সকল খাতে বন্ডেড ওয়্যারহাউজ সুবিধা আর বিনা শুল্কে কাঁচামাল আমদানি নিয়ে কমিটির বৈঠক সোমবার
পোশাক শিল্পের মতো সকল খাতে বন্ডেড ওয়্যারহাউজ সুবিধা চালু করা এবং রপ্তানিযোগ্য পণ্যের কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি বিনা শুল্কে আমদানির সুযোগ দেওয়াসহ রপ্তানি খাতের উন্নয়নে করণীয় নির্ধারণে সোমবার বৈঠকে বসছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন রপ্তানি সংক্রান্ত জাতীয় কমিটি।
শতভাগ রপ্তানিমুখী পণ্যের ক্ষেত্রে ডিউটি ড্র-ব্যাক সুবিধা কার্যকর করা এবং এলডিসি গ্রাজুয়েশনের পর ডাব্লিউটিও'র এসসিএম এগ্রিমেন্ট অনুযায়ী দেশীয় উৎপাদন ও রপ্তানিতে কিভাবে প্রণোদনা দেওয়া হবে, সেসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত হতে পারে বলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
আগামী ২০ মার্চ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠেয় এ সভায় অর্থমন্ত্রী, বাণিজ্য মন্ত্রীসহ ১১ জন মন্ত্রী, অর্থসচিব, বাণিজ্য সচিবসহ ১১ জন সচিব, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, বিডা, বেজা, বেপজার নির্বাহী চেয়ারম্যান, এফবিসিসিআই সভাপতিসহ সম্পর্কিত বিভিন্ন চেম্বার ও সমিতির সভাপতি অংশ নেবেন।
সভার প্রস্তুতি হিসেবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় খসড়া আলোচ্যসূচি তৈরি করেছে, যেখানে পণ্য ও সেবা রপ্তানি সম্প্রসারণে বিভিন্ন নীতি সুবিধা দেওয়ার বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
বন্ডেড ওয়্যারহাউজ সুবিধার আওতায় রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের ভেতরে একটি ওয়্যারহাউজ থাকে, যা কাস্টমসের নিয়ন্ত্রণাধীন। ওই কারখানা শুল্কমুক্ত সুবিধায় কাঁচামাল আমদানি করে নিজের কারখানায় রেখে প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবহার করতে পারেন। এতে বন্দরে শুল্ক পরিশোধ বাবদ তার বাড়তি অর্থ ব্যয় করতে হয় না। আবার বন্দর থেকে কাঁচামাল ছাড়াতেও বাড়তি সময় লাগে না।
অন্যদিকে, যেসব রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানে এ সুবিধা নেই, তাদের কাঁচামাল আমদানির সময় শুল্ক পরিশোধ করতে হয়। পরে ওই কাঁচামালে তৈরি পণ্য রপ্তানি করে পরিশোধিত শুল্ক ফেরত পেতে এনবিআরে আবেদন করতে হয়। এনবিআর অডিট ও যাচাই-বাছাই শেষে তা ফেরত দেয়। এতে প্রায় ৪-৫ বছর সময় লাগে বলে বাংলাদেশ ট্রেড এন্ড ট্যারিফ কমিশনের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
রপ্তানির ক্ষেত্রে লিড টাইম কমিয়ে আনতে ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ তৈরি পোশাক শিল্পের জন্য স্পেশাল বন্ডেড ওয়্যারহাউজ সুবিধা চালু করে। ২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় তৈরি পোশাক রপ্তানিতে কোটা সিস্টেম বাতিল হওয়ার পর এ সুবিধা জনপ্রিয়তা লাভ করে। পরে জেনারেল বন্ডেড ওয়্যারহাউজ সুবিধার আওতায় ডিমড এক্সপোর্ট, এক্সেসরিজ ও শিপ বিল্ডিং শিল্পে বন্ডেড ওয়্যারহাউজ সুবিধা চালুর কথা বলা হলেও পোশাকখাতের বাইরে এ সুবিধা বিস্তৃত হয়নি।
তবে শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানি করা বিভিন্ন পণ্য অবৈধভাবে খোলাবাজারে বিক্রির অভিযোগ রয়েছে। শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানি করা পণ্য খোলাবাজারে বিক্রি হলে রাজস্ব হারায় সরকার। এ অবস্থায় সকল খাতে বন্ডেড ওয়্যারহাউজ সুবিধা চালু করতে হলে কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের সক্ষমতা আরও বাড়াতে হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
কাঁচামাল আমদানির সময় পরিশোধ করা শুল্ক ফেরত দেওয়ার জন্য এনবিআর পৃথক ডিউটি এক্সেম্পশন অ্যান্ড ড্রব্যাক অফিস স্থাপন করলেও ব্যবসায়ীরা তা নিয়মিতভাবে ফেরত পান না বলে অভিযোগ রয়েছে। রপ্তানি পণ্য বহুমুখীকরণের স্বার্থে শতভাগ ও আংশিক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সহজে ডিউটি ড্র-ব্যাক সুবিধা দিতে প্রায় দু'বছর আগে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করেছে বাংলাদেশ ট্রেড এন্ড ট্যারিফ কমিশন।
বিভিন্ন সময় বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকেও এ বিষয়ে এনবিআরকে অনুরোধ করা হয়েছে, তবে পরিস্থিতির খুব বেশি উন্নতি হয়নি বলে ব্যবসায়ীদের অভিযোগ রয়েছে।
২০২১ সালের জুলাই মাসে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ট্রেড এন্ড ট্যারিফ কমিশন জানায়, বাংলাদেশে প্রায় ৭৫০টি রপ্তানিযোগ্য পণ্য রয়েছে, যার মধ্যে ৬৫৯টি লোহা ও ইস্পাত, রাসায়নিক, ইলেকট্রনিক্স এবং বৈদ্যুতিক ও ফার্নিচার খাতের আংশিক রপ্তানিমুখী শিল্পের অন্তর্গত।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই শিল্পগুলোকে তাদের কাঁচামালের ৮০%-৯০% আমদানি করতে হবে এবং ২৫% থেকে ৬৫% এর মধ্যে শুল্ক দিতে হবে; এদের স্থানীয় মূল্য সংযোজন হার ৩৫% থেকে ৭০% এর মধ্যে।
২০২০ সালে সানেম আয়োজিত অ্যানুয়াল ইকোনমিকস্ট'স কনফারেন্সে পিআরআই এর চেয়ারম্যান জায়েদি সাত্তার বলেন, ২০১৮ সালে বাংলাদেশ ১,৬০৫টি পণ্য রপ্তানি করে, যার মধ্যে প্রায় ২৫০টি তৈরি পোশাক পণ্য।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, রপ্তানি বহুমুখীকরণের জন্য ব্যবসায়ীদের দিক থেকে বিভিন্ন ধরণের নীতি সহায়তা চাওয়া হচ্ছে। এছাড়া, রপ্তানি নীতি আদেশে অন্যান্য খাতেও তৈরি পোশাক শিল্পের মতো বিভিন্ন সুবিধা দেওয়ার কথা উল্লেখ রয়েছে।
কিন্তু এসব বিষয় কার্যকর করতে হলে সরকারের অন্যান্য সংস্থার সহযোগিতা প্রয়োজন। প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে টাস্কফোর্স সভা সিদ্ধান্ত দিলে সংস্থাগুলো তা বাস্তবায়ন করতে বাধ্য হবে বলে মনে করছেন তারা।
এ প্রেক্ষাপটেই রপ্তানি সম্প্রসারণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন বিষয় সরকারের উচ্চ পর্যায়ের টাস্কফোর্স সভায় এজেন্ডা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত রাখা হয়েছে। রপ্তানি নীতি আদেশে ২০২৪ সালের মধ্যে রপ্তানি আয় ৮০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন টাস্কফোর্সের সদস্য ও ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি মো. জসিম উদ্দীন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, শুল্কমুক্ত সুবিধায় কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি আমদানির সুবিধা বিশ্বজুড়েই আছে। বাংলাদেশেও এ সুবিধা থাকা প্রয়োজন। প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে এটি গুরুত্ব পাবে।
তিনি বলেন, বর্তমানে শুধু তৈরি পোশাক শিল্পে বন্ডেড ওয়্যারহাউজ সুবিধা আছে। অন্যান্য খাতকে রপ্তানিমুখী করতে হলে তাদের জন্যও এ সুবিধা চালু করতে হবে। পাশাপাশি তৈরি পোশাক শিল্পের চেয়ে বাড়তি সুবিধা দিতে হবে। কারণ, পোশাক শিল্প ইতোমধ্যে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা অর্জন করেছে।
প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে তৈরি পোশাক শিল্প মালিকরাও বিভিন্ন সমস্যার সমাধান আশা করছেন। বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকরাচার্স এন্ড এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম টিবিএসকে বলেন, পোশাকখাতের উন্নয়নে দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা বিভিন্ন ইস্যুর সমাধান প্রধানমন্ত্রী দেবেন বলে আশা করছি।
সভায় রপ্তানিযোগ্য পণ্যের কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি বিনা শুল্কে আমদানি সুবিধা দেওয়ার বিষয়ে আলোচনা হবে। বর্তমানে রপ্তানিমুখী শিল্পের মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিতে ১% হারে শুল্ক দিতে হয়। এছাড়া, বন্ডেড ওয়্যারহাউজ সুবিধাপ্রাপ্ত তৈরি পোশাক শিল্পের বাইরে অন্যান্য শিল্পের কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে কোন কোন ক্ষেত্রে বিভিন্ন হারে শুল্ক কর আরোপ আছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় মনে করে, মূলধনী যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানি শুল্কমুক্ত হলে রপ্তানি খাতে বিনিয়োগ আরও বাড়বে। আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের প্রতিযোগিতা সক্ষমতাও বাড়বে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ীরা দীর্ঘদিন ধরে পোশাক শিল্পের মতো অন্যান্য খাতেও বন্ডেড ওয়্যারহাউজ সুবিধা দাবি করে আসছেন। এ প্রেক্ষাপটে বিদ্যমান আমদানি নীতি আদেশে এ ধরণের সুবিধা দেওয়ার অঙ্গীকার করেছে সরকার। কিন্তু জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এখনও তা কার্যকর করেনি।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, এলডিসি গ্রাজুয়েশনের পরও নন-এগ্রিকালচার পণ্য রপ্তানিতে প্রণোদনা বা ভর্তুকি অব্যাহত রাখতে বাংলাদেশ ডাব্লিউটিও'র তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার চেষ্টা করছে। এজন্য ২০১৮ সালে ডাব্লিউটিওতে আবেদন করেছে বাংলাদেশ। তবে এখনও এ বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত হয়নি।
অন্যদিকে, কৃষি ও খাদ্যপণ্য রপ্তানিতে ভর্তুকি সুবিধা অব্যাহত রাখতে নেট ফুড ইম্পোর্টিং কান্ট্রি হিসেবে ডাব্লিউটিও'র স্বীকৃতি পেতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সরকার।
এ দু'টি চেষ্টা ব্যর্থ হলে দ্য এগ্রিমেন্ট অন সাবসিডিস অ্যান্ড কাউন্টারভেইলিং মেজারস (এসসিএম এগ্রিমেন্ট) এর আওতায় কিভাবে রপ্তানির বিপরীতে প্রণোদনা অব্যাহত রাখা যাবে, তা নিয়েও আলোচনা হবে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন জাতীয় কমিটির সভায়।
বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশ কিভাবে রপ্তানিতে প্রণোদনা ও ভর্তুকি দিচ্ছে, তার তথ্য ইতোমধ্যে যোগাড় করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। সেগুলো পর্যালোচনা করে বাংলাদেশ করণীয় নির্ধারণ করবে।
এছাড়া সভায় রপ্তানি খাতে করোনা মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব পর্যালোচনা করাসহ পণ্য ও সেবা বহুমুখীকরণের কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন নিয়ে আলোচনা হবে। পণ্য ও সেবা রপ্তানি বাড়াতে বিদ্যমান বাজার সম্প্রসারণ ও নতুন বাজার সৃষ্টির উপায় নির্ধারণ ও বাস্তবায়ন বিষয়ে নির্দেশনা দেবেন প্রধানমন্ত্রী।