রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধি ও বাণিজ্যিক অসাধুতা রোধে বিশেষায়িত ইউনিট স্থাপনের প্রস্তাব এনবিআরের
২০৩২ সালকে লক্ষ্যে রেখে– কর ভিত্তি এবং কর প্রশাসনে আরও দক্ষতা আনতে রাজস্ব কৌশলের একটি খসড়া পরিকল্পনা তৈরি করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। রাজস্ব কর্মকর্তারা জানান, রাজস্ব আহরণ যখন চাপের মধ্যে তখনই এ পরিকল্পনা করা হচ্ছে। খসড়া পরিকল্পনায় রয়েছে, ব্যবসাবাণিজ্যের তহবিলে অসাধুতা এবং মিস-ইনভয়েসিং এর মাধ্যমে বছরে শত শত কোটি টাকা পাচার রোধে একটি বিশেষায়িত ইউনিট গঠনের প্রস্তাব।
'স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদি রাজস্ব কৌশল' (এমএলটিআরএস) শীর্ষক এই কর্মপরিকল্পনার আরও লক্ষ্য– রাজস্ব ব্যবস্থাপনার উন্নতি এবং আরো স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জনমনে কর ব্যবস্থা সম্পর্কে নেতিবাচক ধ্যানধারণার পরিবর্তন।
খসড়া কর্ম তালিকাকে তিনটি শ্রেণিতে– স্বল্প, মধ্য এবং দীর্ঘমেয়াদি হিসেবে ভাগ করা হয়েছে।
এতে কর কর্মকর্তা ও করদাতার মধ্যে আস্থার ঘাটতি পূরণ, আহরণ ব্যয় কমাতে করদাতার স্বপ্রণোদিতভাবে নিয়মনীতি মেনে চলা এবং স্বল্প মেয়াদে বা ২০২৪ সালের বাজেট পূর্ব সময়ে নীতিনির্ধারক ও করদাতাদের মধ্যে প্রাক-বাজেট আলোচনার মতো কর্মতালিকা রয়েছে।
স্বল্প মেয়াদি অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে আছে– মূল্য সংযোজন কর, সম্পূরক শুল্ক আইনকে মেয়াদি সংস্কারের মাধ্যমে আপডেটেড রাখা, নতুন কাস্টমস আইন কার্যকর এবং বিদ্যমান শুল্ক নীতির কার্যকারিতা মূল্যায়ন।
রাজস্ব কর্মকর্তারা বলছেন, এতে করে জিডিপির তুলনায় কর অনুপাত বেড়ে ২০২৫ সাল নাগাদ ১২.৩% এবং ২০৩১ সাল নাগাদ ১৭% হবে, বর্তমানে যা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্ন বা ৮ শতাংশের কম রয়েছে।
ট্যাক্স টু ডিডিপি অনুপাত হলো– একটি দেশের মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির তুলনায় কর রাজস্বের অনুপাত। অর্থনৈতিক সম্পদকে সেদেশের সরকার কতোটা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছে– এর মাধ্যমে সে সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়।
রাজস্ব বোর্ডের মধ্য মেয়াদের দায়িত্বগুলো ২০২৭ সালের মধ্য সম্পন্ন হওয়ার লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে; যার মধ্যে রয়েছে বাণিজ্যে অসাধুতা ও মিস-ইনভয়েসিং রোধে বিশেষায়িত ইউনিট স্থাপন। ওয়াশিংটন-ভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির হিসাব অনুযায়ী, এসব অসাধুতা প্রক্রিয়ায় ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বছরে প্রায় ৮.২৭ বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে।
খসড়াটি প্রণয়নে নেতৃত্বদানকারী এবং চট্টগ্রামের এক্সাইজ অ্যান্ড ভ্যাট কমিশনারেটের কাস্টমস কমিশনার সৈয়দ মুশফিকুর রহমান জানান, স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে বাংলাদেশের উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের চ্যালেঞ্জগুলোর অভিঘাত যেন বাংলাদেশের ওপর কম হয়, সেভাবেই এ রাজস্ব পরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছে।
"পুরো পরিকল্পনায় রাজস্ব বৃদ্ধির প্রতি জোর দেওয়া হয়েছে। এটি সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হলে এবং বিশ্ব অর্থনীতির পরিস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরলে– ২০২৫ সাল নাগাদ ট্যাক্স-জিডিপি অনুপাত ১২.৩ শতাংশ হবে"- মঙ্গলবার (১৩ ডিসেম্বর) দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন তিনি।
রাজস্ব পরিকল্পনার খসড়াটি ইতোমধ্যেই এনবিআরের চেয়ারম্যানের কাছে জমা দেওয়া হয়েছে। অনুমোদন পেলে ২০২৩ সালের ২৬ মার্চ থেকে এর কার্যক্রম শুরু হবে।
২০২১-২২ অর্থবছরে রাজস্ব আহরণে ১৬ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে রাজস্ব বোর্ড। তবে এই বছরের আহরণ প্রবৃদ্ধি এখন পর্যন্ত সন্তোষজনক নয়।
রাজস্বের সর্বশেষ তথ্যানুসারে, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে রাজস্বে প্রবৃদ্ধি হয়েছে যথাক্রমে ৭ ও ১০ শতাংশ। আগামী মাসগুলোয় এটি উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ার কোনো সম্ভাবনাও দেখছেন না কর্মকর্তারা।
রাজস্ব আদায় চাঙ্গা করতে– ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ইলেকট্রিক ফিসক্যাল ডিভাইসের ব্যবহার বৃদ্ধি; তৃণমূল পর্যায়ে ব্যবসাগুলির জন্য বিজনেস আইডেন্টিফিকেশন নম্বর (ব্যবসা পরিচিতি নম্বর) বাধ্যতামূলক করা; ট্যাক্সপেয়ার আইডেনটিফিকেশন নাম্বার (টিন নম্বর) ধারী সকলের জন্য কর রিটার্ন জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক করা এবং জরিমানা বৃদ্ধির মতো বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে এনবিআর।
অর্থ পাচারের ঘটনা তদন্ত করবে বিশেষায়িত ইউনিট
শুল্ক ফাঁকি দেওয়া, বাণিজ্য সংক্রান্ত অর্থ পাচার ও সন্ত্রাসবাদে অর্থায়নের ঘটনা তদন্তে খসড়াতে একটি বিশেষ ইউনিট গঠনের সুপারিশ করা হয়েছে। এছাড়া, বিদেশের বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশনগুলোতে কাস্টমস অ্যাটাশের পদ তৈরির সুপারিশ রয়েছে।
রাজস্ব বোর্ডের পরিকল্পনা মতে, উপরোক্ত দুটি সমন্বিত লক্ষ্য আগামী ১০ বছরের মধ্যে অর্জিত হবে।
এছাড়া, বৈদেশিক বাণিজ্যের নামে মিথ্যা ঘোষণা বা মিস-ইনভয়েসিং এখন বাংলাদেশে বহুল আলোচিত-সমালোচিত বিষয়। কারণ, বাংলাদেশের প্রায় সিংহভাগ বা ৮০ শতাংশ অর্থপাচারই বাণিজ্যের নামে করা হচ্ছে।
চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে মিস-ইনভয়েসিং নিয়ে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার বলেছিলেন, সম্প্রতি তারা ১০০টি ঋণপত্র (এলসি) বাতিল করেছেন। এগুলোতে ২০০ শতাংশের বেশি ওভার ইনভয়েসিং করা হয়েছিল।
মিস-ইনভয়েসিং রোধ করা গেলে বানিজ্য-ভিত্তিক অর্থপাচার রোধ করাও সম্ভব হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
মিথ্যা ঘোষণা বা মিস-ইনভয়েসিং সমস্যার দিকে দীর্ঘদিন ধরেই আলোকপাত করে আসছেন অর্থনীতিবিদেরা। এই অসাধু প্রক্রিয়ায়, পণ্যের দাম প্রকৃত মূল্যের চেয়ে বাড়িয়ে বা কমিয়ে দেখানো হয়। অসাধু আমদানিকারকরা প্রথমত পণ্যের দাম বেশি দেখায় এবং তারপর ওভার ইনভয়েসিং এর মাধ্যমে বিদেশের রপ্তানিকারকদের থেকে অতিরিক্ত অর্থ সংগ্রহ করে।
অন্যদিকে, আন্ডার-ভয়েসিং এর মাধ্যমে কিছু রপ্তানিকারক পণ্যের দাম প্রকৃত মূল্যের চেয়ে কম দেখায়, এবং তারপর বিদেশের আমদানিকারকদের থেকে অতিরিক্ত অর্থ সংগ্রহ করে।
রাজস্ব বোর্ডের সদস্য শহিদুল ইসলাম মনে করেন, বিদেশে এরিয়াভিত্তিক কাস্টমস অফিসার থাকলে মিস-ইনভয়েসিং ও অর্থপাচার উল্লেখযোগ্যভাবে রোধ করা যাবে। কারণ ওই কর্মকর্তা আমদানি-রপ্তানি চালান বিষয়ে তাৎক্ষনিক খোঁজ নিয়ে সঠিক তথ্য উদ্ঘাটন করতে পারবেন।
তিনি বলেন, ২০১১ সালেই রাজস্ব কর্মকর্তারা এ ধরনের একটি প্রস্তাব দিয়েছিলেন, কিন্তু কিছদূর গিয়ে তা আর এগোয়নি।
ভারত, পাকিস্তান, চীন, জাপানের বিদেশি মিশনগুলোতে এ ধরনের পদ আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশও এটি চালু করতে পারে।