ঘুরে দাঁড়াচ্ছে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড রপ্তানি খাত
চট্টগ্রামের বিএম কন্টেইনার ডিপোতে গত ৬ জুন বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর পুরোপুরি বন্ধ হয়ে হয়েছিলো বাংলাদেশ থেকে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড রপ্তানি। মেইন লাইন অপারেটর (এমএলও) জাহাজে এই পণ্য পরিবহন না করায় ডিপোগুলো সংশ্লিষ্ট কারখানায় ফেরত পাঠায় এই পণ্য। বাধ্য হয়ে প্রতিষ্ঠানগুলো উৎপাদন কমিয়ে দেয়।
তবে গত আগস্ট থেকে ফের ঘুরে দাঁড়াচ্ছে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড রপ্তানি খাত। সমুদ্রপথে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে এ মাসে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৫ হাজার মেট্রিক টন হাইড্রোজেন পার অক্সাডই রপ্তানি হয়েছে। রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো এখন নতুন করে আশা দেখছে এই খাত ঘিরে।
গত আগস্টের শেষ সপ্তাহে চট্টগ্রাম কনটেইনার ট্রান্সপোর্টেশন কোম্পানি লিমিটেডের (সিসিটিসিএল) ডিপোর মাধ্যমে শুরু হয় এই রাসায়নিক পণ্যের রপ্তানি কার্যক্রম। এক মাসে সিসিটিসিএল ডিপোর মাধ্যমে ৫ হাজার মেট্রিক টন হাইড্রোজেন পার অক্সাইড রপ্তানি হয়েছে। তবে চট্টগ্রামে ১৯টি বেসরকারি আইসিডি থাকলেও এখন সিসিটিসিএল ছাড়া আর কোন ডিপো এই পণ্য গ্রহণ করছেনা।
এর ফলে সরকারের ১০ শতাংশ আর্থিক সহায়তা প্রাপ্ত হাইড্রোজেন পার অক্সাইড রপ্তানি খাতের বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ফিরে এসেছে স্বস্তি। সবগুলো ডিপোতে এই পণ্যের স্টাফিং শুরু হলে রপ্তানির পরিমাণ স্বাভাবিক মাত্রায় আসবে বলে প্রত্যাশা রপ্তানিকারকদের।
গত ৪ জুন বিএম কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ড ও কনটেইনার বিস্ফোরণের ঘটনার পর হাইড্রোজেন পার অক্সাইড পরিবহন বন্ধ করে শিপিং লাইনগুলো। ফলে বন্ধ হয়ে যায় রপ্তানি। এছড়া হাইড্রোজেন পার অক্সাইড সহ ক্যামিকেলবাহী কন্টেইনার গ্রহণ স্থগিত করে ৯ জুন একটি চিঠি ইস্যু করে সিঙ্গাপুর বন্দর। পরবর্তীতে দুই মাস পর ১০ আগস্ট এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়। এপর শুরু হয় এ পণ্যের আমদানি-রপ্তানি।
বাংলাদেশে ৮টি কারখানায় উৎপাদিত হাইড্রোজেন পার অক্সাইড দেশের বিভিন্ন কারখানায় ব্যবহারের পাশাপাশি ১৪টি দেশে রপ্তানি হয়। দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে ভিয়েতনাম, চীন, কোরিয়া, পাকিস্তান, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার, মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও দক্ষিণ আফ্রিকা। বাংলাদেশ ২০ বছর ধরে রপ্তানি করছে এ পণ্য।
হাইড্রোজেন পার অক্সাইড রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে মেঘনা গ্রুপের তাসনিম কেমিক্যাল কমপ্লেক্স, সামুদা ক্যামিকেল, এসএম কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ, এইচপি কেমিক্যালস লিমিটেড, ইনফেনিয়া কেমিক্যাল কোম্পানি, আল রাজি কেমিক্যাল।
সিসিটিসিএল এর ম্যানেজার (এডমিন) শহিদুল ইসলাম নিগার বলেন, 'আগস্টের শেষ সপ্তাহ থেকে আমাদের ডিপোতে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড কন্টেইনার বোঝাই হচ্ছে। এ পর্যন্ত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রায় ২৫০ কন্টেইনার হাইড্রোজেন পার অক্সাইড জাহাজীকরণ করা হয়েছে। প্রতি কন্টেইনারে ২০ টন হিসেবে এই ডিপো দিয়ে রপ্তানি হয়েছে ৫ হাজার মেট্রিক টন। সব ধরনের নিরাপত্তা এবং বিধিবিধান অনুসরণ করেই এসব পণ্য সংরক্ষণ করা হচ্ছে।'
মেঘনা গ্রুপের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার মোহাম্মদ মিজান বলেন, 'রপ্তানি বন্ধের আগে আমরা প্রতি মাসে প্রায় ৬ হাজার মেট্রিক টন হাইড্রোজেন পার অক্সাইড রপ্তানি করতাম। সিসিটিসিএল ডিপোর মাধ্যমে ১ মাস আগে রপ্তানি শুরু করি। প্রায় ৫০০ টন রপ্তানি করতে পেরেছি আমরা। সব ডিপো পণ্য গ্রহণ না করায় রপ্তানি অর্ডার থাকলেও আমরা সরবরাহ করতে পারছিনা।'
সামুদা ক্যামিকেলের হেড অব বিজনেস বিকাশ কান্তি দাশ টিবিএসকে বলেন, 'আমরা গত আগস্ট থেকে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড রপ্তানি শুরু করি। স্বাভাবিক সময়ে মাসে চার থেকে চার হাজার ৫০০ মেট্রিক টন রপ্তানি করতাম। গত মাসে আমরা ৩ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন হাইড্রোজেন পার অক্সাইড রপ্তানি করেছি। তবে এর মধ্যে বেশিরভাগ সড়কপথে ভারতে রপ্তানি হয়েছে। সবগুলো ডিপোতে এই পণ্য গ্রহণ করলে সমুদ্রপথে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড রপ্তানির পরিমাণ আরো বাড়বে।'
বিএম ডিপোর মালিকের প্রতিষ্ঠান আল রাজি ক্যামিকেলও হাইড্রোজেন পার অক্সাইড রপ্তানি শুরু করেছে। প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক ক্যাপ্টেন মাইনুল হাসান টিবিএসকে বলেন, 'তিন সপ্তাহ আগে আমরা রপ্তানি শুরু করেছি।' তবে কী পরিমাণ রপ্তানি হয়েছে তা তিনি নিশ্চিত করতে পারেননি।
রপ্তানির পাশাপাশি শুরু হয়েছে হাইড্রেজেন পার অক্সাইড সহ অন্যান্য ক্যামিকেল আমদানি। সিঙ্গাপুর বন্দর হাইড্রোজেন পার অক্সাইড গ্রহণে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার পর শিপিং লাইনগুলো জাহাজে ক্যামিকেল পরিবহন শুরু করে।
শিপিং এজেন্টরা জানিয়েছেন হাইড্রোজেন পার অক্সাইড পরিবহনে মেইন লাইন অপারেটর (এমএলও) চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের কড়াকড়ির কারণে কিছুদিন ক্যামিকেল জাতীয় পণ্য পরিবহনে স্থবিরতা নেমে এসেছিলো। তবে এখন নিয়মনীতি কঠোরভাবে অনুসরণ করে এসব পণ্য সংরক্ষণ হচ্ছে।
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস এসোসিয়েশনের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান সৈয়দ ইকবাল আলী শিমুল বলেন, 'হাইড্রোজেন পার অক্সাইড রপ্তানি এবং সংরক্ষণে এখন কোন বাধা নেই। সরকারী নিয়মনীতি মেনে অনুসরণ করে সকল ডিপোর উচিৎ এ পণ্য স্টাফিং শুরু করা। সবগুলো ডিপোতে স্টাফিং করা হলে রপ্তানির পরিমাণ স্বাভাবিক পর্যায়ে আসতো।'
আইসিডি মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কন্টেইনার ডিপোস এসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট নুরুল কাইয়াম খান টিবিএস বলেন, 'অন্য রপ্তানি পণ্যের মতোই সবগুলো আইসিডিতে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড স্টাফিং করা হতো। তবে বিএম ডিপোর ঘটনার পর ডিপোগুলোতে এখনো এই পণ্যের স্টাফিং পুরোপুরি শুরু হয়নি।'
দ্য অবজারভেটরি অফ ইকোনমিক কমপ্লেক্সিটি (ওইসি) অনুসারে, বাংলাদেশ ২০২০ সালে ১৩.৯ মিলিয়ন ডলারের হাইড্রোজেন পার অক্সাইড রপ্তানি করেছে। বিশ্বব্যাপী এই রাসায়নিক রপ্তানিতে দেশ ১৭তম স্থানে রয়েছে।
রাসায়নিক দ্রব্যটি দেশের ৮৯তম সর্বাধিক রপ্তানিকৃত পণ্য।
আবার অন্যান্য দেশ থেকে হাইড্রোজেন পারক্সাইড আমদানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান ৬৫তম।
২০২০ সালে থাইল্যান্ড, জাপান, নেদারল্যান্ডস, দক্ষিণ কোরিয়া এবং ভারত থেকে ৬ লাখ ৫৬ হাজার ডলারের হাইড্রোজেন পার অক্সাইড আমদানি করে বাংলাদেশ।
প্রসঙ্গত, বিএম কন্টেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণের ঘটনায় ৫১ জন নিহত হয়, আহত হয় দুই শতাধিক।