বৈশ্বিক স্বর্ণ বাজারে ‘গ্রেট মাইগ্রেশন’! – বুলিয়নের স্রোত বইছে এশিয়ার বাজারে
পুঁজির নিরাপদ ও আরও লাভজনক আশ্রয়ের সন্ধানে পশ্চিমা বিনিয়োগকারীরা স্বর্ণের চাকচিক্য ছেড়ে ঝুঁকছেন মার্কিন ডলারে। ফলে বৈশ্বিক স্বর্ণ বাজারে চলছে এক মহা-অভিবাসন। কারণ এশীয় ক্রেতারা সোনালী ধাতুটির দাম পতনের এই সুযোগে অপেক্ষাকৃত সস্তা দরে অলঙ্কার ও স্বর্ণের বার কেনা শুরু করেছেন।
মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ বর্তমানে আগ্রাসীভাবে বাড়াচ্ছে সুদহার। ফলে ডলার ও ট্রেজারি বন্ডের বিনিয়োগে মিলছে আকর্ষণীয় লভ্যাংশ। আর তাতেই পশ্চিমা বিনিয়োগকারীদের কাছে আকর্ষণ হারাচ্ছে স্বর্ণ।
ইতঃপূর্বে স্বর্ণে বিনিয়োগকারীরা ধাতুটি বিক্রি করে দেওয়ায়– নিউইয়র্কের মতো বৈশ্বিক আর্থিক খাতের প্রাণকেন্দ্রের বিভিন্ন সংস্থার ভল্টে সঞ্চিত স্বর্ণ এশীয় বাজারে আসছে। সরবরাহ বাড়ছে ইস্তাম্বুলের গ্রান্ড মার্কেট থেকে শুরু করে সাংহাইয়ের স্বর্ণ বাজারে।
এমনকী চাহিদার সাথে সরবরাহ গতি মেলাতে পারছে না।
পরিবহনের নানান লজিস্টিকস সমস্যার কারণে যেখানে দরকার সেখানে দ্রুততর সময়ে যথেষ্ট স্বর্ণ আনতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা। ফলে এশিয়ার কিছু বাজারে বৈশ্বিক বেঞ্চমার্ক সূচকে নির্দেশিত দরের চেয়েও বেশি দামে স্বর্ণ ও রৌপ্য কেনাবেচা হচ্ছে।
স্বর্ণ পরিশোধন ও বিকিকিনির সংস্থা– এমকেএস প্যাম্প এসএ'র হেড অভ ট্রেডিং জোসেফ স্টিফান্স বলেন, '(পশ্চিমে) স্বর্ণ ধরে রাখার পক্ষে এখন উৎসাহ কম। ফলে এটির প্রবাহ চলছে পশ্চিম থেকে পূর্বমুখে। এই প্রবণতার সাথে তাল মেলাতে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি'।
বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অন্যত্র স্বর্ণের এই স্থানান্তরের ঘটনা এটাই প্রথম নয়। বরং গত কয়েক দশকে স্বর্ণ বাজারে এই চক্রের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে বহুবার। বিশেষত, যখন পশ্চিমের বিনিয়োগকারীরা স্বর্ণ বিক্রি করে দেন, তখন এর দাম কমে– আর ঠিক তখনই সে সুযোগে স্বর্ণ কিনতে থাকেন এশীয় ক্রেতারা। ফলে সোনালী আভার পূর্বমুখী স্রোত দেখা যায়। বাণিজ্যের এই চক্রের কারণেই দুর্বলতার এই সময়ে একটি মূল্য সীমাও ধরে রাখতে পারছে বুলিয়ন বা স্বর্ণ। এশীয় বাজারের চাহিদা না থাকলে ঘটতে পারে বিশাল দরপতন।
এই চক্রের মাধ্যমে স্বর্ণের দাম যখন আবার বাড়তে থাকে, তখনই এটি কিনতে শুরু করেন পশ্চিমা বিনিয়োগকারীরা। আর তখন স্বর্ণের স্তূপ জমতে থাকে নিউইয়র্ক, লন্ডন ও জুরিখসহ প্রধান প্রধান পশ্চিমা আর্থিক কেন্দ্রের ব্যাংক ভল্টে।
গত মার্চে সর্বোচ্চ দর বা পিক প্রাইস অর্জন করে স্বর্ণ। এরপর ফেডের আগ্রাসী সুদহার বৃদ্ধির ফলে তা কমেছে ১৮ শতাংশের মতো। ডলারমুখী হতে এসময় স্বর্ণে রাখা লগ্নী উঠিয়ে নেন বিনিয়োগকারীরা।
এপ্রিলের শেষদিক থেকে শুরু করে এপর্যন্ত পশ্চিমা বাজারের বড় দুই কেন্দ্র নিউইয়র্ক ও লন্ডনের ভল্টগুলি থেকে ৫২৭ টন সোনা বের হয়েছে বলে জানা গেছে সিএমই গ্রুপ ইনকর্পোরেশন ও লন্ডন বুলিয়ন মার্কেটি অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যে।
একইসময়ে বেড়েছে চীনের মতো বৃহৎ এশীয় ক্রেতা দেশে পাঠানো চালান। চলতি বছরের আগস্টে চীনে চার বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ স্বর্ণ আমদানি হয়েছে।
আগেই বলা হয়েছে যথেষ্ট পরিমাণ সোনা পূর্বদিকে আসলেও– তা চাহিদা মেটানোর মতো পর্যাপ্ত নয়। আর সে কারণেই লন্ডন বেঞ্চমার্কের চেয়ে বেশি দরে বিকোচ্ছে দুবাই, ইস্তাম্বুলের বাজারে এবং সাংহাই গোল্ড এক্সচেঞ্জে। এ তথ্য জানাচ্ছে এমকেএস প্যাম্প। এই তথ্য আমদানির চেয়েও কেনাকাটা বেশি হওয়ারই ইঙ্গিত দেয়।
বহুমূল্য ধাতুতে বিনিয়োগের পরামর্শদাতা একটি সংস্থা হংকং-ভিত্তিক প্রেসাস মেটাল ইনসাইটস লিমিটেড এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফিলিপ ক্ল্যাপউইক বলেন, 'দাম যখন কম থাকে সাধারণত তখনই চাহিদা বাড়তে থাকে। কারণ ক্রেতারা নিম্ন দামে ধাতুটি সংগ্রহ করতে চান। তাই দাম কমার সময়েই স্থানীয় বাজারে পর্যাপ্ত যোগান থাকে না, এবং সেকারণে স্থানীয় প্রিমিয়াম বাড়ে'।
লন্ডনের মূল্যসূচকের তুলনায় বেশি দামে বা প্রিমিয়াম মূল্যে বিক্রি হচ্ছে থাইল্যান্ডেও। এর পেছনে প্রধান ভূমিকা রাখছে সরবরাহের ঘাটতি এবং স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন। এমন তথ্যই জানান দেশটির স্বর্ণ ব্যবসায়ী সমিতির প্রেসিডেন্ট জিতি তাংসিথপাকদি।
অলঙ্কার চাহিদায় এগিয়ে থাকা আরেক এশীয় দেশ ভারতে এমনকী রুপোও বিকোচ্ছে প্রিমিয়াম দরে। আন্তর্জাতিক দরের চেয়ে এই পার্থক্য সম্প্রতি ভরিতে বেড়েছে এক ডলারের মতো, যা সাধারণ সময়ে যে দর থাকে তার চেয়েও তিনগুণ বেশি বলে জানাচ্ছে পরামর্শক সংস্থা মেটাল ফোকাস লিমিটেড।
সংস্থাটির মুম্বাই-ভিত্তিক প্রধান পরামর্শদাতা চিরাগ শেঠ বলেন, 'ব্যবসায়ীদের কিনে পুনঃমজুত করতে হওয়ায় এই মুহূর্তে রৌপ্যের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। দিওয়ালির সাথে আসা অন্যান্য ধর্মীয় উৎসবের এই মৌসুম জুড়ে বজায় থাকতে পারে প্রিমিয়াম মূল্য'।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমানে এশীয় বাজারের সিংহভাগ চাহিদা পূরণ করছে সিএমই গ্রুপের ভল্ট থেকে আসা স্বর্ণ। কোম্পানিটি নিউইয়র্কের কমেক্স ফিউচার্স সূচকের অধীন বা তাদের মজুত ওই বাজারকে সমর্থন দেয়।
মহামারির শুরুর দিকে এই বাজারে স্বর্ণের দামে ব্যাপক উত্থান দেখা যায়, এসময় সম্পদের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে বিপুল স্বর্ণ মজুত করতে বাধ্য হয় ব্যাংকগুলি।
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে কমেক্স বাজারে লন্ডনের চেয়ে বেশি মূল্যছাড়ে বিকোচ্ছে স্বর্ণ। কেনার পর চালান এশীয় বাজারে পাঠাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।
তবে চালান পাঠানোর গতি বেশকিছু কারণেই কম। যেমন পশ্চিমাদের তুলনায় অপেক্ষাকৃত ছোট বা এক কেজি ওজনের বার কিনতে পছন্দ করেন এশিয়ার পাইকারি ক্রেতা ও স্বর্ণকারেরা।
ফলে ২৫ কেজি স্বর্ণের এক একটি চালান প্রস্তুতের জন্য ব্যবসায়ীদের বেশ কয়েকটি কমেক্স গোল্ড ফিউচার্সের চালান কিনতে হয়। অধিকাংশ সময়েই এসব চালান আসে বিভিন্ন মজুদাগার থেকে।
লজিস্টিকস বা পরিবহন সেবা ও অবকাঠামো সংক্রান্ত সমস্যার কথাও বলছেন ব্যবসায়ীরা। আর তার ফলে এশীয় বাজারে উচ্চ প্রিমিয়ামে জৌলুস ছড়াচ্ছে স্বর্ণ।
- সূত্র: ব্লুমবার্গ