আগামী দুই বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি মূল্যস্ফীতি, ঋণ সংকট: ডব্লিউইএফ
ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি, ঋণ সংকট, নিত্যপণ্যের চড়া দাম, মানবসৃষ্ট পরিবেশগত ক্ষতি এবং সম্পদের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্বকে– আগামী দুই বছরে বাংলাদেশের জন্য শীর্ষ পাঁচটি ঝুঁকি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) সাম্প্রতিকতম 'গ্লোবাল রিস্কস রিপোর্ট' শীর্ষক প্রতিবেদনে।
এতে বাংলাদেশের শীর্ষ ব্যবসায়িক নির্বাহীরা মূল্যস্ফীতিকে দেশের জন্য সবচেয়ে বড় উদ্বেগের কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তারা দ্রুত বা অব্যাহত মূল্যস্ফীতিকে– রিস্ক-১ হিসেবে চিহ্নিত করেন। আরো ৩৩টি দেশের ব্যবসায়ীরাও তাদের অর্থনীতির জন্য মূল্যস্ফীতিকে এক নম্বর ঝুঁকি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
২০২২ সালে পরিচালিত ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের এক্সিকিউটিভ ওপিনিয়ন সার্ভেতে গোটা বিশ্বের প্রায় ১২ হাজার নির্বাহী অংশ নেন। এটি মূলত ধারণাভিত্তিক জরিপ। অংশগ্রহণকারীদের জিজ্ঞেস করা হয়, 'আগামী দুই বছরে আপনার দেশের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কোনগুলো?'
এজন্য তাদের ৩৫টি ঝুঁকির তালিকা দেওয়া হয়। এখান থেকে তারা নিজ নিজ দেশ ও বিশ্ব অর্থনীতির শীর্ষ পাঁচটি ঝুঁকিকে চিহ্নিত করেছেন।
এক্সিকিউটিভ ওপিনিয়ন সার্ভে (ইওএস) শীর্ষক এই জরিপে, আগামী দুই বছরে ৮৯টি দেশের শীর্ষ পাঁচটি ঝুঁকির মধ্যেও মূল্যস্ফীতি রয়েছে। ২০২১ সালের চেয়ে এই ঝুঁকি-কবলিত দেশের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।
অর্থাৎ, 'রিস্ক-১' হলো- প্রতিটি অর্থনীতির ক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময় চিহ্নিত প্রধানতম ঝুঁকি।
ডব্লিউইএফ- এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাদিয়া জাহিদি বলেন, 'পণ্যদ্রব্যের চড়া দামের কারণে আমরা যে মূল্যস্ফীতির ঘটনা লক্ষ করেছি এবং উন্নত অর্থনীতিগুলো এই পরিস্থিতিতে ব্যবসাবাণিজ্যকে টিকে থাকতে যেসব সহায়তা দিয়েছে, সেগুলো নিখুঁত ছিল না। উন্নত অর্থনীতিগুলোর চিত্র অন্ধকার, আশঙ্কা করা হচ্ছে মন্দার। তবে অনেক ছোটখাট ব্যবসা ও জনগণ স্বচ্ছল রয়েছে'।
২০২২-২৩ সালের গ্লোবাল রিস্কস পারসেপশন সার্ভে (জিপিআরএস)- নামক সমীক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের অধিকাংশ 'জ্বালানি সরবরাহ সংকট'; 'জীবনযাত্রার ব্যয় নির্বাহের সংকট'; 'ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি'; 'খাদ্য সরবরাহে সংকট' এবং 'গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোয় সাইবার হামলা'কে ২০২৩ সালের শীর্ষ ঝুঁকি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, যেগুলোর সম্ভাব্য বৈশ্বিক প্রভাব হবে সবচেয়ে বেশি।
বৈশ্বিক বিবেচনায় জীবনযাত্রার ব্যয় নির্বাহের সংকট-ই হলো স্বল্পমেয়াদে সবচেয়ে বড় ঝুঁকি। অন্যদিকে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব প্রশমন ও অভিযোজনকে সবচেয়ে বড় দীর্ঘমেয়াদি উদ্বেগ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
চলতি বছরের জিপিআরএস সমীক্ষায়, প্রতি পাঁচজনের মধ্যে চারজন অংশগ্রহণকারী সমগ্র বিশ্বের অর্থনীতি ও শিল্প খাতগুলো জুড়ে অস্থিতিশীলতার আশঙ্কা প্রকাশ করেন। আগামী দুই বছরে অর্থনীতি ও শিল্প খাতে একাধিক ধাক্কা আসবে বলে তারা মনে করছেন, যা নেতিবাচক চাপ সৃষ্টি করবে।
এরমধ্যে অন্যতম হবে– জ্বালানি ও খাদ্য সরবরাহে ঘাটতি, যা আগামী দুই বছর জুড়ে অব্যাহত থাকবে। একইসঙ্গে জীবনযাত্রার ব্যয় এবং দেনা পরিশোধের ব্যয় জোরালোভাবে বাড়বে। এসব সংকট একইসঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকি যেমন- জলবায়ু পরিবর্তন রোধ, বাস্তুতন্ত্র সুরক্ষা ও মানব সম্পদ উন্নয়নে বিনিয়োগের সাথে সম্পর্কিত দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকিগুলো প্রশমনের প্রচেষ্টাকে ব্যাহত করতে থাকবে।
এসব তথ্য তুলে ধরে আজ বৃহস্পতিবার প্রকাশিত ২০২৩ সালের গ্লোবাল রিস্কস রিপোর্টে বলা হয়েছে, সবচেয়ে গুরুতর দীর্ঘমেয়াদি হুমকিগুলো মোকাবিলায় কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। তাই চূড়ান্ত বিপর্যয় সৃষ্টির আগেই এগুলো নিরসনে ঐক্যবদ্ধ ও পরিকল্পিত উদ্যোগ নেওয়া দরকার।
দক্ষিণ এশিয়ার জন্য শীর্ষ ঝুঁকিগুলো
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো ভবিষ্যতে বিভিন্ন ধরনের ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে, তবে সবার ক্ষেত্রে ঝুঁকিগুলো আলাদা আলাদা।
ভারতের জন্য সবচেয়ে বড় ঝুঁকি বলে চিহ্নিত করা হয়েছে দেশটির ডিজিটাল বৈষম্যকে। সম্পদের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, নেপালের জন্য সবচেয়ে বড় ঝুঁকি। পাকিস্তানের ক্ষেত্রে তা ডিজিটাল শক্তির কেন্দ্রীকরণ, শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রে দেনা ব্যবস্থাপনার সংকট। আর বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি দ্রুতগতির মূল্যস্ফীতি।
অর্থনৈতিক দুর্দশার প্রভাবে মানব নিরাপত্তা ও জনস্বাস্থ্য নিরাপত্তা কীভাবে ব্যাহত হতে পারে শ্রীলঙ্কার বর্তমান সংকট তার একটি বাস্তব উদাহরণ। দেশটির বৈদেশিক দেনা পরিশোধের ব্যর্থতা ও বৈদেশিক মুদ্রা সংকট আমদানি সক্ষমতাকে তলানিতে নিয়ে গেছে। ফলে খাদ্য, জ্বালানি, স্বাস্থ্যসেবা ও বিদ্যুতের মতো নিত্যপণ্য ও সেবা বঞ্চিত হয় জনগণ। এনিয়ে ব্যাপক বিক্ষোভের মুখে পদত্যাগ করতে হয় দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্টকে।
সাদিয়া জাহিদি বলেন, 'স্বল্পমেয়াদি ঝুঁকির দৃশ্যপটে– জ্বালানি, খাদ্য, ঋণ বা দেনা ব্যবস্থাপনা ও বিভিন্ন ধরনের দুর্যোগের প্রভাব বেশি। ধনী ও দরিদ্র দেশ নির্বিশেষে যারা সবচেয়ে বঞ্চিত ও ঝুঁকিগ্রস্ত জনগোষ্ঠী– তারাই বহু ধরনের সংকটে পড়ার ঝুঁকিতে রয়েছে, এবং তাদের সংখ্যাও প্রতিনিয়ত বাড়ছে'।
তিনি বলেন, 'ক্রমবর্ধমান এসব বৈশ্বিক ঝুঁকির মিলিত প্রভাব মারাত্মক। (ইউক্রেন-রাশিয়া) যুদ্ধ থেকে শুরু করে নতুন ভাইরাসের মহামারি– পুরো বিশ্বকেই এগুলো নাড়া দিচ্ছে। একইসঙ্গে এত ধরনের বিপদ মোকাবিলা করাও অসম্ভব হয়ে উঠতে পারে'।
'এজন্য ভবিষ্যৎ বিপদগুলো মোকাবিলায় জলবায়ু পরিবর্তন ও মানব উন্নয়ন সম্পর্কিত প্রচেষ্টাগুলোতে বিশ্বনেতাদের মনোযোগ দেওয়া উচিত' -যোগ করেন তিনি।
গত বছরের গ্লোবাল রিস্কস রিপোর্টে করোনা মহামারি থেকে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের অসম বা বিক্ষিপ্ত ধারা বৈষম্যের ঝুঁকিকে গভীরতর করবে বলে সতর্ক করা হয়েছিল।