প্রস্তুত চট্টগ্রাম বন্দর, ১০ মিটার গভীরতার জাহাজ ভিড়বে নতুন বছরে
দশ মিটার ড্রাফট ও ২০০ মিটার দৈর্ঘের জাহাজ ভিড়াতে প্রস্তুত চট্টগাম বন্দর। ২০২৩ সালের প্রথমার্ধেই চট্টগ্রাম বন্দরের জেটিতে দশ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ভিড়বে বলে আশা করছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ।
বন্দর কর্তৃপক্ষের দাবি, আগের চেয়ে বেশি ড্রাফটের জাহাজ জেটিতে ভিড়তে পারলে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে ইতিবাচক প্রভাব পড়ার পাশাপাশি পণ্য পরিবহন খাতে সাশ্রয় হবে কোটি কোটি ডলার।
জাহাজ ভিড়ানোর বিষয়ে আমেরিকাভিত্তিক কনসালটেন্সি প্রতিষ্ঠান এইচআর ওয়েলিংফোর্ড ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষকে চুড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দরের জেটিতে বর্তমানে সাড়ে নয় মিটার ড্রাফট (পানির নিচে থাকা জাহাজের অংশ) এবং ১৯০ মিটার লম্বা জাহাজ ভিড়তে পারে। প্রতিটি জাহাজ বহন করতে পারে ২৫০০ থেকে ২৬০০ টিইউউএস কন্টেইনার।
২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে বন্দরে উপরোক্ত ড্রাফট ও লেংথের জাহাজ নোঙর করে। এর আগে বন্দরে আরও ছোট জাহাজ ভিড়ত। অপেক্ষাকৃত ছোট জাহাজ ভিড়লে পণ্য পরিবহন খরচ বেড়ে যায়।
দশ মিটার ড্রাফট ও ২০০ মিটার লম্বা জাহাজ ভিড়লে বন্দরে ৩৮০০ থেকে ৪ হাজার কন্টেইনার পরিবহন করতে পারবে জাহাজ। এর ফলে প্রতিটি জাহাজে আরো ১ হাজার থেকে ১১০০ টিইইউএস বেশি কন্টেইনার পরিবহন করা সম্ভব হবে। এতে বন্দরে কন্টেইনার হ্যান্ডেলিংয়ের পরিমাণ বাড়বে, কমবে কন্টেইনারবাহী পণ্য পরিবহন ব্যয়।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো: ওমর ফারুক বলেন, ১০ মিটার জাহাজ প্রবেশের বিষয়ে বিশ্বের বিভিন্ন শিপিং কোম্পানিদের কাছে খুব শিগগিরিই সার্কুলার করবে বন্দর।
"১০ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ভিড়লে বর্তমানের চেয়ে বেশি কার্গো পরিবহন করা যাবে। এতে বন্দরে টার্ন এরাউন্ড টাইম কমে আসবে। তবে বছরে কী পরিমাণ বেশি কন্টেইনার পরিবহন করা যাবে আগেভাগে নিশ্চিত করে বলে সম্ভব নয়," বলেন তিনি।
বর্তমানে ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দর যেমন সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়ার পোর্ট কেলাং, তানজুম পেলিপাস, শ্রীলঙ্কার কলম্বো এবং চীনের কয়েকটি বন্দরে ৯ দশমিক ৫ মিটার ড্রাফটের জাহাজ চালাচল করে। এই রুটে চলাচল করতে হলে শিপিং কোম্পানিগুলোকে বেশি ড্রাফটের জাহাজ বরাদ্দ দিতে হবে বলে জানিয়েছে বন্দর।
বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার এসোসিয়েশনের সহ সভাপতি খায়রুল আলম সুজন বলেন, "আগের চেয়ে বেশি ড্রাফট এবং বেশি দৈর্ঘ্যের জাহাজ ভিড়তে পারলে একই সময়ে একই জাহাজে কন্টেইার পরিবহন বাড়বে। এতে পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে খরচ কমে আসবে।"
বিশ্বের শিপিং সেক্টরের অনেক জাহাজই বন্দরে আসতে পারে না। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে চট্টগ্রামে শিপিং ব্যবসা এবং আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িতরা দীর্ঘদিন ধরে বন্দরের লেংথ ও ড্রাফট বাড়ানোর বিষয়ে দাবি জানিয়ে আসছিলেন। কিন্তু বন্দর কর্তৃপক্ষ সুনিশ্চিত না হয়ে হুট করে ড্রাফট বাড়ানোর সিদ্ধান্ত দেয়নি।
বিষয়টি নিয়ে বিশেষজ্ঞ একটি সংস্থার মাধ্যমে সমীক্ষা পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই সিদ্ধান্তের আলোকে লন্ডনের এইচআর ওয়েলিং পোর্ট নামের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে কর্ণফুলী নদী এবং বন্দর চ্যানেলে গবেষণার দায়িত্ব দেওয়া হয়।
তারা তিনটি বিষয় নিয়ে গবেষণা চালায়। বর্তমানে চ্যানেলের যে অবস্থা এবং জেটি যেভাবে রয়েছে তাতে বন্দরে ঠিক কত ড্রাফট এবং লেংথের জাহাজ ভেড়ানো যায়, বন্দরের দুই তীরের কী পরিমাণ জায়গা জেটি বা ইয়ার্ড সম্প্রসারণকাজে ব্যবহার করা যায় এবং কোন বিশেষ পদক্ষেপ নিলে বন্দরে সর্বোচ্চ কত ড্রাফট এবং লেংথের জাহাজ ভেড়ানো সম্ভব হবে তার ওপর গবেষণা করে।
এক বছরের বেশি সময় ধরে ওই গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি চট্টগ্রাম বন্দরে সমীক্ষা পরিচালনা করে। গত এপ্রিল মাসে তারা প্রাথমিক রিপোর্ট উপস্থাপন করে। সম্প্রতি তারা চূড়ান্ত রিপোর্ট দিয়েছে।
রিপোর্টে সংস্থাটি বন্দর চ্যানেল, কর্ণফুলী নদী এবং বন্দর সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করে। এতে বলা হয়, বিদ্যমান অবকাঠামো ব্যবহার করে চট্টগ্রাম বন্দরে এখনই ১০ মিটার ড্রাফট এবং ২০০ মিটার লেংথের জাহাজ ভেড়ানো যাবে।
তবে বহির্নোঙর ও গুপ্তখালের সন্নিকটের বাঁকে কিছুটা কাজ করে নদীর দু-একটি পয়েন্টে ড্রেজিং করলে বন্দর চ্যানেলে ১১ মিটার ড্রাফট ও ২২৫ মিটার লেংথের জাহাজও ভেড়ানো যাবে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চিফ হাইড্রোগ্রাফার কমান্ডার আরিফুর রহমান বলেন, 'গবেষণা প্রতিষ্ঠান যে রিপোর্ট প্রদান করেছে তার পরিপ্রেক্ষিতে খুব শিগগিরই জাহাজের ট্রায়াল রান শুরু হবে।"
"এই রানে সফল হলে বিদেশি শিপিং কোম্পানিগুলোকে বড় জাহাজ পাঠানোর জন্য সার্কুলার দেয়া হবে। তখন বড় জাহাজ এলে বার্থিং দেব।"
তিনি আরো বলেন, বন্দরের ১৮টি জেটিতে একই ড্রাফট থাকবে না।
নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) এবং চিটাগাং কন্টেইনার টার্মিনালে (সিসিটি) ১০ মিটার ড্রাফট দেওয়া সম্ভব হবে বলে জানান তিনি। এছাড়া জেনারেল কার্গো বার্থের (জিসিবি) কয়েকটিতে ড্রাফট বাড়ানো যাবে।
"বন্দরের জিসিবির ২ থেকে ৮ নম্বর জেটিতে বর্তমানে সাড়ে ৮ মিটার গভীরতার জাহাজ ভেড়ানো যায়। সেখানে ড্রাফট কিছুটা বাড়ানো গেলেও ১০ মিটার করা যাবে বলে মনে হয় না। তবে ৯-১৩ নম্বর জেটিতে ড্রাফট ১০ মিটার করা সম্ভব হবে," বলেন আরিফুর রহমান।