৮৫ গুণ ব্যয় বাড়িয়ে চীনা স্টাইলের রেল স্টেশন
ফরিদপুরের ভাঙ্গায় চীনের ডিজাইন ও স্টাইলে রেলস্টেশন ভবন নির্মাণের উদোগ নিয়েছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। এতে মূল বরাদ্দের চেয়ে ব্যয় বাড়বে ৮৫ গুণ।
মূল প্রকল্পে ৭১৯ বর্গমিটারের এই স্টেশন নির্মাণে বরাদ্দ রাখা হয়েছিল ৩ কোটি ৩২ লাখ টাকা। চীনের প্রস্তাবিত ডিজাইনে ৬৫১৬ বর্গমিটার জায়গাজুড়ে স্টেশন নির্মাণে ব্যয় হবে ২৮৩.৩২ কোটি টাকা।
পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পের আওতায় ঢাকা থেকে মাওয়া হয়ে যশোর পর্যন্ত নির্মাণাধীন রেল লাইনে ভাঙ্গাসহ মোট ১৭টি স্টেশন নির্মাণ করা হচ্ছে। এসব স্টেশন নির্মাণে বরাদ্দ রাখা আছে ৩৬.৬১ কোটি টাকা। এর মধ্যে নতুন স্টেশন নির্মাণ করা হচ্ছে ১৪টি । পুনঃনির্মাণ হবে তিনটি রেল স্টেশন।
রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে গ্রুপ লিমিটেডকে (সিআরইসি) দিয়ে ভাঙ্গা রেলস্টেশন ভবন নির্মাণের ধারণাগত নকশা ও প্রাথমিক ব্যয় প্রস্তাব তৈরি করিয়েছে মন্ত্রণালয়। রেলমন্ত্রীর চূড়ান্ত অনুমোদন পেলে নকশা চূড়ান্ত করবে সিআরইসি।
প্রকল্প পরিচালক গোলাম ফখরুদ্দিন এ চৌধুরী জানান, রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজনের নির্দেশনায় ভাঙ্গা রেল স্টেশন নির্মাণে ধারণাগত নকশা এবং প্রাথমিক ব্যয় প্রস্তাব তৈরি করা হয়েছে। এটি এখন চূড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। মন্ত্রীর অনুমোদন পেলে প্রকল্প সংশোধনের প্রক্রিয়া শুরু হবে।
তিনি বলেন, উন্নত দেশগুলোর মতো যাত্রীদের জন্য সর্বাধুনিক সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা রেখে ভাঙ্গায় চাইনিজ স্টাইলে ভবন নির্মাণ হবে। স্টেশন যাত্রীদের জন্য বড় ওয়েটিং রুম থাকবে। থাকবে রেস্তোরাঁসহ অন্যান্য সুযোগসুবিধা। বিনা টিকেটে কোনো যাত্রী স্টেশনে প্রবেশ করতে পারবেন না।
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ড. শামসুল হক বলেন, আগের প্রস্তাবের তুলনায় নতুন প্রস্তাবে পূর্ত কাজের আকার বাড়লে খরচও বাড়বে। তবে খরচ বাড়ানোর আগে যাত্রীসেবা কতটুকু বাড়বে, সেটা বিবেচনায় নেওয়া উচিত। ২৮৩ কোটি টাকায় একটা রেলস্টেশন নির্মাণ কতটা যৌক্তিক, তা-ও খতিয়ে দেখা দরকার।
প্রকল্প প্রস্তাব পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, যাত্রীদের জন্য আধুনিক যেসব সুবিধা থাকা দরকার, তার প্রায় সবগুলোই অনুমোদিত বর্তমান নকশায় রয়েছে। তবে ভবন ও বিভিন্ন কক্ষের আকারে পার্থক্য আছে।
প্রকল্পের মূল নকশায় পদ্মার রেলসংযোগের স্টেশনগুলোতে আলাদা এন্ট্রি অ্যান্ড এক্সিট অ্যাকসেস কন্ট্রোল (দু'প্রাপ্তে র্যাম্পবিহীন উঁচু প্ল্যাটফরম ও ফেন্সিং) টিকেট পাঞ্চিং সিস্টেমের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
শারীরিক প্রতিবন্ধীদের জন্য র্যাম্প, আলাদা টিকেট কাউন্টার ও আলাদা টয়লেট নির্মাণ করা হবে। তাছাড়া স্টেশনগুলোতে পুরুষ ও মহিলাদের জন্য আলাদা প্রার্থনা কক্ষ, বেবি ডায়াপার পরিবর্তন ও ফিডিং কর্নারের সুবিধা থাকবে।
ট্রেন আসা ও ছেড়ে যাওয়ার সম্পর্কিত তথ্য জানানোর জন্য থাকবে এলইডি ডিসপ্লে। আন্ডারপাস ও ফুটওভার ব্রিজে সিঁড়ি বা লিফট অথবা এক্সেলেটরের সুবিধা থাকবে।
কমার্শিায়াল স্পেসে এটিএম বুথ, ফুড কোর্ট, রেস্তোরাঁ ও অন্যান্য দোকানের জায়গা বরাদ্দ থাকবে। এছাড়া গাড়ি পার্কিং, ওয়াইফাই, সুপেয় পানি, লাগেজ-ট্রলিসহ বিভিন্ন সুবিধা বর্তমান নকশায় রাখা হয়েছে।
অন্যদিকে, ভাঙ্গা স্টেশনের জন্য সিআরইস্যার চায়নিজ স্টাইলের স্টেশন নির্মাণের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, এই ভবনে একটি বা দুটি স্কয়ার এবং একটি টার্মিনাল বিল্ডিং থাকবে। সেখানে আলাদা এন্ট্রি ও এক্সিট, টিকেট ক্রয় কক্ষ, টিকেট পাঞ্চিং সুবিধা, বিশ্রামাগার, বোর্ডিং গেট, রেস্তোরাঁ, নির্দেশনা বোর্ড, লাগেজ লকার, লেফট-লাগেজসহ অন্যান্য আধুনিক সুবিধা থাকবে।
যাত্রীসংখ্যার ওপর ভিত্তি করে চীনে ছয় ধরনের রেলওয়ে স্টেশন রয়েছে। প্রথম সারির স্টেশনগুলোতে রয়েছে দৈনিক ৫০ হাজারের বেশি যাত্রী ব্যবস্থাপনার সক্ষমতা। এসব স্টেশন শুধু ট্রান্সপোর্ট হাবই নয়, এগুলো চীনের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ধারক হিসেবেও বিবেচিত হয়।
চীনে রেলস্টেশনের ভবনগুলো বিশাল জায়গাজুড়ে নির্মাণ করা হয়। ছোট সাইজের ভবনগুলো ৩ হাজার বর্গমিটারের এবং বড় আকারের স্টেশনগুলো সাধারণত ৪০ হাজার বর্গমিটার স্পেসে নির্মাণ করা হয়।
পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পে ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত যেসব স্টেশন নির্মাণ করা হবে, স্থান স্বল্পতার কারণে কোথাও চায়নিজ স্টাইলে স্টেশনভবন নির্মাণ করা সম্ভব নয়। এ বিবেচনায় আপাতত শুধু ভাঙ্গা স্টেশনটি চাইনিজ স্টাইলে নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছে বলে রেলওয়ের কর্মকর্তারা জানান।
রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সালের ২২-৩১ আগস্ট রেলমন্ত্রী চীন সফরকালে দেশটির সার্বিক রেল যোগাযোগ এবং আধুনিক রেলস্টেশনগুলো পর্যাবেক্ষণ করেন। পরে পদ্মা রেলসংযোগ প্রকল্পের আওতায় নির্মাণাধীন স্টেশনগুলোতে আলাদা এন্ট্রি অ্যান্ড এক্সিট অ্যাকসেস কন্ট্রোল এবং আধুনিক সুবিধাসহ চাইনিজ স্টাইল অনুসরণের নির্দেশনা দেন।
এ প্রেক্ষিতে সিআরইসির মাধ্যমে একটি ধারণাগত নকশা এবং প্রাথমিক ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়। সিআরইসি ৬ হাজার ৫১৬ বর্গমিটার এলাকায় স্টেশন ভবন নির্মাণের যে নকশা দেয়, তাতে ব্যয় ধরা হয় প্রায় ২৩০ কোটি টাকা। এর সঙ্গে ভূমি অধিগ্রহণ ও ঠিকাদারের ক্লেইম যুক্ত হলে মোট ব্যয় দাঁড়াবে ২৮০ কোটি টাকা।
রেলওয়ের কর্মকর্তারা জানান, পদ্মা সেতুর চালু প্রথম দিন থেকেই এই সেতু দিয়ে ট্রেনও চালু করতে চায় সরকার। এ কারণে ভাঙ্গায় ভূমি অধিগ্রহণে না গিয়ে রেল লাইনের ওপর স্টেশনভবন নির্মাণের কথা ভাবা হচ্ছে। এক্ষেত্রে ভূমি অধিগ্রহণ বাবদ ব্যয় কিছুটা কমতে পারে।
ভাঙ্গাসহ ১০টি স্টেশন চীনা স্টাইলে নির্মাণ করতে হলে অতিরিক্ত ব্যয় হবে ২৮০০ কোটি টাকা, বাস্তবায়নে বাড়তি সময় লাগবে ৪ বছর। ব্যয় ও সময় বৃদ্ধির বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে ১০টির বদলে শুধু ভাঙ্গা রেলস্টেশনটি চীনা স্টাইলে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।