জুলাই-নভেম্বরে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের চেয়ে উত্তোলন বেশি
কোভিড পরবর্তি সময়ে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, বিশ্ববাজারের সঙ্গে সমন্বয় করতে গিয়ে দেশীয় জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধিতে চাল ও ভোজ্য তেলসহ প্রায় সব ধরনের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ায় হিমশিম খাচ্ছে স্বল্প ও মধ্যআয়ের মানুষ। টাকা জমা না রেখে ব্যাংক ও বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগের টাকা তারা উত্তোলন করছে বেশি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি বছরের জুলাই-নভেম্বর পর্যন্ত সরকারের জাতীয় সঞ্চয়পত্রে মোট বিনিয়োগ হয়েছে ৩৪,৯৩৪ হাজার কোটি টাকা। অথচ এই সময়ে গ্রাহক আগের বিনিয়োগর টাকা উত্তোলন করেছে ৩৬,৫৪৯ কোটি টাকা।
অর্থাৎ মানুষ সঞ্চয়ের তুলনায় এ খাত থেকে ১৬১অ কোটি টাকা বেশি তুলে নিয়েছে।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, অতিরিক্ত মুল্যস্ফিতির কারণে ব্যাংকগুলোতে ডিপিএস বা এফডিআর হিসাব খোলার প্রবণতা অনেক কমেছে, একইসঙ্গে বেড়েছে ব্যক্তি পর্যায়ের ঋণ। ব্যাংকগুলোর মেয়াদি আমানতের প্রবৃদ্ধি কমেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর সরকারের সঞ্চয়পত্র থেকে নীট ঋণের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে ৩৫ হাজার কোটি টাকা। অথচ চলতি বছরের জুলাই-নভেম্বর সময়ে সরকার নীট ঋণ না নিয়ে উল্টো ১৬১০ কোটি টাকা বেশি পরিশোধ করেছে।
যদিও ২০২১-২২ অর্থবছরের একই সময়ে সরকারের এই খাত থেকে নীট ঋণের পরিমাণ ছিল ১০,০২৫ কোটি টাকা। এর আগের ২০২০-২১ অর্থবছরের একই সময়ে ঋণের পরিমাণ ছিল ১৯,০৪৪ কোটি টাকা।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং সিইও সৈয়দ মাহবুবুর রহমান টিবিএসকে বলেন, "বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম বৃদ্ধির কারণে দেশের আমদানিকৃত সকল পণ্যের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর কারণে মানুষ সকল খাতে বিনিয়োগ কম করছে।"
"মুল্যস্ফিতি বাড়ার কারণে সাধারণ মানুষদের মধ্যে কিছুটা অনিশ্চয়তা রয়েছে তাই তারা আগের বিনিয়োগের মেয়াদ শেষ হলেই নতুন করে আর বিনিয়োগ না করে টাকা হাতে রাখছে,"
তিনি আরও বলেন, "কোভিডের সময়েও দেখা গেছে বিভিন্ন খাতে মানুষের বিনিয়োগ ভালোই ছিল। কারণ সেসময় মুল্যস্ফিতির এতটা প্রেশার ছিলো না। এছাড়া কোভিডের পর থেকে ব্যাংকগুলো অতিরিক্ত ডলার কিনতে যেয়ে তারল্য সংকটে রয়েছে।"
জাতীয় সঞ্চয়পত্র অধিদপ্তরের পরিচালক (যুগ্মসচিব) মো. শাহ আলম টিবিএসকে বলেন, "সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের সুদ হার কমানোর পর থেকে গ্রাহকের বিনিয়োগের পরিমাণ কমছে। এছাড়া প্রাবাসীদের বন্ডে বিনিয়োগের পরিমাণও কমেছে। এখন আমরা প্রবাসী বন্ডে বিনিয়োগে এনআইডি বাধ্যবাধকতা উঠিয়ে নিয়েছি।"
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট ভিত্তিতে (মাসভিত্তিক) চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯.১০ শতাংশ। আগস্টে এই হার ছিল আরও বেশি, ৯.৫২ শতাংশ। অক্টোবরে ছিল ৮ দশমিক ৯১ শতাংশ। সর্বশেষ নভেম্বরে ছিল ৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ।
অন্যদিকে সেপ্টেম্বরে মজুরি সূচক ছিল ৬.৮৬ শতাংশ। অক্টোবরে মজুরি সুচক ৬.৯১%, এছাড়া নভেম্বরে ছিল ৬.৯৮%।
যদিও অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা মনে করেন, বিবিএস এর দেওয়া মুল্যস্ফিতির তুলনায় মার্কেটের প্রকৃত চিত্র ভিন্ন। কারণ বিবিএস যে তথ্য বলছে, আসলে সেই সকল পণ্যের দাম বাজারে অনেক বেশি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, সঞ্চয়পত্রের ন্যায় ব্যাংকিং খাতেও আমানতের প্রবৃদ্ধি কম। চলতি বছরের অক্টোবরে ব্যাংকগুলোতে আমানতের প্রবৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে ৭.৩৫%। যদিও একই সময়ে ঋণের প্রবৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে ১৪.৬৯%।
এছাড়া মানুষের হাতে নগদ টাকার পরিমাণ অনেক বেড়েছে। চলতি বছরের অক্টোবর শেষে মানুষের হাতে নগদ টাকার পরিমাণ দেখা গেছে ২ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা। যদিও গত বছরের একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল ২ লাখ কোটি টাকার কাছাকাছি।
এছাড়া দেখা গেছে, দেশে করোনা মহামারিকালে কোটিপতির সংখ্যা বাড়লেও চলমান মুল্যস্ফিতির চাপে গত তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) কোটিপতি হিসাবধারী কমেছে প্রায় ২ হাজার জন। একইসঙ্গে তাদের ব্যাংকে থাকা আমানত কমেছে ২৭,৫৬৭ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের 'শিডিউলড ব্যাংকস স্ট্যাটিস্টিকস' প্রকাশনায় এমন তথ্য পাওয়া যায়।
প্রকাশনার সেপ্টেম্বরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ১ কোটি টাকার বেশি অর্থ জমা আছে এমন ব্যাংক হিসাব ১ লাখ ৬৫২০টি। এসব ব্যাংকে জমা আছে ৬,৫২,৭৯৪ কোটি টাকা।