলিয়ন ডলারের সম্ভাব্য বাজার ধরতে ডিজিটাল ডিভাইস তথা মোবাইল ফোন, কম্পিউটার ও ল্যাপটপের মতো আইটি পণ্য বড় ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছে সরকার। এরই অংশ হিসেবে দেশে ডিজিটাল ডিভাইস উৎপাদন শিল্প স্থাপনের সুযোগ সম্প্রসারণ এবং আন্তর্জাতিক বাজারে স্থানীয় পণ্যের ব্রান্ডিংয়ে 'মেড ইন বাংলাদেশ' রোডম্যাপ নেওয়া হচ্ছে, বলে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ (আইসিটি) সূত্রে জানা গেছে।
এ রোডম্যাপের সঠিক বাস্তবায়ন হলে দেশে আইটি ডিভাইস উৎপাদন শিল্পে অন্তত এক লাখ মানুষের কর্মসংস্থান নিশ্চিত হবে। প্রায় ২০০ কোটি ডলারের অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণ করে বিদেশে রপ্তানি করা হবে ল্যাপটপ ও মোবাইল ফোন।
সম্প্রতি আইসিটি বিভাগের প্রস্তুতকৃত নতুন এ রোডম্যাপ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে মতামতের জন্য পাঠানো হয়েছে।
আইসিটি বিভাগের আশা, 'মেড ইন বাংলাদেশ' কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশ আইসিটি এবং আইওটি (ইন্টারনেট অব থিংস) পণ্য উৎপাদনের অন্যতম কেন্দ্রে পরিণত হবে। এটি সরকারের সবার জন্য ডিজিটাল এক্সেস এজেন্ডা বাস্তবায়নেরও সহায়ক হবে।
বিভাগটির কর্মকর্তারা বলছেন, দেশের উদীয়মান মধ্যবিত্ত ও স্বচ্ছল শ্রেণির ক্রমবর্ধমান ডিজিটাল ডিভাইস ও কনজ্যুমার গ্যাজেটের চাহিদা আন্তর্জাতিক হাই-টেক শিল্পে বাংলাদেশের প্রবেশে সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করেছে।
রোডম্যাপে সরকারি কেনাকাটায় দেশে উৎপাদিত আইসিটি পণ্যের ব্যবহারকে অগ্রাধিকার দেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। এ লক্ষ্যে কেনাটাকায় জড়িত সরকারি সংস্থাগুলোর কর্মকর্তাদের সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া হবে। পাশাপাশি দেশে উৎপাদিত পণ্যের রপ্তানি সহজ করতে সিঙ্গাপুর, দুবাই, ইংল্যান্ড বা অন্য কোন দেশে হাব স্থাপনেরও সুপারিশ করা হয়েছে।
নতুন রোডম্যাপটিতে দক্ষ জনশক্তি তৈরি, পণ্যের মান উন্নয়ন, গুণগত মান নিশ্চিতকরণ, বৈশ্বিক চাহিদা নিরূপণ, বিশ্যব্যাপী বাংলাদেশি পণ্যের ইমেজ বৃদ্ধি, মেধাস্বত্ব রক্ষা, গবেষণা বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।
সরকারের আইসিটি বিভাগ ছাড়াও বিশাল এ কর্মযজ্ঞে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়, ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ, শিল্প মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয় বিভাগের পাশাপাশি বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল, বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ (বিএইচটিপিএ), বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা), বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা), বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেপজা), রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি), বিএসটিআই, বিটাক, দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও বিশ্বববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন একযোগে কাজ করবে।
রোডম্যাপ সফল করতে, বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি উদ্যোক্তাদের বিভিন্ন সংগঠনেরও থাকবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব।
ইন্টারন্যাশনাল ডেটা কো-অপারেশন (আইডিসি) সূত্রমতে, ২০১৭ সালে তিন কোটি ৪০ লাখ মোবাইল ফোন আমদানি করে বাংলাদেশ, যার মূল্য ছিল ১১৮ কোটি ডলার। ২০১৮ সালে এদেশের ল্যাপটপ বাজারের মূল্যায়ন ৩০ কোটি ডলার করেছে সংস্থাটি।
সম্ভাবনাময় এ অভ্যন্তরীণ বাজারের সুবিধা নিতে বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ (বিএইচটিপিএ) প্রতিষ্ঠা করা হয়। এজন্য দেওয়া হচ্ছে বেশকিছু সিরিজ প্রণোদনা। আইটি পার্ক প্রতিষ্ঠাতা ও বিনিয়োগকারীদের জন্য আয়কর রেয়াত ঘোষণা করেছে বিএইচটিপিএ। এছাড়া, দেশে এটিএম কিয়স্ক, সিসিটিভি ক্যামেরা উৎপাদনে দেওয়া হবে আমদানি ও রেগুলেটরি শুল্ক অব্যাহতিসহ সম্পূরক শুল্ক ছাড়। এছাড়া, বিনিয়োগকারীরা মূলধনী যন্ত্রপাতি ও নির্মাণ উপকরণ আমদানিতেও শুল্ক অব্যাহতি পাবেন।
এসব সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে 'মেড ইন বাংলাদেশ'কে উদ্যোগকে গতিশীল করতেই নতুন রোডম্যাপটি প্রস্তুত করা হয়েছে।
তাছাড়া, তুলনামূলক প্রতিযোগী বেতন-কাঠামোয় শ্রমশক্তির সহজলভ্যতা, স্থানীয় বাজার চাহিদা এবং সরকারি নীতির সহায়ক কাঠামো বাংলাদেশকে ডিজিটাল ডিভাইস উৎপাদনের আকর্ষণীয় বাজারে পরিণত করার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে বলে মনে করছে আইসিটি বিভাগ।
বাংলাদেশে ইতোমধ্যেই সফলভাবে প্রোডাকশন লাইন স্থাপনকারী- ওয়ালটন, স্যামসাং, অপ্পো, ডেটা সফটের উদাহরণ দিয়ে বিভাগটি বলছে, এসব উদ্যোগ আগামীতে স্থানীয়ভাবে ডিভাইস উৎপাদন শিল্পে আরও উন্নয়নের সম্ভাবনা তুলে ধরেছে।
তবে রোডম্যাপ বাস্তবায়নের কিছু প্রতিবন্ধকতাও চিহ্নিত করেছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ, এরমধ্যে বাংলাদেশে অধিক পুঁজি খরচের দিকটিকে শীর্ষে রাখা হয়েছে।
পাশাপাশি দক্ষতার অভাব, শিল্প সহায়ক বাস্তুতন্ত্রের দুর্বলতা, মান নিশ্চিতকরণ এবং স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পণ্যের আন্তর্জাতিক সনদপ্রাপ্তির সমস্যা, সরকারি ক্রয়ে স্থানীয় পণ্যকে অগ্রাধিকার দানে দরকারি বিধিমালার অভাব, স্থানীয়পণ্যের ব্যাপারে জন-সচেতনতার অভাব এবং ডিজিটাল ডিভাইস প্রস্তুতকারকদের জন্য আর্থিক প্রণোদনার অভাবকে প্রধান প্রধান সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
কৌশলগত দিক:
চারটি কৌশলগত বিষয়বস্তুকে প্রাধান্য দিয়ে নতুন এ রোডম্যাপ প্রনয়ন করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে: সরকারি-বেসরকারি খাতে স্থানীয় পর্যায়ে সক্ষমতা উন্নয়ন, সচেতনতা সৃষ্টি ও ব্র্যান্ডিং, গবেষণা ও উন্নয়ন, এবং নীতি-সহায়তা।
এর আওতায় ২০২৩ সালের মধ্যে বাস্তবায়নের জন্য স্বল্পমেয়াদে, ২০২৮ সালের মধ্যে বাস্তবায়ন করতে মধ্যমেয়াদে ও ২০৩১ সালের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদে কিছু কর্মপরিকল্পনা রয়েছে।
স্বল্পমেয়াদে প্রযুক্তি পণ্যের দেশি ও আন্তর্জাতিক বাজার বিশ্লেষণ করে চাহিদা নিরূপণ, সক্ষমতা উন্নয়ন ও বাজারজাতকরণের কৌশলপত্র প্রণয়ন করা হবে।
এ সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উদ্যোগে আইটিপণ্যের গুণগত মান নিশ্চিত করতে স্থাপন করা হবে টেস্টিং ল্যাব। দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক আন্তর্জাতিক চুক্তির মাধ্যমে রপ্তানি বৃদ্ধির উদ্যোগ নেবে বাণিজ্য মন্ত্রনালয়। বিদেশে পণ্য রপ্তানি করতে সিঙ্গাপুর, দুবাই, ইংল্যান্ড বা অন্য কোন দেশে হাব স্থাপন করা হবে।
আইসিটি বিভাগের সহায়তায়, এ সময়ে দেশে আইসিটি খাতের জন্য দক্ষ পাঁচ লাখ কর্মী গড়ে তুলবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন প্রশিক্ষণ মডিউল ও সিলেবাস তৈরি করবে দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ।
আগামী দুই বছরে বাংলাদেশ সম্পর্কে অন্যান্য দেশের মনোভাব উপলদ্ধি ও নেতিবাচক মনোভাব থেকে উত্তরণের জন্য কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়ন করবে পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়।
দেশে উৎপাদিত আইসিটি পণ্যের বিবরণ নিয়ে আইসিটি বিভাগ তৈরি করবে জাতীয় পোর্টাল। তাছাড়া এ সময়ে সরকারি কেনাকাটায় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দেশীয় পণ্য সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া হবে।
ডিজিটাল ডিভাইস ও এর ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্পের ওপর বিভিন্ন ধরনের শুল্ক ও কর যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনতে কাজ করবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড।
আইসিটি পণ্যের উৎপাদকারীদের জন্য সহজ শর্তে ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করবে অর্থ মন্ত্রনালয়। আর এসব পণ্য রপ্তানিতে প্রণোদনার বিষয়টি দেখবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন:
এনিয়ে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস) এর সাবেক সভাপতি এ কে এম ফাহিম মাশরুর দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড'কে বলেন, আইসিটি পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে আমদানি কমিয়ে আনার পাশাপাশি রপ্তানি বৃদ্ধির উদ্যোগটি অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। তবে 'মূল্য সংযোজন বৃদ্ধির পরিকল্পনা না থাকলে, এ ধরনের উদ্যোগে কার্যকর সুফল পাওয়া যাবে না।'
তিনি বলেন, 'প্রযুক্তি পণ্যের অধিকাংশ উদ্যোক্তা প্রায় শতভাগ উপকরণ বিদেশ থেকে আমদানি করে দেশীয় কারখানায় শুধু সংযোজন করছেন। এর ফলে ফিনিশড প্রোডাক্ট হিসেবে শুল্কায়ন না হওয়ায়, সরকার রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে। অন্যদিকে, শুধুমাত্র সংযোজনের কাজ হওয়ায় নামমাত্র লোক নিয়োগ দিয়েই কারখানা পরিচালনা করা হচ্ছে।'
উদাহারণ দিয়ে তিনি বলেন, কিছুদিন আগেই চালু হওয়া চীনা মোবাইল ফোন ব্র্যান্ড শাওমির দেশীয় কারখানায় মাত্র আড়াইশ লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। অথচ শতভাগ উপকরণ দেশে উৎপাদন করলে, কয়েক হাজার লোক দরকার হতো।
'আমাদের দেশে শিল্পায়নে গুরুত্ব দেওয়া হলেও, ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজের বিষয়টি বরাবরই অবহেলিত থাকছে। কাঁচামাল ও যন্ত্রাংশ দেশে উৎপাদন করা না গেলে মূল্য সংযোজন বাড়বে না। কর্মসংস্থানও হবে না।'
দেশীয় শিল্প হিসেবে প্রযুক্তি পণ্যের উদ্যোক্তাদের করমুক্তি-সহ অন্যান্য সুযোগ দিতে, একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ মূল্যসংযোজনে বাধ্যবাধকতা আরোপের পরামর্শও দেন ফাহিম মাশরুর।
এনিয়ে বেসিস- এর বর্তমান সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবীর বলেন, 'দেশে সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট ও সলিউশন্স খাত একটি স্থিতিশীল অবস্থানে পৌঁছে গেছে। এখন সফটওয়্যার শিল্পের সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের হার্ডওয়্যার শিল্পকেও শক্তিশালী করতে হবে।'
দেশে কয়েক ডজন কোম্পানি বর্তমানে মোবাইল ফোন উৎপাদন করলেও, খুবই কম সংখ্যক প্রতিষ্ঠান ল্যাপটপ প্রস্তুতে গেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'প্রাথমিক অবস্থায় স্থানীয় কারখানাগুলো ডিজিটাল ডিভাইস শুধু সংযোজন করবে এটাই বাস্তবতা, দক্ষতা ও জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে আমাদের মূল্যসংযোজন একটি সন্তোষজনক মাত্রায় পৌঁছাতে বেশ সময় লাগবে।'
কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও মূল্যসংযোজন বাড়ানো নিয়ে তিনি একটি সুস্পষ্ট ভিশনের ওপর গুরুত্ব দেন।
একইসঙ্গে, রোডম্যাপ প্রণয়নের উদ্যোগটিকে স্বাগত জানিয়ে আলমাস কবীর বলেন, 'হাইটেক পার্ক স্থাপনে এখনও খুব কম বিনিয়োগ হওয়ায় এই রোডম্যাপটি খুবই দরকারি ছিল। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মধ্যে ডিজিটাল ডিভাইস শিল্পে সহায়তা দেওয়ার ব্যাপারে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। নতুন রোডম্যাপটি সমন্বয় নিশ্চিত করলে বিনিয়োগও বাড়বে।'