নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানে থাকা ৬৬৮ কোটি টাকা আমানতের আশা কি ছাড়তে হবে আইসিবি'কে?
বিনিয়োগের বাজে সিদ্ধান্ত দুরবস্থায় ফেলেছে ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি)-কে।
১০টি নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানে (এনবিএফআই) ৬৬৮ কোটি টাকার ডিপোজিট এবং তার ১০০ কোটি টাকা সুদ– মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও না পেয়ে, সাহায্যের জন্য এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের দ্বারস্থ হয়েছে আইসিবি।
আইসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপের পর, প্রতিষ্ঠানগুলির দুর্বল আর্থিক অবস্থা বিবেচনা করে ২০২১ সালে সেপ্টেম্বরে আংশিক সুদ পরিশোধ সাপেক্ষে মেয়াদোত্তীর্ণ ডিপোজিট নিষ্পত্তির (নগদায়নের) সময়সীমা আরও এক বছর বাড়ানো হয়। কিন্তু, ১০টির মধ্যে মাত্র পাঁচটি প্রতিষ্ঠান রিপেমেন্ট চুক্তি নবায়ন করে, যার মেয়াদও এরমধ্যে পেরিয়েছে। এজন্যই মেয়াদোত্তীর্ণ ডিপোজিটগুলো নগদায়ন করার ব্যবস্থা নিতে সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংককে চিঠি দিয়েছে আইসিবি।
সংকটের শুরু যেভাবে
প্রাথমিকভাবে দেশের পুঁজিবাজার উন্নয়নের উদ্দেশ্যে ১৯৭৬ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে দেশের ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ, বিদ্যুৎ, টেক্সটাইল এবং অন্যান্য পরিষেবা খাতে– ব্রিজ লোন, ডিবেঞ্চার লোন, লিজ ফাইন্যান্সিং, ব্যাংক গ্যারান্টি, ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফাইন্যান্সিং, ইক্যুইটির ওপর অগ্রিম, অগ্রাধিকারমূলক শেয়ারে বিনিয়োগ এবং আইপিও-পূর্ব প্লেসমেন্ট শেয়ারে বিনিয়োগসহ নানা উদ্যোগে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করেছে আইসিবি।
আইসিবি'র সরকারি প্রতিষ্ঠান বিষয়ক সংসদীয় কমিটির কাছে জমা দেওয়া সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে অনুসারে, গত বছরের জুন পর্যন্ত মোট ৪৪৬টি প্রকল্পে ২ হাজার ৭৩৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে কর্পোরেশনটি।
কিন্তু, সাম্প্রতিক বছরগুলিতে দুর্বল এনবিএফআই'গুলোতে বিনিয়োগ অসীম গুরুত্বের সরকারি এই সংস্থাকে অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মধ্যে ফেলেছে। হিসাব মহানিয়ন্ত্রক কার্যালয় (কম্পট্রোলার জেনারেল অভ একাউন্টস বা সিএজি)-র এক প্রতিবেদন অনুসারে, অনিয়ম ও ঝুঁকিপূর্ণভাবে বিনিয়োগ করায় আইসিবির প্রায় ১ হাজার কোটি টাকার আমানত আটকে গেছে।
আইসিবির কর্মকর্তারা জানান, পুঁজিবাজারকে সমর্থন দেওয়ার পাশাপাশি উদ্বৃত্ত তহবিল বিভিন্ন ব্যাংক ও নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করে আইসিবি।
এর সাথে সঙ্গতি রেখে- ২০১৭-১৮ মেয়াদে পুঁজিবাজারে মন্দার মধ্যে কর্পোরেশনটির সদর দপ্তরসহ কয়েকটি শাখা অফিস– ১০টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে (নন-ব্যাংক) বার্ষিক ৯-১২% সুদে ৬৬৮.৩৮ কোটি টাকা আমানত রাখে।
যেসব এনবিএফআই- এ আইসিবি এই আমানত রাখে সেগুলো হলো– পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সসিয়াল সার্ভিসেস, ফাস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স, ফার্স্ট ফাইন্যান্স লিমিটেড, বাংলাদেশ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট, প্রাইম ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট, প্রিমিয়ার লিজিং অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট, ফার্স্ট ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট, রিলায়েন্স ফাইন্যান্স ইনভেস্টমেন্ট এবং ফোনিক্স ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড।
তবে ঋণ কেলেঙ্কারি ও অনিয়মের কারণে আমানত নেওয়া কয়েকটি প্রতিষ্ঠান সংকটে পড়লে- অনিশ্চিয়তার মধ্যে পড়ে আইসিবির আমানত ও সুদ আদায়।
এই পরিস্থিতিতে মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও এফডিআর ডিপোজিট নগদায়ন করতে না পারায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপ চায় আইসিবি।
সেই সূত্র ধরেই ২০২১ সালের আগস্টে আমানত নগদায়নে ব্যর্থ হওয়া নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তাদের নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নরের সভাপতিত্বে বৈঠক হয়।
ওই বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ২০২১ সালের ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে আংশিক সুদ পরিশোধ সাপেক্ষে এনবিএফআই-গুলোকে এফডিআর নগদায়নের নির্দেশনা প্রদান করা হয়।
এই নির্দেশনা পেয়ে- পাঁচটি প্রতিষ্ঠান সুদ পরিশোধ করে। আর এফডিআর নগদায়নের মেয়াদ এক বছর বাড়ায়।
আইসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল হোসেন টিবিএসকে বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপের পর যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, সেটা তারা মানছে না। যে কয়েকটি চুক্তি নবায়ন করেছে, তাদের মেয়াদও শেষ হয়েছে'।
হিসাব মহানিয়ন্ত্রকের কার্যালয় (সিএজি) ২০১৭-১৮ থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছর পর্যন্ত আইসিবির তহবিল ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত কর্মকাণ্ডের একটি প্রতিবেদনও জমা দিয়েছে সংসদে। এতে বলা হয়েছে, অনিয়মিত ও ঝুঁকিপূর্ণভাবে বিনিয়োগ করায় এফডিআরের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও নগদায়ন ও সুদ না পাওয়ায় আইসিবির ৭৬৬.৭৪ কোটি টাকা অনাদায়ী।
সিএজি'র প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১০টি নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠাত আইসিবির সব বিনিয়োগ ও সুদ অনাদায়ী রয়েছে। কিন্তু আইসিবি বলছে, পাঁচটি প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগকৃত এফডিআর নিয়মিত রয়েছে। আর অবশিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ ও সুদ আদায় প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।
সিএজি'র প্রতিবেদন অনুসারে, নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সবচেয়ে বেশি ১৯৮.৪০ কোটি টাকা এফডিআর করে আইসিবির স্থানীয় শাখা। সে তুলনায়, প্রধান কার্যালয়ের এফডিআর ১২৭.৯৩ কোটি টাকা, চট্টগ্রাম শাখার ৭৫ কোটি, খুলনা শাখার ৪২ কোটি, রাজশাহী শাখার ১২৫.৫৭ কোটি এবং সিলেট শাখার ১৩২.৭৯ কোটি টাকা।
দুর্বল নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, যেসব এনবিএফআই আইসিবির ডিপোজিট ফেরৎ দিতে পারেনি– তাদের চরম বাজে দশা।
এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দেশের আর্থিক খাতের অনিয়ম ও কেলেঙ্কারির সাথে জড়িত পিপলস লিজিং, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, প্রিমিয়ার লিজিং ও ফার্স্ট ফাইন্যান্স। একারণে এই প্রতিষ্ঠানগুলি বড় ধরনের সংকটের মধ্যে রয়েছে।
এই এনবিএফআই-গুলোর বিতরণ করা ঋণের বড় অংশ এখন খেলাপি।ফলে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের যেসব মেয়াদি আমানত নিয়েছে, তাও ফেরত দিতে ব্যর্থ হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত এই চার প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৬,১৪১ কোটি টাকা।
এককভাবে ন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২,৯০০ কোটি টাকা, ফাস ফাইন্যান্সের ১,৭২৩ কোটি, প্রিমিয়ার লিজিংয়ের ৭৬৬ কোটি, ফারইস্ট ফাইন্যান্সের ৪৭৫ কোটি এবং ফার্স্ট ফাইন্যান্সের ২৭৭ কোটি টাকা।
আইসিবির এফডিআর নগদায়ন করতে না পারার বিষয়ে জানতে চাইলে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মশিউর রহমান (ভারপ্রাপ্ত) দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, অস্বাভাবিক হারে নন-পারফর্মিং লোন বৃদ্ধি এবং তারল্য সংকটের কারণে আমরা আইসিবির আমানত ফেরত দিতে পারিনি। 'আমরা চুক্তি নবায়ন করছি এবং তাদের কোম্পানির শেয়ার নেয়ার প্রস্তাব দেওয়ার পরিকল্পনা করছি'।
অনিয়মের অভিযোগ
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের নীতি ও আর্থিক প্রণোদনা শাখার এক অধ্যাদেশ অনুসারে, এনবিএফআই থেকে মেয়াদি আমানত নগদায়নের পর আইসিবিকে অবশ্যই সেই অর্থ একটি ব্যাংকে রাখতে হবে। কিন্তু, হিসাব মহানিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ের প্রতিবেদন অনুসারে, প্রতিষ্ঠানটি এই নির্দেশনা মেনে চলেনি।
এপ্রসঙ্গে আইসিবি হিসাব মহানিয়ন্ত্রকের কার্যালয়কে জানিয়েছে, নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান এফডিআর- এর অর্থ ফেরত দিতে না পারায় তারা নির্দেশনাটি মানতে ব্যর্থ হয়েছে।
হিসাব মহানিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ের প্রতিবেদনে, আইসিবিকে অর্থ পুনরুদ্ধারে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার তাগিদ দেওয়া হয়।
এতে বলা হয়, সরকারি সম্পদ ও অর্থের ব্যবহারে অনিয়ম হয়েছে। অনিয়মের সাথে জড়িতদের খুঁজে বের করতে একটি অডিট করা হয়েছে বলেও জানানো হয়।