কড়াকড়ি সত্ত্বেও কমছে না আমদানি, তিন মাসে বাণিজ্য ঘাটতি ৭.৫৪ বিলিয়ন ডলার
কড়াকড়ির কারণে নতুনভাবে অর্ডারের পরিমাণ কিছুটা কমলেও রপ্তানি কমে যাওয়া এবং আমদানি অর্থপ্রদান বেড়ে যাওয়ায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম ত্রৈমাসিকে দেশের বাহ্যিক বাণিজ্য ঘাটতি বছরে ১১.৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৭.৫৪ বিলিয়ন ডলার হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, দেশের বাণিজ্য ঘাটতি সেপ্টেম্বরে ছিল ৩ বিলিয়ন ডলার, আগস্টে ২.৪৭ বিলিয়ন এবং জুলাইতে ছিল ২.০৮ বিলিয়ন ডলার; অর্থাৎ ঘাটতি কেবল বেড়েছেই।
গত অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ের রপ্তানির তুলনায় দেশে আমদানি হয়েছে ৬.৭৭ বিলিয়ন ডলার বেশি।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন টিবিএসকে বলেন, "সরকারের আমদানি ব্যারিয়ার ও ব্যয় কমানোর পদক্ষেপের কারণে আমদানি এলসি ওপেনিং অনেকটা কমেছে।"
"তবে যে পণ্যে এলসি আগে ওপেন করা ছিল সেগুলোর এখন সেটেলমেন্টে হওয়ায় আমদানির পরিমাণটা বেশি," যোগ করেন তিনি।
গত তিন মাসে ওপেনিং কমছে উল্লেখ করে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, সামনে আমদানির পরিমাণ কমে আসবে।
চলতি অর্থবছরের (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ক্যাপিটাল মেশিনারি, ইন্টারমিডিয়েট গুডস, পেট্রোলিয়াম, ইন্ডাস্ট্রিয়াল কাঁচামালসহ সকল খাতে এলসি ওপেনিং এর পরিমাণ কমেছে ৮.৫৭%। যদিও একই সময়ে এলসি সেটেলমেন্ট বেড়েছে ৩১.৫৬%; এসময় সেটেলমেন্ট হয়েছে ২২.৪ বিলিয়ন ডলারের।
এই বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে মোট আমদানি হয়েছে ১৯.৩৪ বিলিয়ন ডলারের, যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ১৭.৩২ বিলিয়ন। অন্যদিকে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি হয়েছে ১১.৮ বিলিয়ন ডলার, যা এক বছর আগের ১০.৫ বিলিয়ন থেকে বেশি।
তবে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রকাশিত আমদানি তথ্য, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো প্রকাশিত রপ্তানি পরিসংখ্যান থেকে এক মাস পিছিয়ে আছে। প্রাপ্ত তথ্য থেকে দেখা গেছে, অক্টোবরে মাসিক রপ্তানি বছরে ৭.৮৫% কমে ৪.৩৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংক অক্টোবরে আমদানির তথ্য প্রকাশ করার পরেই এই সংখ্যার তুলনা করা যেতে পারে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, আমদানির জন্য নতুন এলসি খোলার পরিস্থিতি দেখে বলা যায়, আগামী মাসগুলোতে ঘাটতি কমতে পারে।
জাহিদ হোসেন বলেন, "বাণিজ্য ঘাটতির অন্যতম কারণ রপ্তানি কমছে। রপ্তানিকারকরা এক্সপোর্ট প্রসিড প্রতি পাচ্ছে ৯৯ টাকা ৫০ পয়সা, অথচ তারই ব্যাক টু ব্যাক এলসি খুলতে ডলার কিনতে হচ্ছে ১০৪ থেকে ১০৫ টাকায়।"
এদিকে টানা দুই মাস প্রবাসীদের রেমিট্যান্স হ্রাস অব্যাহত থাকায়, এ অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে চলতি হিসাবের ঘাটতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩.৬১ বিলিয়ন ডলার, যা গত বছরের ২.৫৪ বিলিয়ন ডলার থেকে বেশি।
অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, "আমাদের রিজার্ভের সংকটের মধ্যে রেমিট্যান্স কমা খুবই আশঙ্কাজনক। এক মার্কেটে একাধিক ফরেক্স মার্কেট রেট কোনভাবেই কাম্য নয়। এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত রেমিট্যান্সের ফ্লো বাড়াতে কার্ভ মার্কেটের সঙ্গে সমন্বয় করে রেমিট্যান্স রেট ঠিক করা।"
চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে প্রবাসীরা ৪ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। এরপর, টানা দুই মাস রেমিট্যান্স কমেছে। সেপ্টেম্বর এবং অক্টোবরে রেমিট্যান্স এসেছে ৩ বিলিয়নের কিছুটা বেশি।
এতে আরও চাপে পড়েছে দেশের ফরেন রিজার্ভ। দেশে বর্তমানে রিজার্ভ রয়েছে (বুধবার পর্যন্ত) ৩৫.৭২ বিলিয়ন ডলার।
এছাড়া আগামী সোমবার এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের বিল বাবদ আরও ১.৩২ বিলিয়ন ডলার পেমেন্ট করলে রিজার্ভ আরো কমবে।
বর্তমানে যে পরিমাণ রিজার্ভ রয়েছে তা দিয়ে চার মাসের আমদানি বিল পরিশোধ করা যাবে (প্রতি মাসে ৭ বিলিয়ন করে)।
পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর টিবিএসকে বলেন, "আমাদের রপ্তানি বৃদ্ধির দিকে খুবই মনোযোগ দেয়া দরকার। এখন উচিত ফরেক্স মার্কেট রেটকে ছেড়ে দেওয়া।"
"এছাড়া রিজার্ভের চাপ কমাতে রেমিট্যান্সের প্রবাহ বাড়াতে কার্ভ মার্কেটের তুলনায় ফরমাল মার্কেটের পার্থক্য কমিয়ে আনা উচিত। বিশেষ করে সরকারের উচিত মুল্যস্ফিতি নিয়ন্ত্রণে চাল, সবজিসহ সকল ধরণের পণ্য উৎপাদনে আরও গুরুত্ব দেওয়া," যোগ করেন তিনি।
দেশের বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ কমাতে এবং ডলার সাশ্রয় করতে গত এপ্রিল থেকে আমদানি কমাতে বিভিন্ন আমদানিতে এলসি মার্জিন আরোপ করা হয়।
প্রথমে ১১ এপ্রিল অত্যাবশ্যকীয় পণ্য ছাড়া সব ধরনের পণ্য আমদানিতে ২৫ শতাংশ এলসি মার্জিন আরোপ করা হয়।
গত ১০ মে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিলাসী পণ্য আমদানিতে ৭৫ শতাংশ ও বাণিজ্যিক পণ্য আমদানিতে ৫০ শতাংশ মার্জিন আরোপ করে। এরপর জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে সরকারি আমদানি ছাড়া সকল ধরণের পণ্য আমদানিতে ১০০ নগদ ক্যাশ মার্জিন আরোপ করা হয়।
বেসরকারি একাধিক ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের হেড বলেন, অধিকাংশ ব্যাংক ডলার সংকটে রয়েছে। এখন ব্যাংকগুলো আমদানির পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে।
এছাড়া সরকারি ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ডলার নিয়ে শুধু সরকারি আমদানি করছে। অধিকাংশ ব্যাংক আমদানি এলসি খোলার তুলনায় ডলার সংরক্ষণের দিকে ঝুঁকছে বলে জানান তারা।