ডলার সংকটে আয় আটকে থাকায়, ফ্লাইটের সংখ্যা কমাচ্ছে বিদেশি এয়ারলাইনগুলো
বাংলাদেশ হয়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক রুটে সপ্তাহে সাধারণত ১৪টি ফ্লাইট পরিচালনা করতো টার্কিশ এয়ারলাইনস। বাংলাদেশ থেকে তুরস্কগামী ফ্লাইটের টিকিট বিক্রির ২৪ মিলিয়ন ডলার স্থানীয় মুদ্রা- টাকায় দেশের ব্যাংকগুলোতে রেখেছে তারা। টিকেট বিক্রির এ আয় পাঠাতে না পারায় আকাশপথে যাত্রীবাহী সংস্থাটি গত নভেম্বর থেকে সপ্তাহে মাত্র ৭টি ফ্লাইট পরিচালনা করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন প্রতিনিধি জানিয়েছেন, এক্ষেত্রে তাদের কিছু করণীয় নেই।
টার্কিশ এয়ারলাইনসের মতোই সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনস, মালিনদো এয়ার, কুয়েত এয়ারওয়েজ এবং ক্যাথে প্যাসিফিকের মতো বেশিরভাগ বিদেশি এয়ারলাইন তাদের বাংলাদেশগামী ও বাংলাদেশ ছেড়ে যাওয়া ফ্লাইটের সংখ্যা কমিয়েছে একই কারণে। এ তথ্য জানা গেছে- অ্যাসোসিয়েশন অভ ট্রাভেল এজেন্টস অভ বাংলাদেশ (এটিএবি বা আটাব) এর সূত্রে।
এদিকে, ইন্টারন্যাশনাল এয়ার ট্রান্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশন (আইএটিএ)-র ৭ ডিসেম্বর প্রকাশিত সংবাদ বিবৃতি অনুসারে, প্রত্যাবাসনের জন্য ২০৮ মিলিয়ন ডলারের এয়ারলাইন তহবিল আটকে রাখায় বাংলাদেশ - নাইজেরিয়া এবং পাকিস্তানের পরে - বিশ্বে তৃতীয় স্থানে রয়েছে। জানা যাচ্ছে, বৈশ্বিক ডলার সংকটের মধ্যে ক্ষয়প্রাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভকে চাঙ্গা রাখার জন্য এ তহবিল ব্যবহার করা হয়েছে।
আইএটিএ আন্তর্জাতিক চুক্তি এবং চুক্তির বাধ্যবাধকতার সাথে সামঞ্জস্য রেখে– টিকিট বিক্রয় এবং অন্যান্য কার্যক্রম থেকে এয়ারলাইনগুলির অর্জিত রাজস্ব প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে সমস্ত বাধা অপসারণ করতে সরকারগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
প্রসঙ্গত, গত বছরের মার্চ থেকেই দেশে ফ্লাইটসেবা প্রদানকারী বিদেশি এয়ারলাইনগুলোর তহবিল প্রত্যাবাসন বন্ধ রয়েছে।
তার ওপর আবার, বাংলাদেশের বিভিন্ন ব্যাংকে তাদের তহবিল গচ্ছিত থাকার পরেও, বিদেশ থেকে ডলার রেমিট্যান্স এনে জ্বালানি ব্যয় নির্বাহ করতে হচ্ছে তাদের।
টার্কিশ এয়ারলাইনসের হেড অভ সেলস অ্যান্ড মার্কেটিং সাত্তার সিদ্দিক বলেন, 'বিপুল পরিমাণ অর্থ আটকে থাকায়, ইতোমধ্যেই আমরা সক্ষমতা হ্রাস করেছি। নভেম্বর থেকেই এটা শুরু করা হয়'।
'আমাদের সদর দপ্তর তুরস্কে, তাই এখানকার সব ব্যয় নির্বাহের পর বাদবাকী আয় সেখানে প্রত্যাবাসন করতে হয়। গত মার্চ থেকে আমাদের প্রায় ২৪ মিলিয়ন ডলার আটকে আছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, তাদের কাছে এ মুহূর্তে ডলার নেই। তাই তারা রেমিট করতে পারছেন না'- যোগ করেন তিনি।
অর্থ পাঠাতে গেলে ক্ষতির বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, 'আমরা বাংলাদেশে টিকিট বিক্রি করি একটা রেটে, যা আইএটিএ'র মাধ্যমে বাংলাদেশ বিমান থেকে ঠিক করে দেয়। কাগজপত্র রেডি করে আয় প্রত্যাবাসনে আমাদের দীর্ঘদিন সময় লাগে। ডলারের দাম যখন ৮৫ টাকা ছিল, তখন আমরা সেই রেটেই টিকেট বিক্রি করেছি। কিন্তু, শেষপর্যন্ত আয় প্রত্যাবাসনের সময় ১০৬ টাকায় প্রতিডলার কিনতে হচ্ছে। এটা আমাদের লোকসানের মধ্যে ফেলেছে'।
এখন জ্বালানির দামও ডলারে পরিশোধ করতে হচ্ছে, এটা বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলোর জন্য আরেকটা সমস্যা' একথা উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, 'আগে আমরা ফুয়েল বিল টাকাতেই দিতাম, কিন্তু বেশ কয়েক বছর আগে আমাদেরকে এটা ডলারে পরিশোধ করতে বলা হয়'।
কুয়েত এয়ারলাইনসের ট্রাফিক অফিসার কাজী দিলরোজ টিবিএসকে বলেন, আগে আমরা সপ্তাহে ১২টি ফ্লাইট পরিচালনা করতাম। গত এক মাস ধরে এই সংখ্যা ১০- এ নেমেছে'।
তবে ফ্লাইটের সংখ্যা কমার কারণ নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাননি তিনি।
এ দুটি এয়ারলাইন ছাড়াও, সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনস ঢাকা থেকে তাদের প্রতি সপ্তাহের ১০টি ফ্লাইট কমিয়ে সাতটি করেছে। মালিনদো এয়ার ও ক্যাথে প্যাসিফিক উভয়েই পাঁচটি থেকে কমিয়ে একটি করে ফ্লাইট পরিচালনা করছে।
এই প্রেক্ষাপটে সংকট সমাধানে হস্তক্ষেপ চেয়ে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ে গত সপ্তাহে একটি চিঠি দিয়েছে আটাব।
অন্যান্য এয়ারলাইনগুলোর কর্মকর্তারাও দীর্ঘসময় ধরে এসব সমস্যার মধ্যে থাকার কথা জানিয়েছেন।
এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলম বলেন, 'চিকিৎসা, ওমরাহ পালন, ব্যবসা, শ্রমিক অভিবাসন, প্যাকেজ ট্যুর ইত্যাদির কারণে বাংলাদেশ থেকে বিদেশ ভ্রমণের সংখ্যা দিনকে দিন বাড়ছে। কিন্তু, চলমান সংকটের কারণে বিদেশি এয়ারলাইনগুলো বাংলাদেশ থেকে তাদের ফ্লাইটের সংখ্যা কমাচ্ছে'।
তার মতে, 'এয়ারলাইনগুলো তো ব্যবসা করতে আসছে। কিন্তু টাকা না পেলে তারা ফ্লাইট কমিয়ে দিবে এটাই স্বাভাবিক'।
এদিকে চিঠিতে আটাব মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে, 'এয়ারলাইনগুলো যখন টিকেট বিক্রি করে, প্রতি ডলারের বিপরীতে তখন টাকার মান থাকে ৮৫ থেকে ৯৯ টাকা, কিন্তু আয় প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে টাকার মান হয়ে যায় ১১৫ থেকে ১২০ টাকা। ফলে রেমিট্যান্স পাঠানোর ক্ষেত্রে এয়ারলাইনগুলো ১৫ -২০% ক্ষতির সম্মুখীন হয়'।
একারণে বিদেশি এয়ারলাইনগুলো বাংলাদেশে ব্যবসা করার বিষয়ে অনাগ্রহী হচ্ছে। বাংলাদেশের পরিবর্তে যে গন্তব্যে তাদের মুনাফা বেশি হয়, সেখানে তারা ফ্লাইট চালাচ্ছে- আরও জানায় সংস্থাটি।
অ্যাসোসিয়েশন অভ ট্রাভেল এজেন্টস অভ বাংলাদেশ (আটাব) আভাস দিয়েছে যে, আগামী ছয় থেকে এক বছরের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে বিদেশি এয়ারলাইনগুলোর ফ্লাইট সংখ্যা ৬০ শতাংশ পর্যন্ত কমতে পারে।
বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের মতে, ঢাকা বিমানবন্দর (হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর) থেকে প্রতিদিন প্রায় ৮০-৯০ আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পরিচালিত হয়।
ঢাকা বিমানবন্দরের ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক উইং কমান্ডার শাহেদ আহমেদ খান অবশ্য বলেছেন, 'ডলার সংকটের কারণে ফ্লাইট ফ্রিকোয়েন্সি কমেছে বলে আমাদের জানা নেই। বরং শীতকালে কুয়াশাচ্ছন্ন আবহাওয়ার কারণে কিছু ফ্লাইট অন্যান্য এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করছে'।
তবে এয়ারলাইনগুলো বলছে, শীতকালে তারা ফ্লাইট উড্ডয়ন -অবতরণের সময় পরিবর্তন করলেও, কখনো একারণে ফ্লাইটের সংখ্যা কমায় না।
এয়ার কোম্পানিগুলোর অর্থ ব্যাংকে আটকে থাকার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউর রহমান বলেন, 'এয়ালাইনগুলো যেসব ব্যাংকের সাথে লেনদেন করে এটা তাদের বিষয়। আমাদের পক্ষ থেকে কোনো বাধা নেই'।
ডলার সংকটের কারণে আয় প্রত্যাবাসন করা যাচ্ছে না এমন অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, 'এখন একটা এয়ারলাইন যদি সেরকম ব্যাংকের সাথে লেনদেন করে- যারা তাদের অর্থ পাঠাতে পারছে না, সেক্ষেত্রে তো আমাদের কিছু করার নেই'।
টিকেটের মূল্যবৃদ্ধিতে যাত্রীদের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে
আটাবের সূত্রমতে, টিকেটের বিক্রয়লব্ধ অর্থ অনির্দিষ্টকাল বাংলাদেশে আটকে থাকার কারণে বিদেশি এয়ারলাইসগুলো এই অর্থের 'কস্ট অভ ফান্ড' সমন্বয়ের জন্য টিকেটের মূল্য বৃদ্ধি করছে।
এতে সকল ধরনের যাত্রীর টিকেট মূল্য অত্যাধিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং আগামী কয়েক মাসের মধ্যে এটা প্রায় ২-৩ গুণ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
আটাবের জেনারেল সেক্রেটারি আব্দুস সালালম আরেফ বলেন, "যে টিকিট আগে ৫০ হাজার টাকা ছিল, এখন তা বিদেশগামীরা এক লাখ টাকায় কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। এই বাড়তি খরচের কারণে বিদেশে কর্মরত জনশক্তি রেমিট্যান্স পাঠানোও কমিয়েছে'।
টিকিটের দাম বাড়ার ফলে পর্যটন শিল্প, বিদেশ যাত্রী, পরিবহন খরচ এবং ট্রাভেল এজেন্সির ব্যবসার ওপরও বিরূপ প্রভাব পড়ছে বলে জানান তিনি।
তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, ইতোমধ্যেই ট্রাভেল এজেন্সিগুলোর টিকিট বিক্রি ৫০ শতাংশে নেমে আসায় তারা বন্ধ হওয়ার পথে। ফলে এ শিল্পে কর্মরত প্রায় দুই লাখ মানুষ বেকার হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।
হুন্ডিকে যেভাবে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে
আটাবের পক্ষ থেকে মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে, বাংলাদেশে কোনো ট্রাভেল এজেন্সি যে টিকিট এক লাখ টাকায় ক্রয় করে, সেই টিকিট বিদেশ থেকে ওই দেশের আইডি ব্যবহার করে কিনলে ৭০-৮০ হাজার টাকায় পাওয়া যায়। ফলে অনেক যাত্রী বিদেশি আইডি ব্যবহার করে এয়ার টিকিট কেনেন। এই অর্থ বিদেশে হুন্ডির মাধ্যমে পাচার হয়ে যাচ্ছে।
বিদেশে টিকিটের দাম কম হওয়ার কারণে, বিদেশে বসবাসরত বাংলাদেশীদের আত্মীয়স্বজন তাদের মাধ্যমে বিদেশে অনলাইনে টিকিট ক্রয় করছেন। এতে সরকার টিকিটের রাজস্ব প্রাপ্তি থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে।