আগামী তিন অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণের প্রতিশ্রুতি ও অর্থছাড় কমবে: ইআরডি
বৈদেশিক মুদ্রার সংকট কাটাতে এবং এলডিসি উত্তরণের আগে যখন স্বল্প সুদে বেশি পরিমাণ বৈদেশিক ঋণ ও অনুদান প্রয়োজন, তখন আগামী তিন অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণের প্রতিশ্রুতি ও অর্থছাড়ের পরিমাণ গত অর্থবছরের তুলনায় কমে যাবে বলে ধারণা করছে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)।
একইসঙ্গে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, এমআরটি এবং মাতারবাড়িসহ সরকারের বিভিন্ন মেগা প্রকল্পে নেওয়া বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধ বাবদ আগামী অর্থবছরগুলোতে বাড়তি অর্থ ব্যয় করতে হবে বলে অর্থ বিভাগকে জানিয়েছে ইআরডি।
তবে ২০৩৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ ও সুদ পরিশোধে ব্যয় সহনীয় পর্যায়ে থাকবে বলে মনে করছেন ইআরডি কর্মকর্তারা।
আগামী বুধবার অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া সরকারের আর্থিক, মুদ্রা ও মুদ্রা বিনিময় হার সংক্রান্ত কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিলের সভা ও সরকারি সম্পদ কমিটির সভার জন্য প্রস্তুত করা ইআরডি'র এক প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
সভায় ফরেক্স রেট, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, সেভিংস, মূল্যস্ফীতির হার, সরকারি ও বেসরকারিখাতের বিনিয়োগ, আমদানি-রপ্তানি ও রাজস্ব আদায় পরিস্থিতি পর্যালোচনার পাশাপাশি আগামী অর্থবছরের বাজেটের বিভিন্ন লক্ষমাত্রা নির্ধারণ নিয়ে আলোচনা হবে বলে জানিয়েছেন অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা।
ইআরডি'র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগামী ২০২৩-২৪ থেকে ২০২৫-২৬ অর্থবছর পর্যন্ত বৈদেশিক ঋণ ও অনুদান ডিসবার্সমেন্টের প্রাক্কলন করা হয়েছে যথাক্রমে ৯.৮৫ বিলিয়ন, ১০.৮৮ বিলিয়ন এবং ১০.৭৭ বিলিয়ন ডলার। ২০২৫-২৬ অর্থবছর পর্যন্ত প্রতিবছর ৬ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি প্রাক্কলন করা হয়েছে।
গত অর্থবছর বৈদেশিক ঋণ ডিসবার্সমেন্টের পরিমাণ ছিল প্রায় ১১ বিলিয়ন ডলার, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। এর আগের অর্থবছর এটি ছিল ১০ বিলিয়ন ডলারের বেশি।
চলতি অর্থবছরও প্রতিশ্রুতির পরিমাণ ৬ বিলিয়ন ডলার, গত অর্থবছর এটি ছিল ১০.৯৫ বিলিয়ন ডলার।
চলতি অর্থবছর ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত গত অর্থবছরের এই সময়ের তুলনায় বৈদেশিক ঋণ ও অনুদানের ডিসবার্সমেন্ট কমে গেছে। গত অর্থবছর এই সময়ে ডিসবার্সমেন্টের পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৫.৯০ বিলিয়ন ডলার।
এবছর এর পরিমাণ ৪.৮৭ বিলিয়ন ডলার, যা লক্ষমাত্রার ২৯.৭২%। চলতি অর্থবছর শেষে বৈদেশিক সহায়তার সংগ্রহের পরিমাণ ৬ বিলিয়ন ডলারের বেশি হতে পারে বলে জানিয়েছে ইআরডি।
গত অর্থবছর ডিসাবার্সমেন্টের পরিমাণ বাড়ার কারণ হিসেবে বাজেট সহায়তা বা উন্নয়ন সহায়তার ১.৮৪ বিলিয়ন ডলার যুক্ত হওয়ায় ওই বছর ডিসাবার্সমেন্টের পরিমাণ অনেক বেশি ছিল বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
ডিসবার্সমেন্ট নিয়ে প্রজেকশনের বিষয়ে ইআরডি বলেছে, বর্তমান পাইপলাইন এবং গত অর্থবছরের ডিসবার্সমেন্ট বিবেচনায় নিয়ে এটি নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে ভবিষ্যৎ ডিসবার্সমেন্টের যে প্রাথমিক প্রজেকশন করা হয়েছে, তা থেকে নমনীয় ঋণ এবং অনুদানের পরিমাণ কমতে পারে এবং ফ্লোটিং রেট যুক্ত ঋণের পরিমাণ বাড়তে পারে।
বৈদেশিক সাহায্যের ডিসাবার্সমেন্ট বাড়াতে প্রকল্প বাস্তবায়ন পর্যায়ে সৃষ্ট বিভিন্ন সমস্যা চিহ্নিত করে তা সমাধানের জন্য ইআরডি ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে উন্নয়ন সহযোগী ও প্রকল্প বাস্তবায়নকারী মন্ত্রণালয় ও সংস্থাগুলোর সঙ্গে ত্রি-পক্ষীয় সভা করলেও পরিস্থিতির খুব একটা উন্নতি হচ্ছে না।
অর্থবিভাগে পাঠানো ইআরডি'র প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের পাইপলাইনের পরিমাণ ৪২.০৮ বিলিয়ন ডলার এবং ঋণের স্থিতির পরিমাণ ৫৯.২১ বিলিয়ন ডলার।
ইআরডি বলেছে, চলতি অর্থবছর বৈদেশিক ঋণের আসল ও সুদ পরিশোধের বাজেট বরাদ্দ যথাক্রমে ১.৮৪ বিলিয়ন ডলার ও ০.৯৪ বিলিয়ন ডলার। অর্থবছরের প্রথম আট মাসে সুদ পরিশোধের পরিমাণ গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় বেড়েছে।
'রাশিয়ান সরকারের অর্থায়নে বাস্তবায়নাধীন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের অর্থায়নে ৫০০ মিলিয়ন ও ১১.৩৮ বিলিয়নের দুটি আর্থিক চুক্তি রয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট জটিলতায় এ প্রকল্পের ঋণের অর্থ পরিশোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। এ বিষয়ে রাশিয়া সরকার পত্রের মাধ্যমে জটিলতা নিরসন না হওয়া পর্যন্ত পরিশোধ স্থগিত রাখতে বলেছে। ফলে এ দুটি ঋণের আসল ও সুদ বাবদ ৩৩০ মিলিয়ন ডলার অপরিশোধিত রয়ে গেছে,' জানিয়েছে ইআরডি।
বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধে বাড়তি ব্যয় হবে উল্লেখ করে ইআরডি বলেছে, 'এমআরটি ও মাতারবাড়িসহ অন্যান্য মেগা প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাজ পুরোদমে চলছে। এর ফলে এসব প্রকল্পে ডিসবার্সমেন্ট বাড়ছে। ফলে প্রকল্পের গৃহিত ঋণের সুদ পরিশোধও চলতি অর্থবছর বেড়ে যাবে। এছাড়া, গত অর্থবছর পাওয়া বাজেট সাপোর্টের সুদও পরিশোধ করা হচ্ছে।'
'অন্যদিকে এলআইবিওআর এবং এসওএফআর এর রেট বৃদ্ধি এবং ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্যমান কমে যাওয়ার কারণেও সুদ পরিশোধের পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে পারে,' যোগ করেছে ইআরডি।
ইআরডি'র হিসাব অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে বৈদেশিক ঋণের আসল ও সুদ পরিশোধে মোট ব্যয় হয়েছে ১.৪২ বিলিয়ন ডলার, আগের অর্থবছরের একই সময়ে এটি ছিল ১.৩৩ বিলিয়ন ডলার।
অন্যান্য বছরের মতো এবারও বৈদেশিক সহায়তার অংশ খরচ করতে না পারায় বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি সংশোধনের সময় এ খাত থেকে বরাদ্দ কাঁটছাট করা হয়েছে।
চলতি অর্থবছরের ২,৪৬,০৬৬ কোটি টাকার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীতে বিদেশি সহায়তা বাবদ বরাদ্দ ছিল প্রায় ৯৩ হাজার কোটি টাকা। সংশোধিত এডিপিতে অভ্যন্তরীণ উৎসের বরাদ্দে কাঁটছাট না হলেও বরাদ্দ থেকে ১৮৫০০ কোটি টাকা কেটে নেওয়া হয়।
দ্রুত বাস্তবায়নের আহ্বান অর্থনীতিবিদদের
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ২০২৬ সালে এলডিসি গ্রাজুয়েশনের পর বাংলাদেশকে বাণিজ্যিক সুদ হারে বা এখনকার চেয়ে বেশি সুদে বৈদেশিক ঋণ নিতে হবে। তাই গ্রাজুয়েশনের আগেই কম সুদে অধিক ঋণ নিয়ে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে গতি বাড়ানো প্রয়োজন।
কিন্তু প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যর্থতার কারণে বিদেশি ঋণের অর্থ প্রতিবছরই ফেরত যাচ্ছে। ফলে বৈদেশিক ঋণের কমিটমেন্ট ও ডিসবার্সমেন্ট বাড়ছে না। তবে এটা আগের অর্থবছরগুলোর তুলনায় কমে যাওয়া কাম্য নয় বলে উল্লেখ করেছেন তারা।
সাবেক অর্থ সচিব মাহবুব আহমেদ বৈদেশিক সহায়তার ডিসবার্সমেন্ট কমে যাওয়ায় হতাশা প্রকাশ করে বলেন, "বৈদেশিক সহায়তার ডিসবার্সমেন্ট বাড়াতে প্রকল্প পরিচালকদের নিয়ে পুল গঠন, তাদের প্রকল্প এলাকায় অবস্থান নিশ্চিত করা এবং পিডিদের বদলি না করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হলেও তার কিছুই বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে না।"
"বাজেট করার সময় বলা হয় টাকা নেই। কিন্তু বাস্তবে আমাদের ব্যয় করার সক্ষমতা নেই। বৈদেশিক তহবিলের ক্ষেত্রে এটি আরও বেশি। কারণ, বিদেশি ফান্ড খরচের ক্ষেত্রে অনেক নিয়ম-কানুন মানতে হয়, অনেক ফর্ম পূরণ করতে হয়। পিডিরা সে সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকেন না। টাকা খরচ করতে না পারার কারণে বিদেশি ফান্ড ফেরত যাচ্ছে। প্রকল্প বাস্তবায়নে দ্ক্ষতা বাড়াতে বহুবছর ধরে অনেক সিদ্ধান্ত ও আলোচনা হলেও এখানে সফলতা নেই," জানান সাবেক এই সিনিয়র সচিব।
তিনি বলেন, "বিদেশি তহবিল ব্যয় করতে না পারলে উন্নয়নে গতি বাড়ানো সম্ভব হবে না। এই মুহূর্তে অভ্যন্তরীণ সম্পদ অনেক কম। গতবার অভ্যন্তরীণ সঞ্চয়ের তুলনায় বিনিয়োগ কিছুটা বেশি ছিল, যা মূলত বিদেশি সম্পদ। আগামী অর্থবছর থেকে ব্যাংক ঋণের সুদহার বাড়লে অভ্যন্তরীণ সঞ্চয় কিছুটা বাড়তে পারে।"
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, "লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী বিদেশি সহায়তা ছাড় করতে হলে বাস্তবায়ন হার ইনিশিয়াল পাইপলাইনের ২০ শতাংশের উপরে নিয়ে যেতে হবে। বর্তমানে এই হার ১২-১৫ শতাংশের মধ্যে রয়েছে। এই বিবেচনায় বিদেশি সহায়তা ছাড়ের এই লক্ষ্যকে উচ্চাভিলাষী মনে হচ্ছে।"
তিনি বলেন, "পাইপলাইনে থাকা অর্থের সঙ্গে ছয় বিলিয়ন ডলার কমিটমেন্ট যোগ হয়ে ১১ বিলিয়ন ডলার ছাড় হলে প্রতি বছর পাইপলাইনের আকার কমবে ৫ বিলিয়ন ডলার। এই হিসাবে পাইপলাইনে থাকা অর্থ ফুরিয়ে আসতে খুব সময় লাগবে না। এখানে প্রশ্ন হলো প্রতি বছর ১১ বিলিয়ন ডলার ছাড় করা সম্ভব হবে কি না। এটা করতে হলে প্রকল্প বাস্তবায়নের সমস্যাগুলো সমাধানের দিকে নিয়ে যেতে হবে।"
তিনি আরো বলেন, "কিছু প্রকল্পের মেয়াদকাল চার-পাঁচ বছর করে বাড়ছে। ইদানিং দেখা যাচ্ছে দাতা সংস্থার বোর্ড থেকে অনুমোদন হওয়ার পরে একনেকের অনুমোদন পেতে ছয় থেকে ১৮ মাস পর্যন্ত লেগে যায়। এমনটা চলতে থাকলে ছয় বিলিয়ন ডলার কমিটমেন্ট আর ১১ বিলিয়ন ডলার ছাড় হবে কীভাবে?"
"আমরা প্রাথমিক পর্যায়েই আটকে যাচ্ছি। অনুমোদনের পরে চুক্তি সই, প্রকল্প অফিস গঠন, প্রকল্প ব্যবস্থাপক নিয়োগ, ক্রয়সংক্রান্ত কাজ, ভূমি অধিগ্রহণসহ বিভিন্ন প্রস্তুতিমূলক কাজে অনেক সময় চলে যায়। এসব ক্ষেত্রে সময়ক্ষেপণের কারণগুলো দূর করতে না পারলে ১১ বিলিয়ন ডলার ছাড়ের লক্ষ্য অনেকটাই উচ্চাভিলাষী থেকে যাবে," যোগ করেন তিনি।