আট মাসের মধ্যে অক্টোবরে রেমিট্যান্স সর্বনিম্ন
দেশে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স কয়েকমাস ধরে ঊর্ধ্বমূখী থাকলেও হঠাৎ করে ধস নেমেছে রেমিট্যান্স প্রবাহে। চলতি অর্থবছরের অক্টোবরে প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠিয়েছে ১.৫২ বিলিয়ন ডলার। গত অক্টোবরের তুলনায় এবার রেমিট্যান্স কমেছে ৭.৪ শতাংশ।
২০২১-২২ অর্থবছরের অক্টোবরে রেমিট্যান্সের প্রবাহ ছিল ১.৬৪ বিলিয়ন ডলার।
ফরমাল মার্কেটের তুলনায় ইনফরমাল মার্কেটে বেশি রেট পাওয়ায় রেমিট্যান্সে ধাক্কা এসেছে বলে মনে করছে ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদরা।
এদিকে সেপ্টেম্বরে রেমিট্যান্স এসেছে ১.৫৪ বিলিয়ন ডলার। সেপ্টেম্বরেও আগের অর্থবছরের একই মাসের তুলনায় প্রায় ১১ শতাংশ রেমিট্যান্স কম এসেছে।
এর আগে জুলাই ও আগস্টে রেটিম্যন্সের পরিমাণ ছিল চার বিলিয়নের বেশি।
বেসরকারি একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) টিবিএসকে বলেন, "আমাদের দেশের ব্যাপক কর্মী প্রবাসে যাচ্ছে অথচ রেমিট্যান্সের পরিমাণ কমছে, এটা খুবই উদ্বেগের।"
তিনি আরও বলেন, "প্রবাসীরা ফরমাল মার্কেটে রেট পাচ্ছে ১০৭ টাকা। এর সঙ্গে আড়াই শতাংশ প্রণোদনা। অথচ ইনফরমাল চ্যানেলের (হুন্ডি) মাধ্যমে রেমিট্যান্স বিক্রি করে পাচ্ছে ১১৫ টাকা থেকে ১২০ টাকা। ফলে তারা হুন্ডির দিকে ঝুঁকছে।
দেশের ফরেন এক্সচেঞ্জ মার্কেটকে স্থিতিশীল রাখতে সেপ্টেম্বরের শুরুতে অ্যাসোসিয়েশন অফ ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) ও বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ অথরাইজড ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষমতা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
এরপর সব ব্যাংকে ডলারের একক রেট নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। যেখানে রেমিট্যান্স আনতে প্রতি ডলারের সর্বোচ্চ দর নির্ধারণ করা হয় ১০৮ টাকা ও রপ্তানি বিল নগদায়নের রেট ঠিক করা হয় ৯৯ টাকায়।
যদিও পরে রেমিট্যান্সের দর এক টাকা কমিয়ে ১০৭ টাকা ও রপ্তানি আয় এনক্যাশমেন্ট ৯৯ টাকা ৫০ পয়সা করা হয়।
এ সিদ্ধান্তের পর প্রথম মাসেই রেমিট্যান্সে ধাক্কা আসে। আগস্টের তুলনায় সেপ্টেম্বরে রেটিম্যান্স প্রায় ৪৯৭ মিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স কম আসে।
এবিবির একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, "কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বাফেদা সদিচ্ছা নিয়েই রেমিট্যান্সের একক রেট দিয়েছে। কিন্তু এটা একটা ভুল পরীক্ষা ছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি এমন পরীক্ষা আরও চালিয়ে যায়, তাহলে ব্যাংকগুলোকে বাঁচানো খুব কষ্ট হবে।"
গতকাল কেন্দ্রীয় ব্যাংকে এবিবি ও বাফেদাকে নিয়ে মিটিং হয়েছে। সভায় রেমিট্যান্সের নিম্ন গতির বিষয়টি আলোচনায় আসলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে রেমিট্যান্সের রেট না বাড়িয়ে ভিন্ন পরামর্শ আসে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক অন্য ব্যাংকগুলোকে বিদেশে নতুন একচেঞ্জ হাউজ বাড়ানো এবং রেমিট্যান্স পাঠানো ফি কমানোর পরামর্শ দেয়।
গতকালকের বৈঠকে থাকা একজন কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, "ব্যাংকগুলোকে প্রবাসীদের রেমিট্যান্স পাঠানোর ফি কমাতে বলা হয়েছে। অথচ দেশি ব্যাংকগুলো নিজস্ব রেমিট্যান্স হাউজের মাধ্যমে মাত্র ১০% রেমিট্যান্স সংগ্রহ করে। বাকি রেমিট্যান্স আসে বিদেশি রেমিট্যান্স কোম্পানি, মানিগ্রাম, ওয়েস্টার্ন ইউনিয়ন, রিয়া মানি এক্সচেঞ্জ ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। তারা তো আর ফি কমাবে না।"
"এই মুহূর্তে বিদেশে এক্সচেঞ্জ হাউজ খুলতে ১০ কোটি টাকার বেশি ডলার পাঠাতে হবে বলে জানায় ব্যাংকগুলো। এ যুক্তির পর বিদেশে এক্সচেঞ্জ হাউস বাড়ানোর সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক," যোগ করেন তিনি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, বিদায়ী ২০২১-২২ অর্থবছরে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে রেমিট্যান্স এসেছে ২১.০৩ বিলিয়ন ডলার। যা আগের ২০২০-২১ অর্থবছরের তুলনায় ১৫ শতাংশ কম।
এদিকে ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রায় ১০ লাখ লোক নতুন করে বিদেশে গিয়েছে। অথচ বিদেশে প্রবাসীদের পরিমাণ বাড়লেও রেমিট্যান্সের পরিমাণ কমছে।
গত ছয়মাসে একবারও ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে রেমিট্যান্স না পাঠানোর কথা স্বীকার করেন সিঙ্গাপুর প্রবাসী বাংলাদেশি মো. এরশাদ।
টিবিএসকে তিনি বলেন, আজ (১ নভেম্বর) সিঙ্গাপুরি এক ডলারের দাম ৭৬ টাকা ২৫ পয়সা। অথচ হুন্ডির মাধ্যমে পাঠালে পাওয়া যাচ্ছে ৮২ টাকা।
তার পরিচিত অধিকাংশ প্রবাসী হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্সে ডলার বিক্রি করছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।
সরকার বিদায়ী অর্থবছরে রেমিট্যান্স কমার কারণে প্রবাহ বাড়তে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো, রেমিট্যান্স পাঠাতে যেকোনো ধরনের কাগজপত্র প্রদর্শন থেকে মুক্তি।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশিষ্ট ফেলো মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, "রেমিট্যান্সের রেট বৈষম্যের কারণে প্রবাসীরা হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠাচ্ছে। রেমিট্যান্সের প্রবাহ বাড়াতে আন্ডার ইনভয়েসিং বন্ধ করতে হবে।"