শিমুল আলুর খোসা থেকে পরিবেশবান্ধব ব্যাগ: বছরে ৫০ কোটি টাকার পণ্য রপ্তানি করছে ইকোস্পিয়ার
২০০২ সালে বাংলাদেশ বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে প্লাস্টিকের ব্যাগ নিষিদ্ধ করে। অভূতপূর্ব সেই পদক্ষেপটি বেশ প্রশংসিত হয়েছিলো। তবে সেই আইন পাশের বিশ বছর পরেও দৃশ্যপট বদলায়নি। সকাল-বিকাল প্লাস্টিকের ব্যাগ হাতে মানুষের বাড়ি ফেরা আর সেই ব্যাগ যত্রতত্র ছুঁড়ে ফেলার চিত্র নিত্যকার।
পরিবেশ বিধ্বংসী এই ঘটনাটি যখন সবাই স্বাভাবিক হিসেবে মেনে নিয়েছে; তখন চট্টগ্রামের এক যুবক প্রচলিত প্লাস্টিক ব্যাগের বিকল্প খোঁজা শুরু করেন। ২০১৮ সালে ইন্দোনেশিয়ার প্রযুক্তিগত সহযোগিতা নিয়ে কাসাভা (শিমুল আলু) থেকে দেশেই পরিবেশবান্ধব ব্যাগের উৎপাদন শুরু করেন তিনি। এখন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও কানাডায় প্রতিবছর প্রায় ৫০ কোটি টাকার পরিবেশবান্ধব ব্যাগ রপ্তানি করছে দেশি প্রতিষ্ঠান ইকোস্পিয়ার।
ইকোস্পিয়ার এর প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী মোহাম্মদ রায়হান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'সময়টা ২০১৬ সালের মে মাস। আমরা তখন চট্টগ্রামের হালিশহরে বসবাস করছিলাম। ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর আঘাতে শহরের উপকূলবর্তী এলাকার পুরোটাই ডুবে গেছে। এ দুর্যোগের মাঝে আমি আরও একটি মহা দুর্যোগ আবিষ্কার করলাম। পানি নেমে যেতেই শহরের সব রাস্তা ও নালাগুলোকে প্লাস্টিকে প্লাবিত অবস্থায় পেলাম। তখনই আমি প্লাস্টিকের বিকল্প নিয়ে খোঁজ শুরু করি।'
২০১৭ সালে ইন্দোনেশিয়াসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে কাসাভা নামের এক ধরনের আলুর খোসা ব্যবহার করে পরিবেশবান্ধব (বায়োডিগ্রেডেবল) ব্যাগ তৈরী শুরু হয়। ২০১৮ সালে ইন্দোনেশিয়া থেকে একটি মেশিন আমদানি করে চট্টগ্রামের হালিশহরে কারখানা স্থাপন করে মোহাম্মদ রায়হান। বর্তমানে রাজধানীর তেজগাঁও এলাকায় তাদের একটি কারখানা আছে। যেখানে কাসাভা, ভুট্টা ও পিবিএটি (বায়োম্যাটেরিয়াল) ব্যবহার করে প্রতিমাসে ১৫ টনের বেশি পরিবেশবান্ধব প্লাস্টিকের ব্যাগ তৈরী করা হয়।
মোহাম্মদ রায়হান বলেন, 'সাধারণ প্লাস্টিক যেখানে ৪০০ বছরেও পচে না। সেখানে কাসাভা ও ভুট্টা থেকে তৈরী ৩০ মাইক্রনের ব্যাগগুলি ৯০ দিন এবং ৫৫ মাইক্রনের ব্যাগগুলি একবার ফেলে দেওয়া হলে প্রাকৃতিকভাবে সম্পূর্ণ বায়োডিগ্রেড হতে ১৪৭ দিন লাগে। আর গরম পানিতে এটি মাত্র তিন মিনিটেই তরলে পরিণত হয়। বায়ো-ডিগ্রেডেবল এই ব্যাগ পুনঃব্যবহারেরও সুযোগ রয়েছে। তাছাড়া বিসিএসআইআর ল্যাবে পরীক্ষা করে ইকোস্পিয়ারের পণ্যগুলোতে প্লাস্টিকের কোনো উপাদান পাওয়া যায়নি।'
কাসাভা দিয়ে ব্যাগ উৎপাদনের পাশাপাশি ২০২১ সাল থেকে ইকোস্পিয়ার পরিবেশবান্ধব প্লাস্টিক তৈরীর সর্বাধুনিক প্রযুক্তি পলিমেটেরিয়া-এর ব্যবহার করছে। ইকোস্পিয়ার পরিবেশবান্ধব এ প্লাস্টিকের নামকরণ করেছে ফাসটিক্স (FASTIX)। এটি মাটিতে মিশে যেতে সময় নেয় মাত্র ১৮ মাস। ফাসটিক্স দিয়ে উৎপাদন করা হচ্ছে কাপ, বোতল, স্ট্র, লন্ড্রিব্যাগ, জুস ক্যাপ, প্যাকেজিং ব্যাগ, হোয়াইট পলি, গার্মেন্টস পলিব্যাগ ও ফুড কনটেইনার। প্রতিমাসে এ জাতীয় দুই টন ফাসটিক্স পণ্য তৈরী করছে ইকোস্পিয়ার। এসব পণ্যের গ্রাহকদের তালিকায় রয়েছে আমেরিকার প্যাবেল চাইল্ড এর মতো বিশ্বখ্যাত শিশুদের খেলনা প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানও।
ইকোস্পিয়ার এর প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ রায়হান বলেন, 'দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় যেটিকে কাসাভা বলা হয়, সেটি মূলত আমাদের দেশের শিমুল আলু। কিন্তু দেশে এই আলুর খোসা প্রসেসিং করার কোনো যন্ত্র না থাকায় আমরা ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া থেকে প্রক্রিয়াজাত খোসা (রেজিন) আমদানি করে পণ্য উৎপাদন করি। তবে আমরা ধীরে ধীরে ফাসটিক্স তৈরীতে মনোযোগ দিচ্ছি। এতে আমদানি খরচ যেমন বাঁচবে, তেমনি দেশে ব্যবহৃত যে কোনো মেশিন ব্যবহার করেই এই ফাসটিক্স তৈরী করা যাবে।'
কী এই ফাসটিক্স
প্লাস্টিক দূষণ মোকাবেলায় একটি ব্রিটিশ অ্যাডভান্সড টেকনোলজি ডেভেলপমেন্ট কোম্পানির নাম পলিমেটেরিয়া (Polymateria) লিমিটেড। যাদের ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডনের ক্যাম্পাসে একটি ল্যাব রয়েছে। ব্রিটিশ কোম্পানি পলিমেটেরিয়া আবিষ্কৃত বায়োট্রান্সফরমেশন টেকনোলজি সব ধরনের প্লাস্টিককে প্রাকৃতিক পরিবেশে সম্পূর্ণরূপে বায়োডিগ্রেডেবল করতে পারে। বিশ্বে চলমান প্লাস্টিক দূষণকে মহামারির সঙ্গে তুলনা করে, একে রুখতে তারা নিজেদের উদ্ভাবিত পদ্ধতিকে বলছে 'ভ্যাকসিন ফর প্লাস্টিকস'। বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান ইকোস্পিয়ার পলিমেটেরিয়ার সঙ্গে মিলিতভাবে কাজ করছে এবং বায়োট্রান্সফরমেশন টেকনোলজির মাধ্যমে উৎপাদিত প্লাস্টিকের স্থানীয় নামকরণ করা হয়েছে ফাসটিক্স।
এ প্রযুক্তি সম্পর্কে পলিমেটেরিয়ার প্রধান নির্বাহী নি'ল ডুন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ব্লুমবার্গে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, 'আমাদের লক্ষ্য এমন প্লাস্টিক যা সহজেই প্রকৃতিতে মিশে যাবে, যার জন্য কোনো কম্পোস্টিং প্রযুক্তির প্রয়োজন হবে না।'
মোহাম্মদ রায়হান বলেন, 'পলিমেটেরিয়া হলো এমন একটি রাসায়নিক, যা প্লাস্টিকের পলিথিন, কাপ বা বোতল তৈরির সময় ব্যবহার করা হয়। ফলে এটি প্লাস্টিককে একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ধ্বংসে সহায়তা করে। এটি প্লাস্টিকের পলিমারগুলোকে ভেঙে মোমে পরিণত করে। সবচেয়ে চমৎকার বিষয় হলো এ প্রক্রিয়ায় প্লাস্টিকগুলো মাইক্রো বা ন্যানো আকারে পরিবেশে থেকে যায় না। বরং সম্পূর্ণরূপে প্রাকৃতিক ব্যাকটেরিয়া এবং ছত্রাকের খাবারে পরিণত হয়।'
তিনি আরও জানান, ইকোস্পিয়ার শীঘ্রই বায়োডিগ্রেডেবল রেইনকোট, এপ্রোন এবং স্যানিটেশন কভার তৈরি করবে।
সম্ভাবনা থাকার পরেও মিলছে না দেশের বাজারে প্রবেশের অনুমতি
ইকোস্পিয়ার ২০১৮ সাল থেকে বিদেশে পরিবেশবান্ধব ব্যাগ রপ্তানি করছে। এমনকি পরিবেশবান্ধব প্লাস্টিক তৈরীতে বিশ্বব্যাপী আলোড়ন তৈরী করা প্রতিষ্ঠান পলিমেটেরিয়া সম্প্রতি বাংলাদেশের বাজার পর্যবেক্ষণ করে এর ব্যাপক সম্ভাবনার কথা জানিয়েছে।
পলিমেটেরিয়া ইউকের চিফ কমার্শিয়াল অফিসার রিচার্ড হর্ন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'ইতোমধ্যে আমরা এশিয়ায় তাইওয়ান, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও ভারতে আমাদের প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু করেছি। সম্প্রতি তাইওয়ানের ফরমোসা প্লাস্টিক কর্পোরেশন আমাদের সঙ্গে ১০০ মিলিয়ন ডলারের চুক্তি করেছে। আইনগতভাবে আগে থেকেই সুযোগ তৈরী থাকায় বাংলাদেশে বায়োডিগ্রেডেবল প্লাস্টিক পণ্য তৈরী ও বাজারজাতকরণের দারুণ সুযোগ রয়েছে। তবে এ জন্য দেশটির শিল্প অনুমোদনকারী প্রতিষ্ঠানটিকে প্রস্তুত থাকতে হবে।'
তিনি জানান, বিশ্বব্যাপী খাদ্য উৎপাদনকারী কোম্পানি, ঔষধ শিল্প, প্যাকেজিং সংস্থাগুলো এই ধরনের প্লাস্টিক ব্যবহারে আগ্রহী হয়েছে। এদের মধ্যে মুম্বাইভিত্তিক ব্র্যান্ড গোদরেজ অন্যতম।
কিন্তু দীর্ঘ চারবছর ধরে চেষ্টা করেও দেশীয় বাজারে প্রবেশের লাইসেন্স পায়নি বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান ইকোস্পিয়ার।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) সহকারী পরিচালক মোনোতোষ কুমার দাশ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'দেশের বাজারে যে কোনো পণ্য আনতে গেলে লাইসেন্সের প্রয়োজন হয়। বর্তমানে আমাদের ২২৯টি প্রোডাক্ট পরীক্ষার ল্যাব রয়েছে। তবে ইকোস্পিয়ার যে স্ট্যান্ডার্ডের পণ্য বাজারে আনতে চাচ্ছে তা পরীক্ষা করার মতো ল্যাব আমাদের নেই। তাই এই মুহূর্তে আমাদের লাইসেন্স দেওয়ার সুযোগ নেই। তবে মৌখিকভাবে পণ্য বিপণনের অনুমতি দেয়া আছে।'
ইকোস্পিয়ারের প্রধান মোহাম্মদ রায়হান বলেন, 'শুধুমাত্র মৌখিক অনুমতিতে দেশে ব্যবসা করা সম্ভব নয়। দেশের অনেকগুলো সংস্থাকে ম্যানেজ করে ব্যবসা করতে হয়। তারা লাইসেন্স ছাড়া আমাকে ব্যবসা করতে দিচ্ছে না।'
তিনি বলেন, '২০১৮ সালে বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণাগার আমাদের উৎপাদিত ব্যাগ ১৪৭ দিনের মধ্যে পুরোপুরি বায়োডিগ্রেডেবল বলে সার্টিফাই করে। যেখানে এক শতাংশ প্লাস্টিকও নেই।'
এছাড়া ২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক স্বাধীন প্লাস্টিক বিশেষজ্ঞদের প্রতিষ্ঠান ইমপ্যাক্ট সলিউশনস ও নেদারল্যান্ড ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ওয়েল রিসার্চ তাদের প্রতিবেদনে ইকোস্পিয়ারের পণ্যকে "কম্পোস্টেবল" ও "বায়োডিগ্রেডেবল" হিসেবে সার্টিফিকেট দিয়েছে বলে জানান তিনি।
পরিবেশ অধিদপ্তরের (ঢাকা অঞ্চলের) পরিচালক মো. জিয়াউল হক বলেন, 'ইকোস্পিয়ারের তৈরী করা ব্যাগটি বিসিএসআইআর ল্যাবে পরীক্ষা করে বায়োডিগ্রেডেবল এবং কম্পোস্টেবল হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু আমরা প্রতিষ্ঠানটিকে লাইসেন্স দেওয়ার জন্য সুপারিশ করে চিঠি দিলেও বিএসটিআই এর এ পরীক্ষার সক্ষমতা নেই জানিয়ে সম্প্রতি আবেদনটি ফেরত পাঠিয়েছে।'
বায়োডিগ্রেডেবল প্লাস্টিক নিয়ে বিতর্ক
সাধারণ প্লাস্টিকের বিকল্প হিসেবে বায়োডিগ্রেডেবল প্লাস্টিক ব্যবহার নিয়ে বিশ্বের বিজ্ঞানীরা এখন পর্যন্ত একমত হতে পারেন নি।
জিএআইএ (গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ইনসিনারেটর অল্টারনেটিভস)-এর গ্লোবাল ক্লাইমেট প্রোগ্রামের পরিচালক মারিয়েল ভিয়েলা বলেন, 'বায়োডিগ্রেডেবল প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সমাধান নয়। এটি এখনো বৈজ্ঞানিকভাবে স্পষ্টভাবে প্রমাণ করা যায়নি।'
তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, 'বায়োডিগ্রেডেবল এবং কম্পোস্টেবল প্লাস্টিক মানুষকে আরও বেশি প্লাস্টিক আবর্জনা তৈরীতে উৎসাহিত করবে।'
তবে পলিমেটেরিয়া ইউকের চিফ কমার্শিয়াল অফিসার রিচার্ড হর্ন বলেন, 'প্রতি বছর প্রায় ৩৩০ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক পরিবেশে প্রবেশ করে, যার ৪০ শতাংশ ল্যান্ডফিলে যায়, ১৪ শতাংশ পুনর্ব্যবহৃত হয় এবং ১৪ শতাংশ বর্জ্য থেকে শক্তি হিসেবে রূপান্তরিত হয়। বাকি ৩২ শতাংশ প্রাকৃতিক পরিবেশে বর্জ্য হিসাবে থেকে যায় সর্বনিম্ন ৪০০ থেকে ১০০০ বছর পর্যন্ত। এ অবস্থায় পলিমেটেরিয়া চাইছে অন্তত এই পণ্যগুলোকে প্রকৃতিতে পচিয়ে ফেলতে।'