মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আমদানি ঠেকাতে সিএন্ডএফ এজেন্টদের স্ক্যানারের আওতায় আনবে এনবিআর
মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আমদানি ঠেকাতে ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরোয়ার্ডিং এজেন্ট (সিএন্ডএফ এজেন্ট)দের তালিকা সংগ্রহের কাজ শুরু করেছে কাস্টমস বিভাগ।
আমদানিকার কাছ থেকে পাওয়া তালিকার বাইরের কোন সিএন্ডএফ এজেন্ট আমদানিকারকের বিল অব এন্ট্রি সাবমিট তথা আমদানি কার্যক্রম সম্পাদন করতে পারবে না।
কাস্টমস বিভাগ বলছে, এর ফলে মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আমদানি করে ধরা পড়লে অস্বীকার করার সুযোগ কমে যাবে এবং দোষী আমদানিকারক বা সিএন্ডএফ এজেন্টকে সহজেই ধরা সম্ভব হবে।
এনবিআরের সংশ্লিষ্ট বিভাগের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "প্রাথমিকভাবে বন্ড সুবিধার আওতায় আসা পণ্যের আমদানির ক্ষেত্রে এ ব্যবস্থা চালু হবে। পর্যায়ক্রমে সব ধরনের আমদানি চালানের ক্ষেত্রে তা সম্প্রসারিত হবে।"
"এই ব্যবস্থা পুরোদমে চালু হলে মিথ্যা ঘোষণায় আমদানির সুযোগ কমে আসবে। আমদানি চালান ধরা পড়ার পর দায়ী ব্যক্তিকে আইডেন্টিফাই করা সহজ হবে। যা এতদিন কঠিন ছিলো," বলেন তিনি।
এনবিআর এর সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, প্রতি আমদানিকারকদের কাছে সর্বোচ্চ তিন জন সিএন্ডএফ এজেন্ট এর নামের তালিকা চাওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে প্রায় তিন হাজার আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান তাদের সিএন্ড এজেন্ট এর নামের তালিকা জমা দিয়েছেন।
আগামী ২ এপ্রিলের পর থেকে সিএন্ডএফ এর তালিকা এনবিআরের অনলাইন সফটওয়্যার এসাইকুডাতে যুক্ত না করে আমদানি-রপ্তানি করতে পারবেন না আমদানিকারকরা।
কর্মকর্তারা আরও বলেছেন, তারা ইতোমধ্যে আমদানিকারকদেরকে তাদের অনুমোদিত সিএন্ডএফ এজেন্ট কার্যক্রম সম্পর্কে অবহিত করা শুরু করেছেন। বিল জমা দেওয়া, ট্যাক্সেশন এবং পণ্য খালাসের বিষয়ে এসএমএসের মাধ্যমে জানানো হচ্ছে আমদানিকারকদেরকে।
এনবিআরের কাস্টমস উইং সূত্র জানিয়েছে, দেশে বন্ড সুবিধার আওতায় তালিকাভুক্ত আমদানিকারকের সংখ্যা ৮৪২২টি, আর তালিকাভুক্ত সিএন্ডএফ এজেন্ট সংখ্যা ১০ হাজারের সামান্য বেশি।
এনবিআরের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, গত কয়েক বছর ধরে বিপুল পরিমাণ সিগারেট, মদ সহ উচ্চশুল্কের পণ্য বন্ড সুবিধার আমদানি চালানের নামে বাংলাদেশে আসার পর ধরা পড়েছে।
ধরা পড়ার পর যে প্রতিষ্ঠানের নামে আমদানি করা হয় তারা দাবি করে, ওই সিএন্ডএফ এজেন্ট তাদের নাম ব্যবহার করে আমদানি করেছে। এর ফলে আমদানিকারককে ধরা যায় না। আবার পণ্য চালান ধরা পড়ার পর সিএন্ডএফ এজেন্ট এরও হদিস পাওয়া যায় না।
সূত্র জানায়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই অনিয়মে বন্ড সুবিধার আওতায় আনা আমদানিকারকের বিজনেস আইডেন্টিফিকেশন নম্বর (বিআইএন) ব্যবহার করা হয়।
২০২১ সালে চট্টগ্রাম বন্দরে সাভারের ভার্সেটাইল অ্যাটায়ার লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠানের নামে হ্যাঙ্গার আমদানি হয় চীন থেকে, যা ছিলো বন্ডেড সুবিধাপ্রাপ্ত। কিন্তু পরীক্ষা করা পর সেখানে পাওয়া যায় ৩ কোটি টাকা মূল্যের বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সিগারেট, যার শুল্ক-করের পরিমাণ প্রায় ১৪ কোটি টাকা।
ভার্সেটাইল অ্যাটায়ারের এর নামে বিল অব এন্ট্রি সাবমিট করেছিলো (আমদানি প্রক্রিয়া সম্পন্নকারী) জয়িতা ট্রেড করপোরেশন নামে চট্টগ্রামের একটি সিএন্ডএফ এজেন্ট।
কিন্তু পরবর্তীতে আমদানিকারক (যার নামে বিল অব এন্ট্রি সাবমিট করা হয়) জানান, ওই সিএন্ডএফ এজেন্ট কিংবা আমদানি সম্পর্কে তিনি কিছুই জানেন না।
প্রায় দুই বছর পরে গত বৃহস্পতিবার কথা হয় ভার্সেটাইল অ্যাটায়ারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তফা ইমরুল কায়েসের সঙ্গে। টিবিএসকে তিনি বলেন, "আমার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগের কোন সত্যতা পাওয়া যায়নি, যার কারণে আমাদের কোন সমস্যা হয়নি। তখন প্রমাণ হয় যে, একটা চক্র এ ধরনের কাজ করছে।"
তিনি বলেন, "আমার বিআইএন নকল করে এটা করেছিলো ওই সিএন্ডএফ এজেন্ট। যেখানে আমাদের ব্যাংকের টিটি (টেলিফোনিক ট্রান্সফার) হয়নি, এলসি (লেটার অব ক্রেডিট) ফর্ম এ স্বাক্ষর হয়নি, পাশ বইতে এন্ট্রি হয়নি, এমনকি আমার হ্যাঙ্গারের কোন অর্ডারও ছিলো না। সেটা আমার আমদানি হয় কী করে?"
কিন্তু ওই সিএন্ডএফ এজেন্টের কী হয়েছে, তা তিনি আজও জানেন না উল্লেখ করে ইমরুল বলেন, "যারা জড়িত, তাদের ধরে বিচারের আওতায় না আনলে এ অনিয়ম রোধ করা যাবে না।"
এনবিআরের উদ্যোগ নিয়ে আমদানিকারকদের মিশ্র প্রতিক্রিয়া
বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান টিবিএসকে বলেন, "এটি ইতিবাচক উদ্যোগ। এর ফলে একজনের নামে চাইলেই পণ্য আমদানি করা যাবে না, যা কমপ্লায়েন্ট তৈরিতে সহায়ক হবে। এই উদ্যোগে সবাইকে কো-অপারেট করা উচিত।"
অবশ্য বিজিএমইএ-র সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, "বর্তমান ব্যবস্থাই যথেষ্ট। যারা সার্ভিস দেয় (কাস্টমস অফিসিয়ালদের ইঙ্গিত করে), তাদের ম্যানেজ না করে কোনদিন কিছু করা সম্ভব নয়। ফলে কার্যকর অটোমেশন ছাড়া কার্যকর সুফল আসবে না।"
এনবিআরের নতুন এ উদ্যোগে ব্যাংকগুলোকে যুক্ত করা এবং কার্যকর অটোমেশন না হলে তা কার্যত ফলপ্রসু হবে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের পাশাপাশি কাস্টমস পলিসির মেম্বার হিসেবে দায়িত্ব পালনরত এনবিআরের সাবেক সদস্য লুৎফর রহমান টিবিএসকে বলেন, "পুরো প্রক্রিয়ার মধ্যে ব্যাংককে যুক্ত না করলে এর সুফল মিলবে না। এছাড়া অটোমেশনও প্রয়োজন হবে।"