‘বাংলাদেশকে চাপে ফেলেছে’ বিশ্বের অন্যত্র তৈরি হওয়া অর্থনৈতিক পরিস্থিতি
ঢাকার উপকন্ঠে আশুলিয়ায় একটি পোশাক কারখানার মালিক- মোহাম্মদ শরীফ সরকার। সুপরিসর তিন তলাজুড়ে গড়ে ওঠা এ প্রতিষ্ঠান অনেক দিক থেকেই শিল্পোন্নয়নের মডেল। এখানকার অ্যাসেম্বলি লাইনের সুশৃঙ্খল সারিতে পাশাপাশি বসেছিলেন শত শত তরুণ-তরুণী। সামনে থাকা আধুনিক সেলাই মেশিন; যা দিয়ে রপ্তানি বাজারের জন্য মাথায় পরার ক্যাপ সেলাইয়ের কাজ চলে বেশিরভাগ সময়ে।
কিন্তু, সমস্যা একটাই। ঘোর অন্ধকারে বসেছিলেন শরীফ ও তার কর্মীরা। বিদ্যুৎহীনতায় অলস পড়েছিল সারি সারি সেলাই মেশিন। এই অবস্থা গত জুলাইয়ে বাংলাদেশ সরকারের ঘোষিত লোডশেডিংয়ের কারণেই। তীব্র জ্বালানি সংকটের মুখে ওই সময়ে সরকার এ পদক্ষেপ নেয়।
তার ওপর আবার সম্প্রতি জ্বালানি তেলের দাম রেকর্ড ৫১ শতাংশ বাড়ানো হয়। একারণে খরচ বাঁচাতে লোডশেডিং হলে ডিজেল-চালিত জেনারেটর চালান না শরীফ সরকার। এই ফাঁকে কর্মীরা তাদের দুপুরের খাবার সেরে নেয়।
শরীফ বলেন, '(জ্বালানিসহ) সবকিছুর দাম এভাবে বাড়তে থাকলে এই খাতে অস্থিতিশীলতা তৈরি হবে। প্রতিষ্ঠান চলতে না পারলে, ব্যবসা বন্ধ হবে। দিনশেষে তাতে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ শ্রমিকের'।
বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র দেশের সারি থেকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উত্তরণের চালিকাশক্তি এই পোশাক কারখানাগুলি। সেই সুবাদে, চীনের পর দ্বিতীয় বৃহৎ তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক আজ বাংলাদেশ। বিপুল সংখ্যক নারীর কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করেছে এই খাত। আর্থিকভাবে নারীর ক্ষমতায়নের সুবাদে, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সূচকেও বাংলাদেশ এগিয়েছে।
প্রায় ২০০ কোটি জনসংখ্যা দক্ষিণ এশিয়ায়। এ অঞ্চলের বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা অন্য প্রতিবেশীদের চেয়ে অর্থনৈতিক বিকাশে এগিয়ে যাচ্ছিল– বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় সক্ষম এমন পণ্য রপ্তানি খাতের সুবাদে।
উন্নয়নের এই গতিতে ছেদ ঘটায় কোভিড-১৯ মহামারি। তারপর ১৬ কোটির বেশি জনতার বাংলাদেশের জন্যও একের পর এক আঘাত হয়ে এসেছে জ্বালানি ও খাদ্যের চড়া দাম। মহামারি পরবর্তী সময়ে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর, যা নতুন মাত্রা লাভ করেছে।
আনুষ্ঠানিকভাবে বলা হচ্ছে, চড়া দামের কারণে জ্বালানি আমদানি কমলেও বেড়েছে তার খরচ। এতে সরকারের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের সক্ষমতাও চাপের মধ্যে পড়েছে।
তবে বাস্তবতা হলো– দক্ষিণ এশিয়ার সেসব দেশই অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে পড়ছে– যাদের সরকার অপরিণামদর্শী লাগামহীন ব্যয়ের নীতি চালিয়ে গেছে। উন্নয়ন অর্থনীতির মডেল হিসেবে বড় বড় অবকাঠামো প্রকল্পে ব্যয় এই সংকটের অন্যতম কারণ। যার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত- শ্রীলঙ্কা।
এই পরিস্থিতি, বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল উদীয়মান বাজার অঞ্চলে কয়েক প্রজন্ম ধরে অর্জিত অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে আবারও পেছনে ঠেলে দেওয়ার ঝুঁকি সৃষ্টি করেছে। চীন ও ভারতের মতো প্রভাবশালী দেশের স্বার্থের সম্মিলনও ঘটেছে এখানে । উভয়েই দক্ষিণ এশীয় অপেক্ষাকৃত ছোট প্রতিবেশীদের ওপর নিজস্ব প্রভাব-প্রতিপত্তি বা নিয়ন্ত্রণ দৃঢ় করতে চায়। মহামারির আগে এই দৌড়ে এগিয়ে ছিল চীন। হয়ে উঠেছিল, ভারতের চিরশত্রু পাকিস্তানসহ আরেক নিকট প্রতিবেশী শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে বড় ঋণদাতা। এনিয়ে গভীর উদ্বেগে ছিল নয়াদিল্লি। এবার দেশগুলির সরকার সংকটে পড়ায়, ভারত একে নিজের হাত শক্তিশালী করার সুযোগ হিসেবে দেখছে।
জাতিসংঘ ও বিশ্বব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা মার্ক ম্যালোখ ব্রাউন অবশ্য বলেছেন, 'ভিন্ন ভিন্ন অর্থনৈতিক মডেল ও পারফরম্যান্সের দেশগুলোকে শাস্তি দিচ্ছে এই সংকট। বাংলাদেশের আছে আন্তর্জাতিকভাবে সম্পৃক্ত একটি অর্থনীতি। পোশাক খাতের জন্য দেশটি সুপরিচিত। কিন্তু, বিশ্বের অন্যখানে উদ্ভূত অর্থনৈতিক পরিস্থিতি দেশটির শ্বাসরোধ করছে'।
সংকট থেকে বাংলাদেশ অন্যদের চেয়ে নিরাপদ দূরত্বে ছিল
গত মে মাসে দুই দশকের মধ্যে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের প্রথম দেশ হিসেবে ঋণখেলাপি হয় শ্রীলঙ্কা। দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসের অর্থনীতি নিয়ে 'নয় ছয়' করার পরিণাম ছিল এটি। এক পর্যায়ে বিক্ষুদ্ধ জনতা দেশজুড়ে বিক্ষোভ শুরু করে; জুলাই মাসে এক সামরিক বিমানে দেশ ছাড়েন গোতাবায়া।
পাকিস্তানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদের অভিযোগে মামলা করেছে সরকার। এতে দেশটি আরও বড় ধরনের রাজনৈতিক নৈরাজ্যের দিকে এগিয়ে চলেছে। একইসময়, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)- এর ঋণ চাইছে ইসলামাবাদ। খেলাপি এড়াতে অন্যান্য ঋণদাতাদের সাথেও দ্বিপাক্ষিক আলোচনা করছে।
বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির চাপে ঝুঁকিতে রয়েছে অপেক্ষাকৃত ছোট দুই দেশ– নেপাল আর ভূটানও।
সে তুলনায়, সাম্প্রতিক সময়ের আগপর্যন্ত বিশ্ব অর্থনীতির অভিঘাত থেকে অনেকটাই নিরাপদ দূরত্বে ছিল বাংলাদেশ। এর পেছনে বড় অবদান ছিল রপ্তানি খাতের সাফল্য। কিন্তু, গত জুলাইয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের ঘাটতি পূরণে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে সহনশীলতা তৈরিতে ঋণ পেতে আইএমএফের দ্বারস্থ হয়।
বাংলাদেশ আইএমএফ থেকে প্রায় ৪৫০ কোটি ডলার চায়; বিশ্বব্যাংক ও এডিবিসহ অন্যান্য দাতাদের কাছে চাইছে আরও প্রায় ৪০০ কোটি ডলার।
দেশে সাম্প্রতিক সময়ে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধিতে সরকারের সমালোচনা হয়েছে। আমদানি করা জ্বালানির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ব্যয় হয় বিদ্যুৎ উৎপাদনে। তাই সরকার সাশ্রয়ের অংশ হিসেবে- সপ্তাহে দুই দিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কমিয়েছে অফিসের কর্মঘণ্টা। বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে বিলাসপণ্য আমদানিতে কড়াকড়ি আরোপ করেছে।
দীর্ঘদিন ধরে লালিত সমস্যা মাথাচাড়া দিয়েছে ঘানা বা ইথিওপিয়া থেকে শুরু করে চিলির মতো বিশ্বের অন্যান্য মহাদেশের উন্নয়নশীল দেশেও। এতে তারা ১৯৮০'র দশকের পর সবচেয়ে তীব্র রাষ্ট্রীয় দেনা সংকটের মুখোমুখি। তাদের সাথে দক্ষিণ এশীয় দেশগুলিরও বেশকিছু মিল রয়েছে।
যেমন- দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলিও জ্বালানি সম্পদ আমদানির ওপর বহুল নির্ভরশীল। খাদ্যপণ্য ও ভোজ্যতেল আমদানিতেও নির্ভরশীলতা ব্যাপক। একারণেই আমদানি কম হওয়ায় গত জুলাইয়ে ডিজেল-চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বাংলাদেশে।
এই অঞ্চলের কিছু দেশ- চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) অধীনে অবকাঠামো নির্মাণে বড় ঋণও নিয়েছে। এতে তৈরি হয়েছে, দেনা নিষ্পত্তি নিয়ে সমস্যা দেখা দেওয়ার ভূরাজনৈতিক ঝুঁকি–যা আঞ্চলিক অর্থনীতিগুলিকে আরও দুর্দশার দিকে ঠেলে দিতে পারে।
বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল অবশ্য জোর দিয়েই বলেছেন, 'সব দেশ চাপের মধ্যে রয়েছে'। তবে প্রতিবেশী কিছু দেশের মতোন- গভীর আর্থিক দুর্দশার পড়ার ঝুঁকিতে নেই বাংলাদেশ। শ্রীলঙ্কার মতো দেশে যা হচ্ছে 'তার সাথে বাংলাদেশের (সংকটের) কোনো মিল নেই' উল্লেখ করে তিনি বলেন, ঋণদাতারা 'আমাদের প্রকল্পগুলি সম্পর্কে, আমাদের ব্যালান্স শিট সম্পর্কে ভালোভাবেই জানে। তারা জানে, ঋণদানের জন্য বাংলাদেশ নিরাপদ জায়গা'।
গত জুনে উদ্বোধন হওয়া স্থানীয় অর্থায়নে নির্মিত পদ্মা সেতুর কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, এতে রাজধানী ঢাকার সাথে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের চলাচল ও পণ্য পরিবহনের সময় ও খরচ উল্লেখযোগ্য হারে কমবে, যা দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করবে।
আইএমএফ-ও বলছে, বাংলাদেশের জিডিপির তুলনায় ঋণ-অনুপাত ৩৯ শতাংশ। প্রতিবেশীদের চেয়ে এটি কম হওয়ায়– বাংলাদেশ 'কোনো সংকটের মধ্যেই নেই'। তবে 'বৈশ্বিক অর্থনীতির সাম্প্রতিক অনিশ্চিয়তার ঘটনাপ্রবাহে' বাংলাদেশ বড় ধরনের ঝুঁকিতে রয়েছে বলেও সতর্ক করেছে।
তবে আঞ্চলিক অর্থনীতির অস্থিতিশীলতা ভারতকে উদ্বিগ্ন করছে। এই সংকট থেকে দিল্লি মুক্ত থাকলেও গত জুলাইয়ের শেষ নাগাদ দেউলিয়াত্বের শিকার প্রতিবেশী শ্রীলঙ্কাকে ঋণ ও অন্যান্য সহায়তা বাবদ ৩৮০ কোটি ডলার দিয়েছে।
ম্যালখ ব্রাউন বলেন, দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর সাম্প্রতিক সময়ের অভিজ্ঞতা প্রমাণ করছে উদীয়মান বাজারগুলির ওপর যে চাপ সৃষ্টি হয়েছে, তা আসলে সার্বিকভাবে 'বিশ্ব অর্থনীতিকে ঝুঁকির মুখে ফেলা পদ্ধতিগত সংকটের অংশ'।
এটি মোকাবিলায় তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধত্তোর সময়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতিগুলোর পুনর্গঠনে নেওয়া 'মার্শাল প্ল্যানের' মতো একটি আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ নেওয়ার আহবান জানান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমির মতপ্রকাশ করেন যে, বাংলাদেশের কর্মীরা গত কয়েক দশকে অক্লান্ত পরিশ্রম করে যে অর্থনৈতিক অর্জন এনেছেন–তার সুরক্ষায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসতে হবে। 'আপনি দেখতে পাবেন, আমাদের দেশের শ্রমজীবী মানুষের এক ধরনের অদম্যতা রয়েছে। পশ্চিমা দুনিয়া ও দাতা সংস্থাগুলোর সেদিকে লক্ষ করা উচিত। এই অর্জন ধূলিসাৎ হতে দেয়া ঠিক হবে না'।
- সূত্র: ফিন্যান্সিয়াল টাইমস