বাণিজ্য-ভিত্তিক অর্থ পাচারের কথা স্বীকার করেছেন গভর্নর
বিভিন্ন বিজনেস ওভার এবং আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে অর্থ পাচার করত বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার।
বিদেশে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের সম্পত্তি ক্রয়-সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে তালুকদার এ মন্তব্য করেন।
"ওভার এবং আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে অর্থ পাচার হয়েছিল। তবে আমি জানি না এই অর্থ বিদেশে বাড়ি কেনার জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল কিনা," গভর্নর বলেন।
রোববার বিকেলে বাংলাদেশ ব্যাংকের জাহাঙ্গীর আলম কনফারেন্স হলে চলতি বছরের (জানুয়ারি-জুন) সময়ের নতুন এ মুদ্রানীতি 'মনেটারি পলিসি স্টেটমেন্ট (এমপিএস)' প্রকাশ করেন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। এ সময় সাংবাদিকরা এসব বিষয়ে জানতে চান।
তিনি বলেন, "টাকা পাচারের বিষয়টি দেখা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাজ না তারপরেও যেহেতু আমদানির ক্ষেত্রে আমরা ডলার সাপ্লাই দেই সেই পার্সপেক্টিভ থেকে পাচারের বিষয়টি মনিটরিং শুরু করেছি।"
"আমরা গত জুলাই থেকে ট্রেড বেইসড মানি লন্ডরিং হচ্ছে কিনা সেটা অনুসন্ধান শুরু করি। আমরা দেখতে পেলাম, বেশকিছু প্রোডাক্টে ওভার ইনভয়েসিং হচ্ছে আবার বেশ কিছু প্রোডাক্টের আন্ডার ইনভয়েসিং হচ্ছে।"
"কিছু কিছু প্রোডাক্টের ক্ষেত্রে দামের চেয়ে তিনগুণ কম দেখিয়ে ইম্পোর্ট করা হয়েছে, যেসব পণ্যের ট্যাক্স কস্ট বেশি, সেসবের ক্ষেত্রে এটি করা হয়েছে।"
তিনি বলেন, "যে এলসি মুল্য কম দেখানো হয়েছে, সেই টাকাটা তো বিদেশে পরিশোধ করতে হয়েছে। হুন্ডির মাধ্যমে টাকাটা বিদেশ থেকে সংগ্রহ করতে হয়েছে। যার কারণে আমাদের রেমিট্যান্স কম আসছে।"
"এছাড়া যে ধরনের প্রোডাক্টের ট্যাক্স কম সেগুলোর মাধ্যমে ওভার ইনভয়েসিং হয়ে যাচ্ছে। কারণ এসব পণ্যের ক্ষেত্রে মনিটরিং খুবই কম ছিল।"
গভর্নর বলেন, এখন যেকোনো পণ্য আমদানির সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংক পর্যবেক্ষণ করছে। একইসঙ্গে প্রত্যেকটা কমার্সিয়াল ব্যাংকের এডি শাখাও পর্যবেক্ষণ চালাচ্ছে।
সম্প্রতি বিভিন্ন গণমাধ্যমে উঠে এসেছে, সংযুক্ত আরব আমিরাতে বাড়ি কেনায় বিপুল বিনিয়োগ করেছেন বাংলাদেশিরা। দুবাইয়ের সরকারি নথিপত্র ও গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২০ সালের জানুয়ারি মাস থেকে ২০২১ সালে জুন মাস পর্যন্ত বাংলাদেশিরা দুবাইয়ে ১২ কোটি ২৩ লাখ দিরহাম বা ৩৪৬ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে বাড়ি/ ফ্ল্যাট কিনেছেন।
এছাড়া বেশ কিছু আন্তর্জাতিক গণমাধ্য়মে বলা হয়েছে, ২০২০ সালের জানুয়ারি মাস থেকে ২০২১ সালে জুন মাস পর্যন্ত যেসব দেশের মানুষ জমি-বাড়ি কিনছেন, তাদের মধ্যে বাংলাদেশিরা সবার আগে। দেশের বেশ কয়েকটি সংবাদপত্রেও এ সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।
ইসলামী ব্যাংকি নিয়ে যা বললেন
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর বলেন, দেশে গত জুলাইতে হঠাৎ একটি চক্র গুজব তুলেছে ব্যাংকগুলোতে ডলার নেই, যার কারণে অনেক গ্রাহক ব্যাংক থেকে টাকা তোলা শুরু করে। এতে কিছু ব্যাংকের তারল্য কমে এসেছে।
তিনি বলেন, "নভেম্বরে একাধিক পত্রিকায় নিউজ এসেছে ইসলামী ব্যাংকের ঋণ অনিয়ম নিয়ে। যার ফলে গ্রাহকরা ইসলামী ব্যাংক থেকেও ব্যাপক টাকা তোলা শুরু করেছে। আমরা বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছি। আগামী চার-পাঁচ মাসের মধ্যে ইসলামী ব্যাংকের তারল্য সমস্যা ঠিক হয়ে যাবে।"
"আমাদের উপরে কোন গোষ্ঠীর চাপ নেই, কোন গ্রুপের কত ঋণ সেটা আমাদের দেখার বিষয় না। বিধি অনুযায়ী আসলে ঋণ পাবে নাহলে পাবে না।"
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২১ এর নভেম্বর শেষে দেশের ব্যাংকগুলোর কাছে অতিরিক্ত আমানতের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ১৭ হাজার কোটি টাকা। ২০২২ এর নভেম্বর শেষে অতিরিক্ত আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৫৩ হাজার কোটি টাকা।
এক বছরের ব্যবধানে ব্যাংকগুলোতে অতিরিক্ত তারল্যের পরিমাণ কমেছে ৬৫ হাজার কোটি টাকা।
গভর্নর আরো বলেন, "ইসলামী ব্যাংক অনেক বড় ব্যাংক। এখানে গ্রাহকের ১ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা গ্রাহকের আমানত রয়েছে। একইসঙ্গে ১ কোটি ৯০ লাখ গ্রাহক রয়েছে সেই বিবেচনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইসলামী ব্যাংককে তারল্য সাপোর্ট দিয়েছে। আর এটা একদিন পর তারা পরিশোধ করে দিয়েছে। এমনটা বিশ্বের বিভিন্ন ব্যাংক করে থাকে।"
ইসলামী ব্যাংকের 'অনিয়ম জেনেও চুপ ছিলেন কেন্দ্রীয় ব্যাংক' এক সাংবাদিকের এমন প্রশ্নে গভর্নর বলেন, ইসলামী ব্যাংকগুলোর ইস্যুতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক চুপ ছিল না।
"আমরা ইসলামী ব্যাংকের ঋণ অনিয়মের বিষয়ে জানতে 'অডিট কমিটি' করেছি। তারা পরিদর্শন করে অডিট রিপোর্ট জমা দিয়েছেন। আমরা সে বিষয়ে কার্যকরী পদক্ষেপ নিবো। ইতোমধ্যে আমরা দুটি ইসলামিক ব্যাংকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শক নিয়োগ দিয়েছি।"
তিনি বলেন, "আমাদের কোন অ্যাকশন নিতে চাইলে প্রসেস ফলো করতে হয়, আমরা বিভিন্ন অ্যাকশন নিয়েছি। একটি পত্রিকায় রিপোর্ট হলেই যে পরেরদিন কাউকে ধরে নিয়ে আসবো এভাবে বাংলাদেশ ব্যাংক কাজ করে না।"