এলসি খুলতে পারছে না প্রথম সারির ভোগ্যপণ্য বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো, রমজানে সংকটের শঙ্কা
ভোগ্যপণ্যের আমদানিকারক ও বিপণনকারী প্রথম সারির কোম্পানিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় সিটি গ্রুপ রমজানের বাড়তি চাহিদা মেটাতে ভোজ্য তেল, চিনি, গম, সয়াবিন সীড আমদানির চেষ্টা করছে কয়েক মাস ধরে। কিন্তু ডলার সংকটের কারণে সরকারি, বেসরকারি ও বিদেশি ২৮টি ব্যাংকের দারস্থ হয়েও চাহিদা অনুযায়ী এলসি খুলতে পারেনি।
এই অবস্থা শুধু সিটি গ্রুপের নয়, ভোগ্যপণ্য বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান মেঘনা, টিকে, বসুন্ধরা সহ বেশিরভাগ কোম্পানির। ভোগ্যপণ্যের এলসি খুলতে না পারায় প্রতিষ্ঠানগুলো রমজানে সরবরাহ সংকটের কথা বলছে। বাজারে অবশ্য এখনই রমজানের বাড়তি চাহিদা সম্পন্ন পণ্যগুলো চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে, কোন কোন পণ্যের ক্ষেত্রে এটা সরকার নির্ধারিত দামের চেয়েও বেশি দাম দিয়ে কিনতে হচ্ছে ভোক্তাকে।
সিটি গ্রুপ সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে ভোগ্যপণ্যের এলসি খোলার বিষয়ে সহযোগিতা চেয়ে চিঠি দিয়েছে। চিঠিতে প্রতিষ্ঠানটি তাদের ভোগ্যপণ্য আমদানির পরিকল্পনা তুলে ধরেছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, প্রতিষ্ঠানটি চিনি, গম, ছোলা, সয়াবিন তেল, পাম তেল, সয়াবিন সীড সহ মোট ৭.২৩ লাখ মেট্রিক টন ভোগ্যপণ্য আমদানি করতে চায়। যার জন্য প্রয়োজন ৪২.৩০ কোটি মার্কিন ডলার। কিন্তু এসব পণ্য আমদানির এলসি খোলার জন্য প্রতিষ্ঠানটি সরকারি, বেসরকারি ও বিদেশি ২৮টি ব্যাংকের দারস্থ হয়। কিন্তু কোনো ব্যাংকের মাধ্যমেই এলসি খুলতে পারেনি।
সিটি গ্রুপের চেয়ারম্যান ফজলুর রহমান বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে জানান, 'বেশ কিছুদিন ধরে ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে ঋণপত্র খুলতে না পারায় প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য আমদানি করতে পারছি না। এতে সরবরাহ লাইনে ঘাটতি হতে পারে।'
এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহকে এলসি খোলার বিষয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা এবং এলসি সেটেলমেন্টের সময়ে প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা সরবরাহের নিশ্চয়তা প্রদান করার বিষয়ে সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে।
তবে ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম শফিকুজ্জামান টিবিএসকে বলেন, 'আমাদের কাছে যে তথ্য আছে, তাতে পণ্যের মজুদ ও সরবরাহ ভালো আছে। এখন রমজানের আগে ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন ধরনের ইস্যু তুলবে, সমস্যা দেখানোর চেষ্টা করবে। কিন্তু শঙ্কার কিছু নেই। আমরা আমদানি থেকে শুরু করে বাজারজাত পর্যন্ত কঠোর মনিটরিং করছি।'
সিটি গ্রুপ যে ২৮টি ব্যাংকের মাধ্যমে এলসি খুলতে পারেনি বলে তালিকা দিয়েছে, তার একটি জনতা ব্যাংক। জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুস সালাম আজাদ বলেন, 'জনতা ব্যাংকের গেন্ডারিয়া শাখার মাধ্যমে ব্যাংকের সামর্থ অনুযায়ী সিটি গ্রুপের ভোগ্যপণ্য আমদানির এলসি ওপেন করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে যদি বলা হয় এলসি খোলা যাচ্ছে না সেটা সত্য নয়।'
তিনি বলেন, 'আমরা ভোগ্যপণ্য আমদানির জন্য নিয়মিত এলসি ওপেন করছি। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকও সর্বোচ্চ সহযোগিতা করছে। আশা করছি রমজানে কোন পণ্যের সংকট হবে না।'
মার্চের শেষভাগে শুরু হবে রোজা। গত বছরের অক্টোবর, নভেম্বর থেকেই ব্যবসায়ীরা প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির চেষ্টা করে যাচ্ছেন বলে জানা গেছে। কিন্তু চাহিদা অনুযায়ী, ডলার না পাওয়ায় এলসি খুলতে পারছেন না। যে কারণে গত বছরের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত তেল, চিনি, ডাল, ছোলা, খেজুর সহ বিভিন্ন ভোগ্যপণ্যের আমদানি একেবারেই তলানিতে নেমেছে। ২০২১ সালের এই তিন মাসের তুলনায় ২০২২ সালের এই তিন মাসে এলসি খোলার প্রবণতা অনেক কম লক্ষ্য করা গেছে।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারী) ভোগ্যপণ্যের আমদানি আগের অর্থবছরের তুলনায় কমেছে ১৮.২ শতাংশ।
যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে, ভোগ্যপণ্যের আমদানিতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এলসি খোলার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তারপরও এই নির্দেশনা মানা হচ্ছে না বলেই অভিযোগ আমদানিকারকদের।
প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, রমজানে তেল, চিনির চাহিদা দ্বিগুণ হয়ে যায়। যে অনুযায়ী বাড়তি যোগান দরকার হয় এবং প্রতিবছর বেশ আগেভাগেই বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো প্রস্তুতি শুরু করে। প্রতি বছর যেখানে রমজানের আগে পণ্যের দাম বাড়ে, এবছর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে তৈরি হওয়া ডলার সংকটের মধ্যে এই প্রস্তুতিতে বাধা পড়েছে আগেই। ব্যবসায়ীদের দাবি সরবরাহ পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার একটা প্রভাব পড়েছে ভোগ্যপণ্যের বাজারে।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ ট্রেড এন্ড ট্যারিফ কমিশনের কর্মকর্তারা বলছেন, টাকার ডি ভ্যালুয়েশনের কারণে আমদানিনির্ভর ভোগ্যপণ্যগুলোর দাম ২৫-৩০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ার কথা। কিন্তু অনেক পণ্যের ক্ষেত্রেই এটা আরও বেশি বেড়েছে। এখন আবার এই সংকট দেখিয়ে রমজানের আগে পণ্যমূল্য আরও বাড়িয়ে দেয়ার শঙ্কা রয়েছে।
ইতোমধ্যেই বাজারে চিনির সরবরাহ সংকট তৈরি হয়েছে। প্রতি কেজি প্যাকেটজাত চিনির দাম সরকার নির্ধারণ করা দিয়েছে ১১২ টাকা। কিন্তু এই চিনি কোনো দোকানে পাওয়া যাচ্ছে না। তবে খোলা চিনি সরকার নির্ধারিত দামের চেয়েও বাড়িয়ে বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১২০-১২৫ টাকায়। কিন্তু ব্যবসায়ীরা বলছেন, ৪-৫ মাস ধরে চিনির স্বাভাবিক আমদানি হচ্ছে না। এ কারণে চিনির বাড়তি দাম। খুচরা দোকানগুলোতে ব্যবসায়ীদের প্যাকেট চিনির সরবরাহ নেই বললেই চলে।
সম্প্রতি ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) এক অনুষ্ঠানে ব্যবসায়ীরা জানান, আসন্ন রমজানে ভোগ্যপণ্যের সরবরাহ এবং মূল্য স্থিতিশীল থাকবে দুটি শর্তে। স্বাভাবিকভাবে এলসি খোলার সুযোগ দিতে হবে এবং স্থানীয় সরবরাহ নিশ্চিতের জন্য কারখানায় গ্যাসের সরবরাহ থাকতে হবে। এই অনুষ্ঠানে তেল, চিনির পাইকারি বিক্রেতারা বলেন, সরকার নির্ধারিত দামে মিলগুলো চিনি বিক্রির ভাউচার দিলেও প্রকৃতপক্ষে বেশি দাম নিচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মেঘনা গ্রুপের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, 'রমজানে খুব বড় সংকট হবে না, কিন্তু সংকট একেবারে এড়ানোর সুযোগও নেই। কারণ অনেক দিন ধরে যে এলসির সমস্যার মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে, তার কিছুটা উন্নতি হলেও পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার মতো নয়।'
তবে গ্যাসের সরবরাহও বাজার পরিস্থিতির উপর একটা বড় ধরনের প্রভাব বিস্তার করবে।
এদিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, আন্তর্জাতিক বাজারে এক বছর আগের তুলনায় ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে অপরিশোধিত সয়াবিন তেলের দাম ১৫ শতাংশ, অপরিশোধিত পাম ওয়েলের দাম ৩৪.৩৪ শতাংশ, মশুর ডালের দাম ১৩.৩৬ শতাংশ এবং ছোলার দাম ৭.৩২ শতাংশ কমেছে। অর্থাৎ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের আগে যে দাম ছিল তার চেয়েও দাম কমে গেছে। কিন্তু এই দাম কমার কোন সুফল আমরা নিতে পারছি না। উল্টো দেশের বাজারে সবকিছুর দাম বেশি।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালের ছয় মাসে চিনির আমদানি কম হয়েছে প্রায় ২ লাখ ৮ হাজার মে. টন। যেখানে ক্রুড পাম ওয়েলের আমদানি কম হয়েছে ১ লাখ ৩২ হাজার মে. টন। এছাড়া একই সময়ে ছোলা আমদানি কমেছে ১৪ হাজার মে. টন এবং খেজুর আমদানি কম হয়েছে ৩৮৯ মে. টন।
একদিকে আমদানি কম হয়েছে, অন্যদিকে কমেছে এলসি খোলার পরিমাণও। রমজানের নিত্যপণ্যগুলোর এলসি খোলার ক্ষেত্রে তুলনামূলক তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালের অক্টোবর, নভেম্বর এবং ডিসেম্বর এই তিন মাসে র-সুগার আমদানির জন্য দেড় লাখ মে. টন কম এলসি খোলা হয়েছে। এর মধ্যে নভেম্বর ও ডিসেম্বরে এলসি খোলার পরিমাণ সবচেয়ে কমে গেছে।
একই অবস্থা সয়াবিন তেল আমদানির ক্ষেত্রেও দেখা গেছে। সয়াবিন তেল আমদানি করা হয় ক্রুড, পরিশোধিত ও সয়াবিন সীড হিসেবে। ক্রুড সয়াবিনের আমদানির এলসি খোলার পরিমাণ ১ লাখ ৬৭ হাজার মে. টন থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ৮৮ হাজার মে. টনে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের আমদানি পরিস্থিতির তথ্য থেকে জানা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম ৭ মাসে (জুলাই-জানুয়ারী) বেশ কয়েকটি নিত্যপণ্যের এলসি ওপেনিং কমে গেছে। এর মধ্যে চাল ও গমের আমদানি আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৫.৬৩ শতাংশ, চিনি ও লবণ আমদানিতে ১৩.৯৩ শতাংশ, দুগ্ধজাত পণ্য ১১ শতাংশ, সব ধরনের ফলে ৪০ শতাংশ, ডালের আমদানির জন্য ১০.১৩ শতাংশ কম এলসি খোলা হয়েছে।
তবে বেড়েছে রিফাইন্ড ও ক্রুড এডিবল ওয়েলের এলসি ওপেনের পরিমাণ।