ইডিএফ ঋণের পরিসর কমাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক
দ্রুতগতিতে কমতে থাকা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে চাপ কিছুটা কমাতে রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ) এর পরিসর কমানোর প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক, জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
রপ্তানিকারকদের ক্যাপিটাল মেশিনারি ও রপ্তানিপণ্যের র ম্যাটেরিয়াল আমদানির জন্য ডলারে ইডিএফ ঋণ প্রদানের পরিবর্তে, টাকায় একটি রিফাইন্যান্স স্কিমের প্রকল্প বিবেচনা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক টিবিএসকে বলেন, "ইডিএফ লোন নিয়ে যেহেতু অনেক জায়গাতেই কনফিউশন হচ্ছে যে এটা রিজার্ভের পার্ট কিনা, তাই আমরা এই স্কিমটাকে একটু অন্যভাবে রিডিজাইন করতে চাই।"
"আমরা কখনো বলিনি ইডিএফ লোনের প্রয়োজনীয়তা শেষ হয়ে গেছে। ইডিএফ লোন এক ফর্মে না থাকলে হয়তো অন্য ফর্মে থাকবে। রিজার্ভ থেকে ইডিএফ লোন কমানো হলে হয়তো অন্য বিকল্প ফর্মে এই সুবিধা অব্যাহত রাখা হবে," বলেন তিনি।
রপ্তানিকারকদেরকে বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ দেওয়ার জন্য রিজার্ভ থেকে ৭ বিলিয়ন ডলারের ইডিএফ গঠন করা হয়েছে। রপ্তানিকারকরা তাদের রপ্তানি আয় থেকে ৪% সুদে ২৭০ দিন পর্যন্ত সময় পাবেন ঋণ পরিশোধ করতে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, তারা ইতোমধ্যেই ইডিএফ এর লাগাম টেনে ধরেছেন।
উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, "ইডিএফ থেকে দেওয়া লোনের ১০ টাকা ফেরত আসলে সেখান থেকে ৮ টাকা আবার লোন হিসেবে দেওয়া হচ্ছে। বাকিটা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভের সঙ্গে সমন্বয় করা হচ্ছে।"
সম্ভাব্য ৪.৫ বিলিয়ন ডলারের ঋণ নিয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সাথে আলোচনার সময় ইডিএফ নিয়েও কথা হয়। তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ফরেক্স রিজার্ভ গণনার সময় হিসাব থেকে ইডিএফ ঋণ বাদ রাখতে বলেছিল।
ঐ কর্মকর্তা আরো বলেন, "এখন ইডিএফ থেকে লোন নিলে সেটি পরিশোধের জন্য ২৭০ দিন পর্যন্ত সময় পাওয়া যাচ্ছে। এর মানে হলো ২৭০ দিন পর্যন্ত রিজার্ভের টাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে থাকছে না।"
"এটা একটা বড় দুর্বলতা। বড় অর্থনীতির দেশগুলো বৈশ্বিক মন্দার আশঙ্কা করায় বিশ্ব অর্থনীতি কোন দিকে যাবে, এ নিয়ে কিছুটা অনিশ্চয়তা আছে। ফলে আমদানিনির্ভর দেশ হওয়ায় সামনে বাংলাদেশের ডলারের চাহিদা বাড়ার শঙ্কা রয়েছে। এসব কারণে ডলারে ইডিএফ লোন কমিয়ে নেট রিজার্ভ বাড়াতে চাইছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক," যোগ করেন তিনি।
উক্ত কর্মকর্তার মতে, ইডিএফ ঋণের আকার কমিয়ে আনলে রিজার্ভ বাড়ানো সম্ভব হবে, পাশাপাশি আমদানি অর্থপ্রদানের জন্য বৈদেশিক মুদ্রার তারল্য বাড়াবে।
যদি টাকায় রিফাইন্যান্স স্কিমটি ইডিএফ এর তহবিলকে প্রতিস্থাপন করে, তাহলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই প্রকল্প থেকে টাকায় ব্যবসায়ীদের ঋণ প্রদান করবে। তারপর তারা ব্যাংকিং চ্যানেল থেকে ডলার কিনে ক্যাপিটাল ইমপোর্টের জন্য অর্থ প্রদান করবে।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, "কেন্দ্রীয় ব্যাংক সব সময়ই আমদানি-রপ্তানি প্রবাহের ভারসাম্য রক্ষার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা নিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি টাকায় এ ধরনের একটি স্কিম গঠন করে তাহলে আমরাও কর্তৃপক্ষকে অ্যাপ্রিশিয়েট করবো।"
বাড়তি ডলারের চাপ নিয়ে আশঙ্কা ব্যাংকগুলোর
ডলারে ইডিএফ লোনের পরিমাণ কমানোতে দেশের ফরেইন কারেন্সি রিজার্ভ কিছুটা স্বস্তি পেলেও ব্যাংক খাতে ডলারের বাড়তি চাহিদা তৈরি হবে বলে মনে করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।
তাদের মতে, ইডিএফ থেকে লোনের পরিমাণ ২ বিলিয়ন ডলার কমানো হলেও রপ্তানিকারকেরা সেই পরিমাণ ডলার ব্যাংক চ্যানেল থেকে ম্যানেজ করতে চাইবে। এতে করে ব্যাংকগুলোতে বর্তমানে কিছুটা কমে আসা ফরেইন কারেন্সি লিকুইডিটি ক্রাইসিস আবার ফিরতে পারে।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং সিইও সৈয়দ মাহবুবুর রহমান টিবিএসকে বলেন, "রিজার্ভ থেকে ইডিএফ লোন কমানো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি ভালো উদ্যোগ। এমন হলে অবশ্য আমাদের ব্যাংকিং চ্যানেলের উপর বাড়তি ডলার ম্যানেজ করার একটা চাপ থাকবে।"
২০২০ সালের এপ্রিলে ৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করা হয় রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল। এরপর এ তহবিল ৭ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়।
কোভিডের ধাক্কা কাটিয়ে উঠার পাশাপাশি অর্থনীতি পুনরায় সচল হওয়ার এ সময়টাতে দ্রুতগতিতে কমতে শুরু করেছে রিজার্ভ।
চলতি বছরের জুনে যখন রিজার্ভের পরিমাণ দ্রুত কমতে থাকে, সেসময় বাংলাদেশ ব্যাংক লক্ষ্য করে, ইডিএফ থেকে প্রদত্ত ঋণ কিছু রপ্তানিকারক অপব্যবহার করছে। নির্ধারিত তারিখে ঋণদাতারা অর্থ প্রদানে ব্যর্থ হওয়ায়, সেগুলো বিশাল ঋণে পরিণত হয়।
ক্রেতারা অর্থ ফেরত দিতে ব্যর্থ হওয়ায় এসব ঋণ থেকে কোনো রপ্তানি আয় হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংক অনুসন্ধানের মাধ্যমে দেখেছে, এর ফলে ব্যাংকগুলোতে ফোর্সড লোন জমা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক চলতি বছরের নভেম্বরে ইডিএফ ঋণের সুদের হার বাড়িয়ে ৪% করেছে; তবে ছয় মাসের এলআইবিওআর রেটের সুদ (প্রায় ৫%) থেকে এটি কম।
২১ ডিসেম্বর বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৩৪.০১ বিলিয়ন ডলার।