দাম বৃদ্ধি ও ভ্যাটের খড়গে বড় ধাক্কা হ্যান্ডসেট বিক্রি-উৎপাদনে
১০-২০ শতাংশ পর্যন্ত দাম বৃদ্ধি ও খুচরা পর্যায়ে ৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপের কারণে কমেছে মোবাইল হ্যান্ডসেটের উৎপাদন ও বিক্রি। এতে বিপাকে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা।
উৎপাদকরা বলছেন, বৈশ্বিক চিপ সংকট, ফ্রেইট চার্জ ও কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধির কারণে চলতি বছরের শুরু থেকেই চাপে ছিল হ্যান্ডসেট তৈরি করা কোম্পানিগুলো। ডলারের দামবৃদ্ধিসহ নানা সংকটের কারণে মে মাস থেকে দাম বাড়লে প্রথম দফায় বিক্রি কমে যায় হ্যান্ডসেটের। বাজেটে ভ্যাট আরোপের পর জুলাই মাসে বিক্রি ও উৎপাদন আরো কমে গেছে।
ফেয়ার গ্রুপের (বাংলাদেশে স্যামসাংয়ের ডিস্ট্রিবিউটর ও ম্যানুফেকচারার) চিফ মার্কেটিং অফিসার (সিএমও) মোহাম্মদ মেসবাহ উদ্দিন বলেন, "ছয় মাসের মধ্যে ডলারের দামের কারণে আমদানি ব্যয় ২০-২৫ শতাংশ বেড়েছে। কাঁচামালের দাম বেড়েছে ৪০ শতাংশের বেশি। ফলে আমরা বাধ্য হয়েই হ্যান্ডসেটের দাম বাড়িয়েছি।"
তিনি বলেন, বৈশ্বিক সংকটের মধ্যেই বাংলাদেশ সরকার মুঠোফোনের ওপর ব্যবসায়িক পর্যায়ে ৫ শতাংশ ভ্যাট বসিয়েছে।
"এসবের প্রভাব দেশের স্মার্টফোনের বাজারে পড়েছে। মে মাস থেকেই স্মার্টফোনের বিক্রি ১০ থেকে ১৫ শতাংশ হারে কমছে। গত মাসে এটি বেশি কমেছে," বলেন তিনি।
দেশে টেলিযোগ নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা বিটিআরসির তথ্যমতে, গত বছরের জুলাইয়ের তুলনায় চলতি বছর একই সময়ে ফোরজি সাপোর্টেড স্মার্টফোন উৎপাদন কমেছে ৫১ শতাংশ। আর চলতি বছরের জানুয়ারির তুলনায় তা কমেছে ৫৫ শতাংশ। যদিও টাকার হিসাবে মোবাইল হ্যান্ডসেট বিক্রি ১৫-২০ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে বলে দাবি করছেন করছে কোম্পানিগুলো।
গত ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হয়। এ যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই বিশ্ববাজারে ডলারের দাম বাড়তে থাকে। দেশে এখন আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতি ডলারের দাম ৯৬ টাকা। তবে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে ডলারের দাম ১১০ টাকা ছাড়িয়ে গেছে।
দেশে যেসব মুঠোফোন উৎপাদিত হয়, তা মূলত বিভিন্ন কাঁচামাল আমদানি করে এখানে সংযোজন করা হয়।
মুঠোফোন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, ডলারের দাম বাড়ায় কাঁচামাল আমদানির খরচ বেড়েছে। ফলে খুচরা বাজারে মুঠোফোন বিক্রির দামে একটা প্রভাব পড়েছে।
২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবের পরপরই মুঠোফোনের দাম বেড়ে যায় বলে জানান বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
নতুন বাজেটে ব্যবসায়িক পর্যায়ে মুঠোফোনে দেওয়া ৫ শতাংশ ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়া হয়। তখন দেশে স্মার্টফোন প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলো আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছিল, এতে বাজারে সেটের দাম ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ বাড়তে পারে। বাস্তবে হয়েছেও তা-ই।
বিটিআরসির তথ্যমতে, চলতি বছরের জানুয়ারিতে দেশে ফোরজি এনাবল মোবাইল ফোন উৎপাদন হয় ১৩ লাখ ৬৮ হাজার। জুলাই মাসে উৎপাদন নেমে আসে ৫ লাখ ৮৯ হাজারে। অংকের হিসাবে জানুয়ারির তুলনায় জুলাইতে উৎপাদন কমেছে ৫৫ শতাংশ।
যদিও বাজেট ঘোষণার পর জুন থেকেই কমে এসেছে স্মার্টফোনের বিক্রি। জুন মাসে বিক্রি হয় ৮ লাখ ৪৮ হাজার ফোন।
অন্যদিকে বৈশ্বিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির কারণে গত তিন মাসে আমদানিও হয়নি কোনো স্মার্টফোন। সর্বশেষ এপ্রিলে বৈধপথে ৩০,৯৬০টি স্মার্টফোন আমদানি করেন ব্যবসায়ীরা। এরপর আর বৈধপথে কোনো ফোন আমদানির তথ্য নেই বিটিআরসির কাছে।
স্মার্টফোনের উৎপাদন কম হওয়া প্রসঙ্গে শাওমি বাংলাদেশের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা বলেন, কোম্পানিগুলো গত মে মাস থেকে অনুমান করছিল, ভবিষ্যতে সেটের চাহিদা ব্যাপকভাবে কমে যেতে পারে, যা ইতোমধ্যে পরিলক্ষিত হচ্ছে। এই আশঙ্কা থেকে কোম্পানিগুলো আগাম স্মার্টফোনের উৎপাদন কমিয়েছে। তাছাড়া ভ্যাট সুবিধা প্রত্যাহার করায় স্মার্টফোনের দাম বাড়ছে। এতে স্মার্টফোনের উৎপাদন আরও নিম্নমুখী হতে পারে।
দেশে স্যামসাং, অপো, ভিভো, টেকনো, সিম্ফনি, ওয়ালটন, লাভা, শাওমি, নোকিয়া, রিয়েলমিসহ ১৪টি ফোনের কারখানা রয়েছে।
উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সূত্র বলছে, দেশে ১৫ হাজার কোটি টাকার স্মার্টফোনের বাজার রয়েছে। চাহিদার ৯০ শতাংশের বেশি ফোন দেশেই উৎপাদিত হয়। এ খাতে বিনিয়োগ রয়েছে ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি।
আন্তর্জাতিক বাজারেও বিক্রি কমেছে
ক্যানালিসের প্রতিবেদনে বলা হয়, এ বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) সারা বিশ্বে স্মার্টফোন বিক্রি কমেছে ৯ শতাংশ।
ডলারের দাম বৃদ্ধি, চিপ সংকট এবং সার্বিকভাবে বৈশ্বিক অর্থনীতির মন্দা ভাবের কারণে সারা বিশ্বে স্মার্টফোন বিক্রি কমেছে বলে জানিয়েছে বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান ক্যানালিস।