জাপানি অর্থায়নে পরিচালিত ৫০ শতাংশের বেশি প্রকল্পের কাজ পিছিয়ে আছে
ভূমি অধিগ্রহণে বিলম্ব, সরঞ্জাম সংগ্রহ এবং পরামর্শদাতা নির্বাচনসহ নানা সমস্যার কারণে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা)-এর অর্থায়নকৃত ২৯টি প্রকল্পের মধ্যে ১৫টির বাস্তবায়ন সেগুলোর লক্ষ্যমাত্রা থেকে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। জাইকার এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে এ তথ্য।
রোববার (২২ জানুয়ারি) অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) ও জাইকার কর্মকর্তা এবং প্রকল্প পরিচালকদের উপস্থিতিতে একটি উচ্চ-পর্যায়ের পোর্টফোলিও পর্যালোচনা সভায় অগ্রগতি প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করে জাইকার বাংলাদেশ অফিস।
উন্নয়ন প্রকল্পের অনুমোদনে বিলম্ব এবং বাংলাদেশ ব্যাংকে হিসাব খুলতে দেরি হওয়ার কারণে নয় মাসেও কোনো উন্নতি হয়নি আরবান ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড সিটি গভর্নেন্স প্রজেক্টের। এ প্রকল্পের জন্য জাইকা ২০২২ অর্থবছর (২০২২ এপ্রিল- ২০২৩ মার্চ) মেয়াদে ১০২ কোটি ইয়েন (৮২ কোটি টাকার বেশি) বরাদ্দ করেছে।
একইভাবে, হেলথ সার্ভিসেস স্টেনথেনিং প্রজেক্ট এবং ফুড ভ্যালু চেইন ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্টে কোনো অগ্রগতি হয়নি।
বৈঠকে ইআরডি সচিব শরিফা খান এবং বাংলাদেশে জাইকার প্রধান প্রতিনিধি ইচিগুচি তোমোহাইড নিজ নিজ পক্ষের নেতৃত্ব দেন।
প্রকল্পের অগ্রগতি কম হওয়ার পেছনে কিছু কারণ চিহ্নিত করেছে জাইকা। প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে ভূমি অধিগ্রহণে বিলম্ব, অনুমোদন প্রক্রিয়া, বিডিং এবং রিবিডিং নথি প্রস্তুত করা। ক্রয়ে ধীরগতি এবং কিছু সিভিল কাজের জন্যেও অনেক প্রকল্পের কাজ পিছিয়ে গেছে বলে উল্লেখ করে তারা।
জাইকা বৈঠকে নির্মাণ সামগ্রীর দাম বৃদ্ধির বিষয়টিও তুলে ধরে।
তারা বলেছে, কোভিড-পরবর্তী সময়ে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পণ্যের দাম অনেক বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে।
"কন্ট্রাক্টররা উদ্বেগ প্রকাশ করে জানিয়েছে, ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত সূচক অর্থাৎ বিবিএস পরিসংখ্যান প্রকৃত বাজারমূল্যকে প্রতিফলিত করে না। তাছাড়া করোনার পর সংশ্লিষ্ট অনেক সূচকই এক্ষেত্রে হিসাবের বাইরে থেকে যায়, বলে জাইকা।
এর আগে তাদের অর্থায়নকৃত উন্নয়ন প্রকল্পের চুক্তির মূল্য বাড়ানোর কথা উল্লেখ করে গত বছরের মার্চে ইআরডিকে চিঠি দেয় জাইকা।
১৫টি প্রকল্পের অগ্রগতি ৫০ শতাংশের নিচে
জাইকা তার প্রতিবেদনে ১৫টি প্রকল্প চিহ্নিত করেছে, যার অগ্রগতি ৫০ শতাংশের কম।
এরমধ্যে ফুড ভ্যালু চেইন ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্টের অগ্রগতি শূন্য।
এ প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, জাইকার অর্থায়নে বাংলাদেশ ইনফ্রাস্ট্রাকচার ফাইন্যান্স ফান্ড লিমিটেডের (বিআইএফএফএল) প্রকল্প থেকে ব্যবসায়ীদের ঋণ দেওয়া হয়।
প্রকল্পের উদ্দেশ্য হলো কৃষি ও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের জন্য ঋণের অ্যাক্সেস উন্নত করা এবং প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যের গুণগত মান উন্নত করা। সেইসাথে বাংলাদেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও কৃষি ব্যবসা শিল্পের সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে অর্থায়ন ও সহায়তার মাধ্যমে ব্যবসায়িক কার্যক্রমের দক্ষতা বৃদ্ধি করা।
এ প্রকল্পের পরামর্শদাতা নিয়োগে বিলম্বের কারণে জাইকার তহবিল বিতরণ আটকে রয়েছে।
গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো প্রকল্পসহ ৫টি প্রকল্পে বিতরণ হার লক্ষ্যমাত্রার ৩-১০% এর মধ্যে।
ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাকা আন্ডারগ্রাউন্ড সাবস্টেশন নির্মাণ প্রকল্পের জন্য মাত্র ৩% তহবিল ছাড়া হয়েছিল।
এ প্রকল্পের উদ্দেশ্য হলো ঢাকায় দুটি ভূগর্ভস্থ সাবস্টেশন নির্মাণের মাধ্যমে বৈদ্যুতিক সরবরাহ নির্ভরযোগ্যতা, বৈদ্যুতিক শক্তির সরবরাহ এবং চাহিদার ভারসাম্য উন্নত করা। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের বিনিয়োগ পরিবেশের উন্নতি এবং দেশব্যাপী অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখা সম্ভব হবে।
প্রকল্পটির জন্য যখন দরপত্র আহ্বান করা হয়েছিল তখন আনুমানিক মূল্যে কোন দরদাতা সাড়া দেয়নি। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো আনুমানিক মূল্যের চেয়ে বেশি দর দাবি করায় প্রকল্পের তহবিল বিতরণও আটকে আছে।
জাইকার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, টেন্ডার প্রক্রিয়া বিলম্বের কারণে ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টের (লাইন-১) অর্থায়ন আটকে আছে। এই প্রকল্পে মাত্র ১০.৯% বিতরণ করা হয়েছে।
বাস্তবায়নকারী সংস্থা ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) সম্প্রতি সাংবাদিকদের জানিয়েছে, প্রকল্পটির নির্মাণকাজ ২৬ জানুয়ারি শুরু হবে; এরপরেই জাইকার বিতরণ ত্বরান্বিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বিমানবন্দর, বিমানবন্দর টার্মিনাল, খিলক্ষেত, নদ্দা, নতুন বাজার, উত্তর বাড্ডা, বাড্ডা, আফতাবনগর, রামপুরা, মালিবাগ, রাজারবাগ এবং কমলাপুরে ভূগর্ভস্থ স্টেশন স্থাপনের মাধ্যমে ২০১৬ সালের মধ্যে এমআরটি-১ সম্পন্ন করার পরিকল্পনা করা হয়েছে।
মাতারবাড়ী বন্দর উন্নয়ন প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণ এবং জাহাজ সংগ্রহের পুনঃদরপত্রের জটিলতার কারণে মাত্র ৫.৫% তহবিল বিতরণ করা হয়েছে।
স্বাস্থ্যখাতের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প হলো ম্যাটারনাল নিওন্যাটাল অ্যান্ড চাইল্ড হেলথ (এমএনসিএইচ) এবং হেলথ সিস্টেম ইম্প্রুভমেন্ট প্রজেক্ট। কিন্তু চিকিৎসা সরঞ্জাম ক্রয়ে ধীরগতি, হাসপাতাল নির্মাণ সাইটে জমি-সংক্রান্ত সমস্যা এবং বিতরণের অনুরোধ জমা দিতে বিলম্বের কারণে মাত্র ১৯.৫% তহবিল বিতরণ করা হয়েছে।
সিভিল কাজ বাস্তবায়নে বিলম্ব এবং ঋণ পুনঃবরাদ্দের কারণে হাওর ফ্লাড ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড লাইভলিহুড ইম্প্রুভমেন্ট প্রজেক্টের তহবিল বিতরণ ছিল মাত্র ১৭%।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ১২টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এই প্রকল্পগুলোতে ৭৫% এর বেশি তহবিল ব্যয় করা হয়েছে। যদিও এই দুটি প্রকল্পে ৫০% এর কম অগ্রগতি হয়েছে, তবুও তারা লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
সংশোধিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবে বিলম্ব
দুটি প্রকল্পের সংশোধিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (আরডিপিপি) এবং একটি নতুন প্রকল্প প্রস্তাবের অনুমোদন প্রক্রিয়া আটকে আছে।
সাউথ চট্টগ্রাম রিজিওনাল ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট ডিপিপি'র অনুমোদনে দেরি হওয়ায় প্রকল্পের কাজ শুরু হতে ছয় মাস বিলম্ব হয়েছে।
জাইকা এ প্রকল্পটির জন্য প্রায় ২,৫০০ কোটি টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, যা জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।
ন্যাচারাল গ্যাস এফিশিয়েন্সি প্রজেক্টে ৬৫০ কোটি টাকার বেশি দিবে জাইকা। এই প্রজেক্ট অতিরিক্ত ৮০,০০০ প্রিপেইড গ্যাস মিটার সংগ্রহ এবং ইনস্টল করবে। সংশোধিত ডিপিপির অনুমোদন আটকে থাকায় বিলম্বিত হয়েছে প্রকল্পটি।
ম্যাটারনাল নিওন্যাটাল অ্যান্ড চাইল্ড হেলথ (এমএনসিএইচ) এবং হেলথ সিস্টেম ইম্প্রুভমেন্ট প্রজেক্টের জন্য সংশোধিত ডিপিপিতে দুই বছরের মেয়াদ বাড়ানোর কথা বলা হয়েছিল। গত তিন মাসেরও বেশি সময় ধরে ডিজিএইচএস-এ অনুমোদনটি আটকে আছে।
জাইকা বলেছে, অনুমোদন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে পরিকল্পনা কমিশনের সাথে সক্রিয়ভাবে যোগাযোগ করতে হবে। সেইসাথে ইআরডির উচিত পরিকল্পনা কমিশন ও জাইকার সাথে একটি মাসিক ত্রি-পক্ষীয় পর্যবেক্ষণ করা।
জাইকার অর্থায়নে আরো দুটি আসন্ন প্রকল্প হলো চট্টগ্রাম-কক্সবাজার হাইওয়ে ইমপ্রুভমেন্ট এবং ডুয়েল গেজ ডাবল লাইন (জয়দেবপুর ও ইশুরদী সেকশন) প্রকল্প।
জাইকা বলছে, ডিপিপি অনুমোদনের অগ্রগতি ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে ইআরডিকে।