পণ্যের ট্র্যাকিং প্রযুক্তিতে বিনিয়োগে বাড়ছে আরএমজি অ্যাকসেসরিজ প্রবৃদ্ধি
অ্যাকসেসরিজ ও প্যাকেজিং উদ্যোক্তারা স্মার্ট ইনভেন্টরিতে আরএমজি (তৈরি পোশাক) পণ্য ট্র্যাক করতে রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি আইডেন্টিফিকেশন (আরএফআইডি) প্রযুক্তিতে প্রচুর বিনিয়োগ করেছেন। ফলে গত পাঁচ বছরে কারখানার সংখ্যা ছয় গুণ বেড়েছে।
একইসাথে অ্যাকসেসরিজ ও প্যাকেজিং শিল্পে পচনশীল ও পুনর্ব্যবহারযোগ্য পলি উপকরণ এবং কাগজভিত্তিক প্যাকেজিং উপকরণেও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বিনিয়োগ বেড়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যাকসেসরিজ অ্যান্ড প্যাকেজিং ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএপিএমইএ) তথ্য অনুযায়ী, পাঁচ বছর আগে যেখানে স্থানীয়ভাবে আরএফআইডি উৎপাদন করা কারখানা ছিল মাত্র পাঁচ থেকে ছয়টি, সেখানে এখন তা বেড়ে হয়েছে ৩০টি।
বিজিএপিএমইএ প্রেসিডেন্ট মো. শাহরিয়ার জানান, তার কোম্পানি বেশকিছু বাযারকে আরএফআইডি সরবরাহ করছে এবং এর চাহিদা দিন দিন বাড়ছেই।
তিনি এও জানান, শতাধিক কারখানা স্থানীয়ভাবে আরএফআইডি উৎপাদনে বিনিয়োগ করতে প্রস্তুত।
তিনি যোগ করেন, ''এসব বিনিয়োগ কেবল স্থানীয় পোশাক শিল্পকে প্রচ্ছন্ন রপ্তানির জন্য সহায়তা করবে না, বরং সরাসরি রপ্তানির সুযোগও সৃষ্টি করবে।''
প্রচ্ছন্ন রপ্তানি বলতে সেসব লেনদেনকে বোঝায় যেখানে পণ্য বা পরিষেবা দেশের অভ্যন্তরেই সরবরাহ করা হয়।
শাহরিয়ার আরও জানান, অ্যাকসেসরিজ ও প্যাকেজিং শিল্পের সরাসরি রপ্তানি বাজার বর্তমানে প্রায় ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যেখানে প্রচ্ছন্ন রপ্তানির বাজার ৮ বিলিয়ন ডলার।
আরএফআইডি স্বয়ংক্রিয়ভাবে তড়িৎ চুম্বকীয় ক্ষেত্র ব্যবহার করে ট্যাগ করা কোনো বস্তু খুঁজে পেতে বা চিহ্নিত করতে ব্যবহার করা হয়। ট্যাগ বা চিপটিতে ইলেক্ট্রনিক তথ্য সংরক্ষণ করে রাখা হয়।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সাথে আলাপকালে ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি ব্র্যান্ডের কান্ট্রি ম্যানেজার বলেছন, ''ইনভেন্টরি ব্যবস্থাপনা সহজ করার জন্য পাঁচ-ছয় বছর ধরে আমাদের ব্র্যান্ডের সব পণ্যে আরএফআইডি প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে।''
তিনি আরও বলেন, ''আরএফআইডি প্রযুক্তি কেবল ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলোই ব্যবহার করছে না, বরং কারখানা পর্যায়ে বাংলাদেশি পোশাক রপ্তানিকারকরাও এটি ব্যবহার করছে।''
কান্ট্রি ম্যানেজার আরও বলেন, বারকোডের ব্যবহার ফ্যাশন স্টোরের প্রতিটি সেলস পয়েন্টে প্রবেশ সহজ করে।
টিম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল্লাহ হিল রাকিব টিবিএসকে বলেন, কিছু ব্র্যান্ড মানুষের সম্পৃক্ততা কমাতে স্বয়ংক্রিয় লজিস্টিকস ও স্মার্ট ইনভেন্টরি ব্যবস্থা চালু করছে।
স্প্যানিশ ব্র্যান্ড ইন্ডিটেক্সের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ব্র্যান্ডটি স্বয়ংক্রিয় লজিস্টিকস চালুর কারণে আরএফআইডির চাহিদাও তৈরি হয়েছে।
তিনি আরও জানান, এই ট্র্যাকিং সিস্টেমের কারণে স্টোরের নিরাপত্তা ব্যবস্থাও আরও জোরদার হয়েছে।
রাকিব উল্লেখ করেন, টিম গ্রুপের অ্যাকসেসরিজ ইউনিটের বার্ষিক টার্নওভার প্রায় ২০ মিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে সরাসরি চীন, তুরস্ক, ইতালি ও ভারতে রপ্তানির পরিমাণ ৩ মিলিয়ন ডলার।
সাসটেইনেবিলিটি ও সার্কুলারিটিতে মনোযোগ
ইইউর আইন পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে ব্র্যান্ডগুলোর চাহিদা বিবেচনা করে সার্কুলারিটি বাড়াতে অ্যাকসেসরিজ ও প্যাকেজিং নির্মাতারা বায়োডিগ্রেডেবল (পচনশীল) ও পুনর্ব্যবহারযোগ্য পলি উপকরণেও বিনিয়োগ করেছেন।
বিজিএপিএমইএ সভাপতি শাহরিয়ার জানান, গত পাঁচ বছর ধরে পচনশীল ও পুনর্ব্যবহারযোগ্য পলি উপকরণের ব্যবহার বাড়ছে।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশের প্রায় ২০ শতাংশ রপ্তানিকৃত পোশাক পণ্য পচনশীল ও পুনর্ব্যবহারযোগ্য পলি উপকরণের ব্যবহার করছে। ২০২৬ সালের পর পরিবেশগত সমস্যা মোকাবিলায় আইনি পরিবর্তনের কারণে ১০০ শতাংশ পচনশীল ও পুনর্ব্যবহারযোগ্য পলি ব্যবহার করতে হবে।
৮০ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত রপ্তানিতে ভূমিকা রাখতে পারে এ শিল্প
শাহরিয়ার বলেন, বর্তমানে শিল্পটির যে সক্ষমতা রয়েছে, তা দেশের রপ্তানিকে ৮০ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত পৌঁছাতে সহায়তা করতে পারবে। তবে বায়ারদের নমিনেশনের কারণে রপ্তানিকারকদের কিছু অ্যাকসেসরিজ, ট্রিমস ও প্যাকেজিং উপকরণ আমদানি করতে বাধ্য হতে হয়। সরকারের নীতি সহায়তা পেলে শিল্পটি বায়ার কর্তৃক প্রত্যয়িত সরবরাহকারী পেতে পারে, যা এই খাতকে শতভাগ আমদানি বিকল্প করতে ভূমিকা রাখবে।
একসময় সম্পূর্ণ আমদানি নির্ভর হলেও এখন অ্যাকসেসরিজ ও প্যাকেজিং খাত স্থানীয় চাহিদার ৯০ শতাংশেরও বেশি পূরণ করছে। পোশাক রপ্তানিকারকেরা যেহেতু স্থানীয়ভাবেই অ্যাকসেসরিজ ও প্যাকেজিং পণ্য সংগ্রহ করতে পারছেন, তাই লিড টাইমের ক্ষেত্রেও উল্লেখজনক অগ্রগতি হয়েছে।
উল্লেখ্য, লিড টাইম হলো ক্রেতার কাছ থেকে রপ্তানি আদেশ পাওয়ার পর পোশাক তৈরি করে ক্রেতার হাতে পৌঁছানো।
শাহরিয়ার বলেছেন, করোনা মহামারির সময় যখন বাংলাদেশ কেবল ওষুধ আমদানি করছিল, সে সময় এই খাত রপ্তানি খাতের জন্য ১০০ ভাগ অ্যাকসেসরিজ ও প্যাকেজিং উপকরণ সরবরাহ করেছিল।
এখনও যেসব চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান
শিল্পের নেতারা উল্লেখ করেছেন, দেশের রপ্তানি খাতে অবদানের সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকা সত্ত্বেও বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের কারণে এই খাতের প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, যা স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে অসম প্রতিযোগিতা তৈরি করছে।
তিনি ব্যাখ্যা করেন, বেশিরভাগ ছোট ও মাঝারি আকারের অ্যাকসেসরিজ প্রস্তুতকারক এবং রপ্তানিকারকেরা বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতির কারণে এলসি (লেটার অব ক্রেডিট) খুলতে হিমশিম খাচ্ছেন, যেখানে বড় কোম্পানিগুলো সহজেই এটি করতে পারছে। ফলে ছোট কারখানাগুলো বাধ্য হয়ে উচ্চমূল্যে কার্ব মার্কেট থেকে ডলার কিনতে বাধ্য হচ্ছে। তাদের প্রায়ই প্রতি ডলারে চার থেকে পাঁচ টাকা বেশি দিতে হচ্ছে। আর এটি তাদের প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে উল্লেখজনক প্রভাব ফেলছে।
অন্যদিকে ছোট কারখানাগুলো উচ্চ সুদের হারের বোঝায় পড়েছে, যা ১৬ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। সেখানে বড় কোম্পানিগুলোর ক্ষেত্রে এই হার ছোট কারখানাগুলোর তুলনায় ১ থেকে ২ শতাংশ কম। ফলে অসম প্রতিযোগিতা আরও বাড়ছে।
তিনি বলেন, এ শিল্পে প্রায় এক হাজার ৬১০টি কারখানা রয়েছে। এগুলোর মধ্যে বড় কারখানা কেবল ৪০টি। আর তাদের বার্ষিক টার্নওভার ৩০ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি।
শাহরিয়ার আরও উল্লেখ করেন যে এ শিল্পে কিছু বিদেশি বিনিয়োগ রয়েছে। এর মধ্যে ৫০টি কারখানা রয়েছে যেখানে সরাসরি সম্পূর্ণ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) ও যৌথ অংশীদারিত্ব রয়েছে।
তিনি ব্যাখ্যা করেন, দেশের সম্ভাবনা বিবেচনায় আরও বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) আকৃষ্ট করার সুযোগ রয়েছে। তবে কঠিন ব্যবসায়িক পরিস্থিতির কারণে বিদেশি ও স্থানীয় বিনিয়োগ উভয়ই প্রায় স্থবির হয়ে রয়েছে।
শাহরিয়ার বিনিয়োগ আকর্ষণে প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, ক্রমবর্ধমান ইউটিলিটি মূল্য ও জ্বালানি সংকটের কথা উল্লেখ করেন। তিনি সরকারকে শিল্পের জন্য গ্যাস ও বিদ্যুতের পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করার এবং অর্থনীতির স্বার্থে কারখানা ও উদ্যোক্তাদের নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার আহ্বান জানান।
তিনি যোগ করেছেন, ''এই বছর ব্যবসা বাড়ানোর সুযোগ তৈরি করছে। তবে উদ্যোক্তারা আশা ও অনিশ্চয়তার মধ্যে আটকা পড়েছেন।''
এই খাত পণ্যের নকশা ও উদ্ভাবনের ওপর নির্ভর করে রপ্তানি করা পণ্যের মূল্য সংযোজনে ১৫ থেকে ৪০ শতাংশ অবদান রাখছে।
অনিশ্চয়তার জেরে কিছু কার্যাদেশ বাংলাদেশ থেকে স্থানান্তর
শাহরিয়ারের অভিযোগ- বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগের জেরে কিছু কার্যাদেশ অন্য দেশে চলে গেছে।
গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনের ফাঁকে তিনি বলেন, মূলত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কারণে আনুমানিক ১৫-২০ শতাংশ কার্যাদেশ প্রতিযোগী দেশগুলোতে চলে গেছে। তবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে বায়াররা আবারও বাংলাদেশে ফেরার বিষয়ে আগ্রহ দেখিয়েছেন। কারণ, তারা এখনও বাংলাদেশকে বিশ্বাস করেন।
তিনি উল্লেখ করেন, তার বায়ার টার্গেট অস্ট্রেলিয়া কিছু কার্যাদেশ সরিয়ে ভারতকে দিয়েছে।