গ্যাস আমদানি, খাদ্যের জন্য ডলার নিশ্চিত করার নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2022/10/15/pm_hasina.jpg)
হাইলাইটস:
• জ্বালানি বিভাগকে স্পট মার্কেট থেকে বেশি দামে গ্যাস আমদানির নির্দেশ
• লোকসান কমাতে শিল্পগুলোর কাছে বেশি দামে গ্যাস বিক্রির নির্দেশ
• খাদ্য আমদানির এলসি খোলার জন্য পর্যাপ্ত ডলার নিশ্চিতের নির্দেশ কেন্দ্রীয় ব্যাংককে
• বিলাসপণ্যে শুল্ক বাড়ানোর নির্দেশনা
• রেমিট্যান্স বাড়াতে পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশনা
• জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি নিয়ন্ত্রণের নির্দেশ
• কৃষি ও খাদ্যে ভর্তুকি অব্যাহত থাকবে
• ব্যাংক খাত থেকে কিছুটা বাড়তি ঋণ নেওয়ার পরামর্শ
শিল্পে গ্যাস সংকট মেটাতে স্পট মার্কেট থেকে উচ্চ দরে জ্বালানি আমদানি করে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিতে এবং খাদ্যপণ্য আমদানির জন্য এলসি খুলতে পর্যাপ্ত ডলার ডলার সরবরাহ নিশ্চিত করতে জ্বালানি বিভাগ ও বাংলাদেশ ব্যাংককে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
রোববার গণভবনে দেশের সার্বিক আর্থিক পরিস্থিতি ও প্রাসঙ্গিক বিষয়াদি নিয়ে পর্যালোচনা সভায় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, যেহেতু ব্যবসায়ীরা গ্যাসের জন্য বাড়তি দাম দিতে আগ্রহী, তাই শিল্পের উৎপাদন অব্যাহত রাখার স্বার্থে বেশি দামে গ্যাস আমদানি করে শিল্প-কারখানাতে বেশি দামেই সরবরাহ করা হবে।
সরকারের খাদ্যপণ্য আমদানির পাশাপাশি বেসরকারি খাতও যাতে গম, চিনি, তেলসহ বিভিন্ন ভোগ্যপণ্য আমদানির এলসি খুলতে পারে, সেজন্য ব্যাংকগুলোকে ডলার সরবরাহ করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
একই সঙ্গে গাড়ি, ফলমূল, খেলনাসহ বিলাসদ্রব্য আমদানির ওপর বাড়তি শুল্ক আরোপ করতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যানকে নির্দেশনা দিয়েছেন শেখ হাসিনা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ন্ডকে বলেন, ব্যবসায়ীরা যেহেতু বেশি দামে হলেও গ্যাস পেতে ইচ্ছুক, তাই প্রধানমন্ত্রী স্পট মার্কেট থেকে গ্যাস আমদানি করে বাড়তি দামে সরবরাহের নির্দেশনা দিয়েছেন।
'এই মুহূর্তে যেহেতু ইউরোপ-যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি বাড়ার খুব বেশি সম্ভাবনা নেই, তাই ব্যালান্স অব পেমেন্ট পরিস্থিতির উন্নয়নে রেমিট্যান্স বাড়ানোর উপর জোর দেওয়া, ভোগ্যপণ্যের নিরবচ্ছিন্ন আমদানি নিশ্চিত করা ও বিলাসপণ্যের আমদানি নিয়ন্ত্রণে নতুন করে শুল্ক আরোপ করার নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী,' জানান তিনি।
প্রধানমন্ত্রী হুন্ডি কারবারিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশও দিয়েছেন।
খাদ্যের বিষয়ে খাদ্য সচিব মো. ইসমাইল হোসেন টিবিএসকে বলেন, খাদ্য মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি বেসরকারি খাতও যাতে বিদেশ থেকে চাহিদা অনুযায়ী চাল ও গম আমদানি করতে পারে, সেজন্য প্রয়োজনীয় ডলার সরবরাহ করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরকে নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
কোনো ব্যাংকে ডলার সংকট থাকলে যাতে অন্য ব্যাংকের মাধ্যমে খাদ্য আমদানির এলসি করা যায়, গভর্নরকে তা-ও নিশ্চিত করতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী।
গভর্নর এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেবেন বলে জানিয়েছেন।
তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানির বিষয়ে বৈঠকে উপস্থিত একজন সচিব জানান, গ্যাস আমদানি মূল্য অনুযায়ী দেশে গ্যাসের দাম নির্ধারণ করা হবে নাকি নতুন দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে সরকারও কিছুটা ভর্তুকি দেবে, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়নি।
তিনি বলেন, বর্তমানে ক্যাপটিভ জেনারেটরের ক্ষেত্রে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের মূল্য ১৬ টাকা ও শিল্পের জন্য ১১ টাকা নির্ধারণ করা আছে। স্পট মার্কেট থেকে বর্তমান আন্তর্জাতিক দরে গ্যাস আমদানি করলে প্রতি ঘনমিটারের দর পড়বে ৪২ টাকা। কিন্তু শিল্প মালিকরা প্রতি ঘনমিটারে ২৮ টাকা দাম দিতে রাজি আছেন।
'এখন জ্বালানি বিভাগ থেকে গ্যাসের নতুন দাম নির্ধারণের প্রস্তাব করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে সার-সংক্ষেপ পাঠানো হবে। প্রধানমন্ত্রী যেভাবে অনুমোদন দেবেন, সেভাবেই দাম নির্ধারণ হবে,' জানান তিনি।
বাড়তি দামে গ্যাস সরবরাহে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন ফেডারেশন অভ বাংলাদেশ চেম্বারস অভ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (এফবিসিসিআই) সভাপতি মো. জসিম উদ্দীন। তিনি বলেন, বৈশ্বিক মন্দা পরিস্থিতির কারণে এমনিতেই পোশাক রপ্তানির কার্যাদেশ ৩০ শতাংশ কমে গেছে।
গ্যাস সংকট অব্যাহত থাকলে যেসব কার্যাদেশ পাওয়া যাচ্ছে, তা-ও সময়মতো রপ্তানি করা সম্ভব হবে না।
'ব্যবসায়ীরা বাড়তি দামে গ্যাস কিনতে প্রস্তুত আছে। নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ সম্ভব হলে দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হারও কমে যাবে। গ্যাস সংকটের কারণে চিনি পরিশোধন ৩৪ শতাংশ কমে যাওয়ায় বাজারে চিনির সংকট দেখা দিয়েছে। অন্যান্য খাদ্যপণ্য উৎপাদন খরচ বাড়ছে, যার প্রভাব পড়ছে মূল্যস্ফীতিতে,' জানান তিনি।
বাংলাদেশ চেম্বার অভ ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজও বেশি দামে গ্যাস সরবরাহের সিদ্ধান্তের প্রশংসা করে বলেন, এই মুহূর্তে দেশের জন্য সবচেয়ে বেশি দরকার মূল্যস্ফীতি কমানো ও বৈদেশিক মুদ্রা আহরণ বাড়ানো।
এজন্য ভোগ্যপণ্য ও রপ্তানিমুখী শিল্পের উৎপাদন সচল রাখতে হবে, ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ চালু রাখতে হবে। এজন্য গ্যাসের কোনো বিকল্প নেই, বলেন তিনি।
বিজিএমইএর সহসভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম টিবিএসকে বলেন, যেসব কারখানায় ক্যাপটিভ জেনারেট রয়েছে, তারা ২৪ ঘণ্টা নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের শর্তে বাড়তি দাম পরিশোধে রাজি আছে। সরকারের এ সিদ্ধান্ত শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সহায়ক হবে।
'কারখানা পুরোপুরি বন্ধ রাখার চেয়ে একটু বাড়তি খরচে উৎপাদন কার্যক্রম চালাতে পারলে তা ব্যবসায়ীদের জন্য যেমন ভালো, তেমনি দেশের অর্থনীতির জন্যও ভালো,' বলেন তিনি।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ বলেন, সরকারের এই ইতিবাচক উদ্যোগ বাংলাদেশের উপর ক্রেতাদের আস্থা বাড়াবে।
'এই সংকটকালে শিল্পকে সহায়তা করার জন্য এরকম সময়োপযোগী সহায়তার জন্য আমরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞ। আগস্টে বিকেএমইএর পক্ষ থেকে আমরা দাবি করেছিলাম স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানির জন্য যেন রিজার্ভ থেকে আরও ২০০ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ দেওয়া হয়,' যোগ করেন তিনি।
ভর্তুকি থাকবে
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রা পরিস্থিতি নিয়ে একটি প্রেজেন্টেশন দেয়। বাজেট বরাদ্দের তুলনায় সার, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খাদ্যে ভর্তুকি অনেক বেশি বেড়ে যাওয়ার চিত্র প্রেজেন্টেশনে তুলে ধরেন অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা।
কৃষি ও খাদ্যে ভর্তুকি অব্যাহত রাখার পরামর্শ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের ভর্তুকি নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বলেছেন।
চলতি অর্থবছরের বাজেটে ভর্তুকিতে ৮২ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে জানিয়ে অর্থবিভাগ প্রধানমন্ত্রীকে বলেছে, সার আমদানিতে গত অর্থবছরে ২৮ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি লেগেছে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ৬ মাসের হিসাব অনুযায়ী এ বছর এই খাতে ভর্তুকি ৪৬ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) ১ কোটি পরিবারকে খাদ্য সহায়তা দিচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজার থেকে বেশি দামে চাল ও গম আমদানি করে আগের দামে ওএমএস কর্মসূচি পরিচালনা করায় খাদ্য ভর্তুকিও বাড়ছে।
তবে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ভর্তুকি বাড়ছে সবচেয়ে বেশি। ভর্তুকির চাপ কমাতে মূল্য সমন্বয়, চাহিদা ব্যবস্থাপনা ও ব্যাংক খাত থেকে বাড়তি ঋণ নিয়ে অর্থ সংস্থানের পরামর্শ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
ভর্তুকি কমানোর বিভিন্ন বিকল্প নিয়ে আলোচনা হলেও বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি বলে সভায় উপস্থিত একজন সচিব নিশ্চিত করেছেন।
উন্নয়নশীল দেশে বাজেট ঘাটতি ও উচ্চ ভর্তুকি থাকবেই বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি ব্যাংকিং খাত থেকে কিছুটা বাড়তি ঋণ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। 'তবে সরকার বিদ্যুৎ-জ্বালানিতে ভর্তুকি পুরোপুরি প্রত্যাহার করবে না' বলে জানান ওই সচিব।
বিলাসপণ্যের আমদানি কমানোর বিষয়ে বাণিজ্য সচিব জানান, তার মন্ত্রণালয় কয়েক মাস আগেই ৩৪০টি বিলাসপণ্যের তালিকা এনবিআরকে দিয়ে বাড়তি শুল্ক আরোপের কথা বলেছে।
জানুয়ারিতে কমবে ডলার বাজারের অস্থিরতা
বাংলাদেশ ব্যাংকও বিলাস পণ্যের এলসি মার্জিন বাড়িয়েছে। এখন কম গুরুত্বপূর্ণ ও বিলাসপণ্যে নতুন করে শুল্ক আরোপ করা হতে পারে।
বৈদেশিক মুদ্রা পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার বলেন, তিনি আশা করছেন যে জানুয়ারিতে ডলার বাজারের অস্থিরতা কমে আসবে।
ডলারের রেটে পার্থক্য আছে। রপ্তানিতে ডলারের দাম পাওয়া যায় ৯৯ টাকা, আমদানিতে দাম দিতে হয় ১০৫ টাকা। কিন্তু বেশিরভাগ দেশেই এতো পার্থক্য থাকে না।
এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক যুক্তি দিয়েছে যে, রপ্তানিকারকরা নগদ প্রণোদনা ও রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল থেকে কম সুদে ঋণ পায়।
গভর্নর বলেছেন, এই পার্থক্য ধীরে ধীরে কমে যাবে, তবে এটি ৮৬ বা ৯০ টাকায় আসবে না।