বাংলাদেশ যেভাবে এখনও যুক্তরাষ্ট্রে অন্যতম শীর্ষ পোশাক রপ্তানিকারক
কোনো শুল্কমুক্ত সুবিধা ছাড়াই বাংলাদেশ এখনও যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় বৃহত্তম পোশাক সরবরাহকারী দেশ। একদিকে পোশাক খাতে চীনের প্রভাব কমছে। অন্যদিকে আমদানীকারকরা ভিয়েতনামের বাইরেও বিকল্প খুঁজছেন; এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ কি আমেরিকান বাজারে তার অবস্থান ধরে রাখতে পারবে? যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কমিশনের সর্বশেষ প্রতিবেদন ইঙ্গিত দিচ্ছে, বাংলাদেশ ইতোমধ্যে সেই পথেই রয়েছে।
৩০ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কমিশন (ইউএসআইটিসি) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতারা বাংলাদেশকে চীন ও ভিয়েতনামের সম্ভাবনাময় বিকল্প হিসেবে মনে করেন। তারা মনে করেন, পোশাক খাতের কিছু ক্যাটাগরিতে চীনের সাথে পাল্লা দিতে পারে এমন কয়েকটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম।
ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশসহ অন্যান্য গন্তব্যস্থলের মতো মার্কিন বাজারে বাংলাদেশের জন্য কোনো শুল্ক সুবিধা না থাকলেও মার্কিন বাজারে বাংলাদেশের রপ্তানি বৃদ্ধি প্রশংসার দাবি রাখে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
২০২৩ সালে, যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ ৭ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে, যা মোট রপ্তানির ১৭ দশমিক ৪ শতাংশ। অন্যদিকে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১৮ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার।
২০১৩ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে বাংলাদেশ তার শীর্ষ রপ্তানি গন্তব্যগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। যুক্তরাজ্যে ৫১ দশমিক ৫ শতাংশ, কানাডায় ৩১ দশমিক ৯ শতাংশ এবং জাপানে ১২৩ শতাংশ রপ্তানি বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জানিয়েছে এই প্রতিবেদন। যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির (ইউএস ট্রেইড রিপ্রেজেন্টেটিভ) জন্য বাংলাদেশ, কম্বোডিয়া, ভারত, ইন্দোনেশিয়া এবং পাকিস্তানের পোশাক শিল্পের প্রোফাইল তৈরিতে প্রস্তুত করা হয়েছে।
২০১৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ থেকে ৪ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলারের পোশাক আমদানি হয়েছিল, যা ২০২২ সালে ৯ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছায়। যদিও ২০২৩ সালে কিছুটা কমেছে, তবুও বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় বৃহত্তম পোশাক সরবরাহকারী হিসেবে তার অবস্থান ধরে রেখেছে।
ইউএসআইটিসি-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ থেকে আমদানি করা পোশাকের ওপর ২০২৩ সালে গড়ে ১৬ দশমিক ৯ শতাংশ শুল্ক প্রয়োগ করা হয়েছিল, যেখানে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান এবং কানাডা বাংলাদেশকে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দিয়েছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হচ্ছে বাংলাদেশের পোশাকের শীর্ষ ১০টি রপ্তানি গন্তব্যের মধ্যে একমাত্র দেশ, যারা শুল্ক সুবিধা বা বিশেষ বাজার প্রবেশাধিকার দেয় না।
ইউএসটিসি-এর প্রতিবেদনে বাংলাদেশের পোশাক খাতের অগ্রগতির ভূয়সী প্রশংসা করা হলেও ভারতের সংবাদমাধ্যম বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের পোশাক খাত নিয়ে নেতিবাচক প্রচারণা চালিয়েছে।
২১ অক্টোবরের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ;বাংলাদেশের পোশাক খাতে উদ্বেগ বাড়ছে'। এই প্রতিবেদনে 'ক্রমবর্ধমান বিশ্বাসযোগ্যতা'র জন্য ভারতকে একটি পছন্দসই পোশাক উৎস হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
ইউএসআইটিসি-র প্রতিবেদন ভুলভাবে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, "ব্র্যান্ডগুলো রাজনৈতিকভাবে কম স্থিতিশীল দেশের তুলনায় ভারত থেকে উচ্চ মূল্যের বা ফ্যাশন সামগ্রী সংগ্রহে বেশি আগ্রহী..."
কিন্তু ইউএসআইটিসি তাদের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বা পোশাক খাত নিয়ে এমন কোনো উদ্বেগের উল্লেখ করেনি।
যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য কমিশনের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ২০১৩ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় রপ্তানি খাতটি উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই সময়ে রপ্তানি ২৪ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ৩৯ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, যা মোট রপ্তানির ৮২ থেকে ৮৬ শতাংশ দখল করে রেখেছে।
১৯৯০-এর দশকের শুরুর দিকে বাংলাদেশের মোট পোশাক রপ্তানির প্রায় ৫০ শতাংশ ছিল যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে, যা ২০২৩ সালে কমে ১৭.৪ শতাংশে দাঁড়ায় কারণ "বাংলাদেশি পোশাক শিল্প নতুন গন্তব্য বাজার চিহ্নিত করেছে এবং শুল্কমুক্ত সুবিধা প্রদানকারী দেশগুলোতে রপ্তানি স্থানান্তরিত হয়েছে।"
তবুও, ২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মোট পোশাক আমদানির ৯ শতাংশ এসেছে বাংলাদেশ থেকে, যা ২০১৩ সালে ছিল ৬ শতাংশ। এর মধ্যে নিট পোশাকের প্রবৃদ্ধি বোনা পোশাকের তুলনায় বেশি ছিল। এই সময়ে, যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ থেকে আমদানিকৃত পোশাকের মধ্যে ম্যান-মেড ফাইবার (এমএমএফ) বা কৃত্রিম সুতার পোশাকের অংশও ১৭ শতাংশ থেকে বেড়ে ২৫.৩ শতাংশে পৌঁছেছে।
প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, এই সময়ে এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের দুটি প্রধান সরবরাহকারী দেশের মধ্যে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটেছে; চীন থেকে আমদানি ১৬.৮ শতাংশ কমেছে এবং ভিয়েতনাম থেকে আমদানি ৭.৮ শতাংশ বেড়েছে।
প্রতিবেদনে উল্লিখিত পাঁচটি দেশের আমদানির মোট অংশ ২১.৩ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২৭ শতাংশ হয়েছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের মোট পোশাক আমদানিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কমিশন (ইউএসআইটিসি) জানিয়েছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ থেকে পোশাক সংগ্রহকারী ব্র্যান্ড ও খুচরা বিক্রেতার সংখ্যা এবং প্রতিটি কোম্পানির সংগ্রহের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ৮০% ব্র্যান্ড ও খুচরা বিক্রেতা বাংলাদেশ থেকে তাদের সংগ্রহ বৃদ্ধি করেছে। এছাড়া ২০ শতাংশের বেশি সংস্থা জানিয়েছে, তাদের মোট অর্ডারের ৩০ শতাংশের বেশি বাংলাদেশ থেকে আসছে, যা ২০১৭ থেকে ২০১৯ সালের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশকে কম খরচের পোশাক সরবরাহকারী হিসেবে গড়ে তোলার পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে। যদিও সাধারণত কম শ্রমিক খরচের কথা বলা হয়, কিন্তু দেশীয়ভাবে কাঁচামাল সংগ্রহের ফলে ইনপুট খরচ কমে যাওয়া, বৃহৎ উৎপাদনের সুযোগ, শিল্প ভর্তুকি এবং শুল্কমুক্ত সুবিধা [বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে বৃহৎ বাজারগুলোতে] বাংলাদেশের পোশাক উৎপাদকদের উৎপাদন খরচ কম রাখতে সহায়তা করে।
বাংলাদেশের প্রতিযোগিতামূলক শক্তির অন্যতম কারণ হলো উল্লম্ব সমন্বয় এবং দেশীয়ভাবে টেক্সটাইল উৎপাদন, যা বাণিজ্য খরচও কমিয়ে আনে।
এই সুবিধাগুলোর কারণে বাংলাদেশ এমন একটি দেশ হিসেবে স্বীকৃত, যেটি বড় পরিমাণের ভারী অর্ডারের জন্য চীনের সাথে খরচের দিক থেকে প্রতিযোগিতা করতে পারে। এছাড়া, চীন ও ভিয়েতনামের বিকল্প একটি প্রতিশ্রুতিশীল উৎস হিসেবে বাংলাদেশকে দেখা হচ্ছে।
প্রতিবেদন অনুসারে, বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের দ্রুত বিকাশের পেছনে দুটি গুরুত্বপূর্ণ সরকারি পদক্ষেপ উল্লেখ করা হয়েছে: বন্ডেড গুদাম এবং পৃথক ঋণ সুবিধা। এসব পদক্ষেপের ফলে কম খরচে এবং বেশি প্রতিযোগিতামূলকভাবে শিল্পটি এগিয়েছে।
এছাড়া, রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশের সরকারের প্রদত্ত কর সুবিধা থেকেও লাভবান হয়। তবে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, সরকার এই কর সুবিধার কিছু অংশ কমানোর কথা বিবেচনা করছে, যা শিল্পের খরচ ও প্রতিযোগিতা ক্ষমতায় প্রভাব ফেলবে কি না; তা এখনও পরিষ্কার নয়।
বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের বড় কারখানাগুলো বিশাল অর্ডার পূরণের ক্ষমতা রাখে, যা প্রতি পণ্যে ওভারহেড খরচ কমায় এবং বৃহৎ উৎপাদনের সুবিধা বৃদ্ধি করে। ইউএসআইটিসি-এর প্রতিবেদনে এক মার্কিন ব্র্যান্ডের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ চীনের বাইরে একমাত্র দেশ যেখানে বড় পরিসরে সোয়েটার তৈরি করা সম্ভব।
প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, বৈশ্বিক আঘাতের প্রতি শিল্পের দুর্বলতা কমানোর লক্ষ্যে, বাংলাদেশ ধীরে ধীরে প্রাথমিক পোশাকের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে উচ্চমূল্যের, উচ্চ মূল্য সংযোজিত পণ্যগুলোর দিকে মনোনিবেশ করছে।
বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের প্রতিযোগিতামূলক ক্ষমতা এর উচ্চ-মানের, কম খরচের পোশাক উৎপাদন এবং স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত কাঁচামালের ব্যবহারের ওপর নির্ভর করে। ২০১৮ সালের তুলনায় ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে ন্যূনতম মজুরি পর্যালোচনায় সর্বনিম্ন স্তরের পোশাক শ্রমিকদের মজুরি ৫৬.৩ শতাংশ বেড়েছে। তা সত্ত্বেও, বাংলাদেশের ন্যূনতম মজুরি এখনও বিশ্বের মধ্যে অন্যতম সর্বনিম্ন, যার কারণ হিসেবে পর্যবেক্ষকরা কম ইউনিয়নকরণের হারকে উল্লেখ করেছেন।
যদিও পোশাক খাতে শ্রমিকদের মজুরি অন্যান্য উৎপাদন খাতের চেয়ে গড়ে বেশি, পাঁচ বছর পরপর মজুরি পর্যালোচনার ফলে শ্রমিকদের মজুরি মুদ্রাস্ফীতির তুলনায় কম থাকার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে বলে মনে করছেন অনেকে।
বাংলাদেশের পোশাক শিল্প কর্মস্থলের নিরাপত্তার মান উন্নত করেছে। তবে সামাজিক দায়বদ্ধতা, বিশেষ করে শ্রম সংক্রান্ত বিষয়ে এখনও সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। প্রতিবেদনে সতর্ক করে বলা হয়েছে, "মার্কিন ক্রেতারা শ্রম আইন লঙ্ঘনের খবর দেখে বাংলাদেশের সঙ্গে ব্যবসা না করার সিদ্ধান্ত নিতে পারে।"