৩৪ শতাংশ বাজার হিস্যার লক্ষ্য নিয়ে জুনে বিএসআরএমের নতুন কারখানায় উৎপাদন শুরু হচ্ছে
দেশের শীর্ষস্থানীয় ইস্পাত উৎপাদনকারী– বিএসআরএম চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে ২১৭ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে নির্মিত তাদের নতুন কারখানা চালু করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কারখানাটির বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা ৮ লাখ টন। বর্তমানে বাজারে কোম্পানিটির বাজার হিস্যা ২৩ শতাংশ, নতুন কারখানার মাধ্যমে যা ৩৪ শতাংশে উন্নীত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। দেশে ইস্পাত পণ্যের বর্ধিত চাহিদা মেটাতেও অবদান রাখবে এই স্থাপনা।
বিএসআরএমের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) তপন সেনগুপ্ত দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, 'চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে প্রায় ২০ একর জমিতে ইস্পাত কারখানা নির্মাণ প্রকল্পের ৯৫ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। আমাদের লক্ষ্যমাত্রা জুন মাসের শেষ দিকে অথবা জুলাইয়ের শুরুতে পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরু করা। এরপর এক মাসের মধ্যে পুরোপুরি বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু হবে।'
নতুন কারখানায় প্রায় এক হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হবে বলেও টিবিএসকে জানান তিনি।
নতুন এই রি-রোলিং কারখানা স্থাপনের জন্য জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা– জাইকা থেকে ৫০ মিলিয়ন ডলারের স্বল্প-সুদের ঋণ পেয়েছে বিএসআরএম। জাপানি ঋণদাতাটির পরিবেশবান্ধব (গ্রিন) শিল্প স্থাপনকে উৎসাহিত করার উদ্যোগের আওতায়, বাংলাদেশের বেসরকারি খাতের প্রথম প্রতিষ্ঠান হিসেবে এই ঋণ পেয়েছে বিএসআরএম।
এই সম্প্রসারণ বিএসআরএমের মোট উৎপাদন ক্ষমতা ২৪ লাখ টনে উন্নীত করবে, এতে ইস্পাত বাজারের এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি তারা নিয়ন্ত্রণ করবে বলে আশা করছে।
বিএসআরএমের তথ্যমতে, নতুন কারখানা নির্মাণ প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ২১৭ মিলিয়ন ডলার—বাংলাদেশি মুদ্রায় যা প্রায় ২৫০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাইকা ঋণ দিচ্ছে ৫০ মিলিয়ন ডলার। এই ঋণ পরিশোধ করতে হবে ১২ বছরে। গত বছরের ৪ অক্টোবরে এই ঋণচুক্তি সই হয়।
এর বাইরে ভারতের এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট ব্যাংক ১২ বছর মেয়াদে ২০ মিলিয়ন ডলার, সিঙ্গাপুরের স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক ৭ বছর মেয়াদে ১৩ মিলিয়ন ডলার, এবং ব্র্যাক ব্যাংক ৭ বছর মেয়াদে ২৫ মিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছে। এসব ঋণ বৈদেশিক মুদ্রায় দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া দেশীয় মুদ্রায় প্রাইম ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড (ইডকল)-সহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান অর্থায়ন করেছে। নতুন কারখানা স্থাপনের পাশাপাশি বিএসআরএমের মিরসরাইয়ের একটি মেল্টিং কারখানার বার্ষিক উৎপাদন ৫ লাখ টন থেকে ৭.৫ লাখ টনে উন্নীত করা হয়েছে প্রকল্পটির অধীনে।
বাংলাদেশ স্টিল রি-রোলিং মিলস লিমিটেড (বিএসআরএম) এবং বিএসআরএম স্টিল লিমিটেড উভয় প্রতিষ্ঠানই পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত, তারা ইস্পাত পণ্যের পাশাপাশি ইস্পাতের কাঁচামাল বিলেট (ক্রুড স্টিল) উৎপাদন করে।
বর্তমানে এই শিল্পগোষ্ঠীটির নাসিরাবাদ শিল্প এলাকায় ও ফৌজদারহাটের দুটি রি-রোলিং কারখানায় বছরে ১৬ লাখ মেট্রিক টন ইস্পাত উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। মিরসরাইয়ে স্থাপিত নতুন ইউনিটটিও রোলিং কারখানা।
এছাড়া, চট্টগ্রাম নগরীর নাসিরাবাদ শিল্প এলাকায় দুটি ও মিরসরাইয়ে দুটিসহ– মোট চারটি মেল্টিং কারখানায় বছরে ২৪ লাখ মেট্রিক টন বিলেট উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে।
নতুন কারখানায় ইস্পাত পণ্যের পাশাপাশি তার-জাতীয় পণ্যের কাঁচামাল স্টিল ওয়্যার তৈরি করা হবে।
বিএসআরএমের ডিএমডি তপন সেনগুপ্ত বলেন, 'আমাদের স্টিল ওয়্যার ইন্ডাস্ট্রির জন্য বছরে ৮৫ হাজার মেট্রিক টন স্টিল ওয়্যার আমদানি করতে হয়। আমদানি-নির্ভরতা কমাতে, নতুন কারখানার ৮ লাখ টনের মধ্যে দেড় লাখ টন ওয়্যার স্টিল উৎপাদনের সুযোগ রাখা হয়েছে।'
সবুজ শিল্পায়নকে উৎসাহিত করছে জাইকা
জাইকা ঐতিহ্যগতভাবে এমআরটি লাইন, মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরের মতো মেগা-প্রকল্পে সরকারকে ঋণ দিয়ে এসেছে। তবে বেসরকারি খাতে প্রথম ঋণ পেয়েছে বিএসআরএম স্টিল লিমিটেড । মূলত সবুজ শিল্পকে উৎসাহিত করতে এই ঋণ দিয়েছে জাইকা।
গত বছরে ঋণচুক্তি পর একটি বিবৃতিতে জাইকা উল্লেখ করে, ইস্পাত কারখানাগুলো থেকে পরিবেশ দূষণকারী উপাদান ও গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ একটি প্রধান চ্যালেঞ্জ। এই ঋণ বাংলাদেশের ইস্পাত শিল্পের কারখানাগুলোয় সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন সুবিধা, বায়ুদূষণ ব্যবস্থাপনার প্রযুক্তি, বর্জ্য পানির পরিশোধনের ব্যবস্থা এবং অন্যান্য সহায়ক সুবিধা পুনর্ব্যবহারকে উৎসাহিত করবে; যা এ শিল্পে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির প্রসার ও গ্রিন হাউজ গ্যাস নিঃসরণ কমাতে অবদান রাখতে পারবে।
বিএসআরএমের কর্পোরেট বুকলেটে উল্লেখ করা হয়, পরিবেশের প্রতি দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে, বিএসআরএম তাদের সবগুলো কারখানায় জাপানি বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ (এপিসি) ব্যবস্থা প্রয়োগ করে শূন্য নিঃসরণ নিশ্চিত করেছে। এছাড়া, ইস্পাত শিল্পের ডাস্ট সংগ্রহ থেকেও আয় করেছে বিএসআরএম। ২০১৫ সাল থেকে তারা ২২.৬ মিলিয়ন ডলার মূল্যের ডাস্ট রপ্তানি করেছে। বিএসআরএম তাদের কারখানার জন্য উচ্চমানের ইউরোপীয় পানি পরিশোধনাগারে (ডব্লিউটিপি) বিনিয়োগ করেছে, যা বছরে ৩ লাখ ৭৩ হাজার ৭০০ ঘনমিটার শিল্পে ব্যবহৃত পানিকে পুনর্ব্যবহারের উপযোগী করে, ফলে পানির অপচয়ও হয় না।
এছাড়া বিএসআরএমের ইস্পাত কারখানায় বছরে উৎপন্ন ১ লাখ ২০ হাজার টন স্লাগ বর্জ্যকে ইটের বিকল্প হিসেবে পরিবেশবান্ধব নির্মাণসামগ্রীতে রূপান্তর করা হয়। এই উদ্যোগের জন্য 'এসডিজি ব্র্যান্ড চ্যাম্পিয়ন অ্যাওয়ার্ডস ২০২৩' পেয়েছে বিএসআরএম।
বিএসআরএমের ডিএমডি তপন সেনগুপ্ত বলেন, 'আমাদের কারখানায় ব্যবহৃত পানি পুনর্ব্যবহার করা হয়; ফলে জিরো ওয়েস্টেজ। সবগুলো কারখানায় এপিসি রয়েছে। কারখানার জন্য প্রয়োজনীয় বিদ্যুতের সংস্থান সৌরবিদ্যুৎ দিয়ে মেটানোর পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। ইস্পাত কারখানাগুলোর জন্য প্রায় ১০ মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎ প্রয়োজন। ধাপে ধাপে তা স্থাপন করা হবে।'
কোম্পানির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্যমতে, সুদীর্ঘ সময় ধরে পদ্মা সেতু, রূপরূপ পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, হাতিরঝিল প্রকল্প, জিল্লুর রহমান ফ্লাইওভার, মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার ও শাহ আমানত সেতুসহ দেশের প্রধান প্রধান অবকাঠামো ও ল্যান্ডমার্ক নির্মাণে বিএসআরএমের ইস্পাত পণ্যকে নির্বাচন করা হয়েছে।
১৯৫২ সালে 'ইস্ট বেঙ্গল স্টিল রি-রোলিং মিলস' নামের প্রথম ইস্পাত কারখানা স্থাপনের মাধ্যমে ৭২ বছরের সুদীর্ঘ পথচলার ইতিহাস রয়েছে এ প্রতিষ্ঠানের। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর নাম বদল করে রাখা হয় বাংলাদেশ স্টিল রিরোলিং মিলস (বিএসআরএম)। এরপর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সম্প্রসারণ হতে থাকে ব্যবসা।
কোম্পানির তথ্যমতে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে তারা ১৭ লাখ ৭৭ হাজার ৬৭০ মেট্রিক টন ইস্পাত পণ্য বিক্রি করে আয় করেছে ১ দশমিক ৬৯১ বিলিয়ন ডলার। বিএসআরএম বর্তমানে প্রায় পাঁচ হাজার প্রত্যক্ষ এবং প্রায় ২৫ হাজার পরোক্ষ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে।
বাংলাদেশের ইস্পাত প্রস্তুতকারক সমিতির তথ্যমতে, দেশে ৫৫টি স্টিল রি-রোলিং মিল এবং ১০০টির বেশি সেমি-অটো ও ম্যানুয়াল মিল রয়েছে, যেখানে বছরে মোট ৭০ থেকে ৭৫ লাখ টন ইস্পাত উৎপাদন হয়। উৎপাদিত ইস্পাতের ৫০-৫৫ লাখ টন দেশে ব্যবহৃত হয়। বাকিটুকু বিদেশে রপ্তানি হয়।
দেশে ব্যবহৃত মোট ইস্পাতের ৬০ শতাংশ যায়– সরকারের অবকাঠামো প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে। বাকিটা বেসরকারি খাতে ব্যবহার হয়।