এনবিআরের সার্ভারে স্ক্যানার সংযোগ না থাকায় চট্টগ্রাম বন্দরে বারবার জালিয়াতি
চট্টগ্রাম বন্দরে রাজস্ব কর্তৃপক্ষের সার্ভারে স্ক্যানিং সংযোগ না থাকায় বারবারই আমদানি পণ্য খালাসে জালিয়াতির ঘটনা ঘটছে। এতে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকার।
নিয়ম অনুযায়ী, চট্টগ্রাম বন্দরে কন্টেইনার ভর্তি আমদানি পণ্য ডেলিভারি প্রক্রিয়ায় স্ক্যানিং শেষে এর প্রতিবেদন গেইটে দায়িত্বরত কাস্টমস কর্মকর্তার কাছে জমা দিতে হয়।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সফটওয়্যার এ্যসাইকুডা ওয়াল্ড সিস্টেমে স্ক্যানিং রিপোর্টের সংযোগ না থাকায় ম্যানুয়ালি পরীক্ষা করে গেইট ত্যাগের অনুমতি দেয় কাস্টমস।
কন্টেইনার স্ক্যানিং রিপোর্ট সফটওয়্যারে সংযোগ না থাকার এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে একটি চক্র ভুয়া স্ক্যানিং রিপোর্ট তৈরী করে খালাস করে নিয়ে যাচ্ছে আমদানি পণ্য। এতে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে বলে জানিয়েছে বন্দর ও কাস্টমস সংশ্লিষ্টরা।
চট্টগ্রাম কাস্টমস কর্তৃপক্ষ বলছে, বন্দরের গেইটে ১৩ বছরেরও পুরনো স্ক্যানিং মেশিনের কারণে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ইন্টিগ্রেশন অব স্ক্যান ইমেজ মডিউল বাস্তবায়ন করতে পারছেনা। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের পক্ষ থেকে এই বিষয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে অবহিত করা হলেও নতুন স্ক্যানিং মেশিন বসানোর আগে এই সমস্যার সমাধান হচ্ছেনা।
সর্বশেষ স্ক্যান রিপোর্ট জালিয়াতি করে গত ২২ জুলাই চট্টগ্রাম বন্দর থেকে দুটি মদের চালান খালাস করে নিয়ে যায় একটি চক্র। বন্ড সুবিধায় মেশিনারি ও ববিন ঘোষণা দিয়ে মদের চালান খালাস করে নিয়ে যায় তারা।
২টি চালানের গাড়ি সোনারগাঁও ও নারায়ণগঞ্জ থেকে আটক করে র্যাব। এই দুটি চালানে ২৪ কোটি ৭০ লাখ টাকা শুল্ক ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করেছিলো চক্রটি।
এই ঘটনার পর চট্টগ্রাম বন্দরে আরো তিনটি চালান পরীক্ষা করে মদ উদ্ধার করে কাস্টম। এই চালানগুলোও স্ক্যানিং রিপোর্ট জালিয়াতি করে খালাসের চেষ্টায় ছিলো চক্রটি। সর্বমোট পাঁচটি চালানে ৫৭ কোটি ৮৩ লাখ টাকা রাজস্ব ফাঁকির চেষ্টা করে চক্রটি।
বাংলাদেশ ফ্রেইট ফারোয়ার্ডার এসোসিয়েশনের সহ সভাপতি খায়রুল আলম সুজন বলেন, "কাস্টমসের সার্ভারের সাথে স্ক্যানিং রিপোর্টের সংযোগ না থাকার সুযোগ নিচ্ছে একটি চক্র। বন্ড সুবিধায় আসা আমদানি পণ্যের চালানে এসব ঘটনা বেশি ঘটছে। এতে একদিকে যেমন বন্ড সুবিধার অপব্যবহার হচ্ছে অন্যদিকে দেশে আমদানি নিষিদ্ধ বিভিন্ন পণ্য দেশে প্রবেশেরও সুযোগ তৈরী হয়েছে।"
তিনি আরো বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরের সব গেইটে স্ক্যানিং মেশিন বসিয়ে সেগুলোকে এনবিআরের সার্ভারের সাথে সংযুক্ত করতে না পারলে জালিয়াতি রোধ করা কোনভাবেই সম্ভব হবেনা।
বন্দর ব্যবহারকারীরা বলছেন, চট্টগ্রাম বন্দরের স্ক্যানিং মেশিন এবং গেইটের দুরত্ব খুব কাছাকাছি। অথচ স্ক্যানিং রিপোর্ট জাল কিনা সেটি গেইটে চেক করার কোন সুযোগ নেই। সম্প্রতি মদ উদ্ধারের ঘটনা সবার নজরে এলেও ভুয়া রিপোর্ট দেখিয়ে এভাবে কত চালান বের হয়ে গেছে এর কোন পরিসংখ্যান নেই।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের প্রোগ্রামার শামিমুল ইসলাম বলেন, ২০২০ সালে বসানো মেশিন দুটি এই ইন্টিগ্রেশন অব স্ক্যান ইমেজ বাস্তবায়ন উপযোগী হলেও অন্যগুলো পুরনো হওয়ায় এই উদ্যোগ বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছেনা। বিষয়টি ইতোপূর্বে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে অবহিত করেছে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস।
বন্দর গেইটে নতুন স্ক্যানিং মেশিন সংযোজন করলে ইন্টিগ্রেশন অব স্ক্যান ইমেজ মডিউল বাস্তবায়ন করা যাবে।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের তথ্যমতে, চট্টগ্রাম বন্দরের ১২টি গেইট দিয়ে কন্টেইনার এবং পণ্যবাহী গাড়ি চলাচল করে। কিন্তু বন্দরের ৬টি গেইটে স্ক্যানিং মেশিন আছে ৭টি। এরমধ্যে সবশেষ ২০২০ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি দুটি মেশিন সংযুক্ত হয়।
বাকি ৫টি মেশিন ১৩ বছরের পুরনো। চোরাচালান প্রতিরোধ ও বৈশ্বিক নীতিমালার বাধ্যবাধকতার কারণে চিটাগং পোর্ট ট্রেড ফ্যাসিলিটেশন (সিপিটিএফ) প্রকল্পের আওতায় ২০০৯ সালে কন্টেইনার স্ক্যানিং মেশিনগুলো স্থাপন করেছিলো কাস্টমস। পুরোনো হওয়ায় কন্টেইনার স্ক্যানিংয়ের ছবিও সঠিকভাবে পাওয়া যায়না বলে জানিয়েছে তারা।
দেশের সকল সমুদ্র বন্দর দিয়ে মোট কন্টেইনার পরিবহনের ৯৮ শতাংশ সম্পন্ন হয় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। চট্টগ্রাম বন্দর ২০২১-২০২২ অর্থবছরে ৩২ লাখ ৫৫ হাজার ৩৫৮ টিইইউএস কন্টেইনার হ্যান্ডলিং করে।
চট্টগ্রাম কাস্টম এর তথ্য মতে, এই বন্দর দিয়ে আমদানি হওয়া প্রায় ২০ শতাংশ পণ্য চালানের শতভাগ কায়িক পরীক্ষা সম্পন্ন হয়। এফসিএল (ফুল লোড কন্টেইনার) এর ক্ষেত্রে আমদানিকারকের আবেদনের প্রেক্ষিতে পণ্য স্ক্যানিং করা হয়। এলসিএল বা লেস দ্যান কন্টেইনার লোড পণ্যগুলো চট্টগ্রাম বন্দরের ভেতরে আনস্টাফিং হয়ে খালাস হয়।
চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাষ্ট্রিজ এবং চট্টগ্রাম বন্দর ইউজার্স ফোরামের সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, "বন্দরে স্ক্যানিং মেশিনের সাথে এনবিআর সফটওয়্যারের সংযোগ দেওয়া গেলে জালিয়াতির সুযোগ থাকবেনা। প্রতিবছর চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে বাড়ছে আমদানি রপ্তানি বাণিজ্যের পরিধি। তাই বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে দ্রুত সার্ভারের সাথে স্ক্যানিং রিপোর্ট সংযুক্ত করতে হবে।"
চট্টগ্রাম বন্দরে রপ্তানি পণ্য স্ক্যানিংয়ের জন্য দুটি স্ক্যানার ক্রয় বর্তমানে টেন্ডার প্রক্রিয়ায় রয়েছে বলে জানিয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। সম্প্রতি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক বলেছিলেন, শীঘ্রই রপ্তানি পণ্য স্ক্যানিংয়ের জন্য দুটি কন্টেইনার চট্টগ্রাম বন্দরে যুক্ত হবে।
এদিকে গত ২৮ আগষ্ট চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) পরিদর্শনে এসে নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বন্দরের সব গেইটে শীঘ্রই স্ক্যানিং মেশিন বসানো হবে বলে জানান।