৩ মাসে লবণের দাম দ্বিগুণ হওয়ায় উদ্বিগ্ন চামড়া ব্যবসায়ীরা
ঈদ-ঊল-আজহাকে কেন্দ্র করে চামড়া ব্যবসায়ী ও প্রক্রিয়াজাতকারীরা জমজমাট ব্যবসা করলেও গত তিন মাসে লবণের দাম দ্বিগুণ হওয়ায় তারা উদ্বিগ্ন।
চলতি ২০২১-২০২২ অর্থবছরে দেশে রেকর্ড পরিমাণ লবণ উৎপাদিত হয়েছে। কিন্তু এরপরও গত তিন মাস ধরে ঊর্ধ্বমুখী পণ্যটির দাম।
রিফ লেদার লিমিটেডের পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড সেলস) মোখলেসুর রহমান বলেন, "চামড়া শিল্পের প্রধান কাঁচামাল লবণ। আকারভেদে প্রতিটি চামড়া সংরক্ষণে ৮ থেকে ১২ কেজি লবণ প্রয়োজন হয়। করোনা মহামারি কাটিয়ে বাজারে চামড়ার চাহিদা ও দাম কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু লবণের দাম বৃদ্ধির কারণে উৎপাদন খরচ অনেক বেড়ে গেছে। এতে এই খাতের ব্যবসায়ীরা আবারো বিপাকে পড়েছেন।"
চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তদার ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি লিমিটেডর সাবেক সভাপতি মোছলেম উদ্দিন বলেন, "গত তিন মাসের ব্যবধানে লবণের দাম প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে গেছে। রমজানের আগে ৫৫০ টাকা দরে প্রতি বস্তা (৭৪ কেজি) লবণ বিক্রি হলেও এখন তা ১,২০০ টাকায় ঠেকেছে।"
লবণের দাম বৃদ্ধির কারণে চামড়া সংরক্ষণের খরচও বেড়ে গেছে। আগে ক্রয় মূল্য, লেবার এবং লবণ মিলে প্রতি বর্গফুট চামড়াতে আমাদের খরচ হতো ১০-১২ টাকা। লবণের দাম বৃদ্ধির ফলে এখন খরচ পড়ছে ১৮-২০ টাকা। লবণের এই দাম বৃদ্ধির কারণে আসন্ন কোরবানির ঈদে চামড়া সংরক্ষণে ব্যবসায়ীদের বিপাকে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক)-এর তথ্যমতে, এবছর সারা দেশে মোট ১৮ লাখ ৩২ হাজার টন লবণ উৎপাদন হয়েছে। যা বাংলাদেশের ইতিহাসে রেকর্ড। গত অর্থবছরে লবণ উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ১৬ লাখ ৫১ হাজার টন। এর আগে ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১৫ লাখ ৭০ হাজার টন, ২০১৮-১৭ অর্থবছরে ১৫ লাখ ৭০ হাজার টন ও ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১৮ লাখ ২৪ হাজার টন লবণ উৎপাদিত হয়েছিল।
বিসিক চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক (শিল্প উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ) মোহাম্মদ জাকির হোসেন বলেন, "অনুকূল আবহাওয়া, চাষ যোগ্য জমি ও চাষির সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় বিপুল পরিমাণ লবণ উৎপাদন হয়েছে। মাত্র ৬ হাজার একর জমিতে শুরু হওয়া লবণ চাষ এখন ৬৩ হাজার একর ছাড়িয়েছে। চলতি অর্থবছরে ৩৭ হাজার ২৩১ জন চাষ লবণ চাষ করেছেন। এ সংখ্যা গত অর্থবছরে ছিল ২৭ হাজার ৬৯৭ জন।
রেকর্ড পরিমাণ লবণ উৎপাদন হলেও গত তিন মাস ধরে বেড়েই চলেছে পণ্যটির দাম। এই সময়ে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে শিল্পের কাাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত লবণের দাম। গত তিন মাস প্রায় দ্বিগুণ দাম বাড়ায় বেশি বিপাকে পড়েছে চামড়া শিল্পের ব্যবসায়ীরা।
বাংলাদেশ টেনার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি শাহীন আহমেদ বলেন, "প্রতি বছর দেশে গড়ে ১ কোটি ৬৫ লাখ পিস কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করা হয়, যার মধ্যে ছাগলের চামড়া ১ কোটি, গরুর চামড়া ৫০ লাখ এবং ভেড়া ও মহিষ মিলে ১৫ লাখ। গড়ে ৫ কেজি হিসাব করলেও এই শিল্পে কমপক্ষে ৮০ হাজার থেকে এক লাখ টন পর্যন্ত লবণের চাহিদা রয়েছে। কিন্তু হঠাৎ লবণের দাম বৃদ্ধিতে আমাদের উৎপাদন খরচ অনেক বেড়ে গেছে। এমনকি আসন্ন কোরবানির ঈদে চামড়া সংরক্ষণ নিয়ে আমরা চিন্তিত।"
ভোগ্যপণ্যের পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জের লবণ ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, রমজানের আগে আয়োডিনবিহীন প্রতি বস্তা (৭৪ কেজি) সাদা লবণের (চামড়া শিল্প ও পশু খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত) দাম ছিল ৫৫০-৬০০ টাকা। যা এখন ১১০০-১২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
শিল্পের লবণের পাশাপাশি দাম বেড়েছে আয়োডিনযুক্ত খাবার লবণেরও। গত তিন মাসে খাওয়ার লবণের দাম কেজিতে ৭-৯ টাকা করে প্রতি বস্তায় (২৫ কেজি) ২৩০ টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে।
বর্তমানে ২৫ কেজি ওজনের প্রতি বস্তা কনফিডেন্স ভ্যাকুয়াম লবণ ৬২০ টাকা থেকে বেড়ে ৮৫০ টাকা, এসিআই পিওর সল্ট ৫৮০ থেকে ৭৯০ টাকা, ফ্রেশ ৬০০ থেকে ৮২০ টাকা এবং মুসকান ৫৮০ থেকে ৭৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আগামী কয়েক দিনের মধ্যে লবণের দাম আরও এক দফা বাড়তে পারে বলে জানিয়েছেন এসব কোম্পানির পণ্য বিপণনে থাকা একাধিক কর্মকর্তা।
দাম বৃদ্ধির কারণ সম্পর্কে কোহিনূর সল্টের স্বত্বাধিকারী মো: ফরিদ উদ্দিন বলেন, আগের চেয়ে উৎপাদন বাড়লেও সেই সাথে বছর বছর চাহিদাও বেড়ে চলেছে। উৎপাদিত লবণের চেয়ে প্রায় ৫ লাখ লবণের ঘাটতি রয়েছে। যা প্রতিবছর আমদানি করে চাহিদা মেটানো হয়। কিন্তু এবছর এখনো পর্যন্ত লবণ আমদানির অনুমোদন না মেলায় মিল মালিকরা পণ্যটির দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। এতে চাষীদের চেয়ে মূলত কারখানা মালিক ও প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো লাভবান হচ্ছে।
বিসিকের তথ্যমতে, বছর বছর দেশে লবণের চাহিদা বাড়ছে। চলতি অর্থবছরে দেশে ২০২১-২২ অর্থবছরে লবণের চাহিদা ২৩ লাখ ৩৫ হাজার টন। গত বছর ২০২০-২১ অর্থবছরে এই চাহিদা ছিল ২২ লাখ ৫৬ হাজার টন। এর আগে ২০১৯-২০ সালে ১৮ লাখ ৪৯ হাজার টন এবং ২০১৮-১৯ সালে ছিল ১৬ লাখ ৫৭ হাজার টন।