মোটা চালের দাম কমাতে ভর্তুকি বাড়াবে সরকার
আগামী অর্থবছর জুড়ে মোটা চালের দাম সীমিত আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে নামিয়ে আনতে চায় সরকার। এজন্য খাদ্যে ভর্তুকি বাবদ ব্যয় বাড়লেও তা বরাদ্দ দেবে অর্থ মন্ত্রণালয়।
বোরো মওসুমে ধান কাটার পর মফস্বলে মোটা চালের দাম ৪০ টাকা ও ঢাকায় ৪২ টাকার বেশি হলেই ওএমএসের মাধ্যমে কম মূল্যের চালের সরবরাহ বাড়াবে সরকার।
সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানিয়েছেন অর্থ ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
তারা বলছেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে টিসিবির কার্ডধারী এক কোটি পরিবারকে প্রতিমাসে ১৫ টাকা কেজি দরে ১০ কেজি করে চাল দেওয়া হবে।
স্মার্ট কার্ড চালু করে টিসিবির মাধ্যমে চাল সরবরাহ করতে প্রয় ছয় মাস লাগতে পারে। তবে চালের বাজারদরে হস্তক্ষেপ করার অস্ত্র হিসেবে সরকার ওএমএস কার্যক্রমও সচল রাখবে।
বোরো মওসুমে সরকার ঘোষিত ক্রয়মূল্য ৪৪ টাকা বলে উল্লেখ করে গ্রামীণ এলাকায় মোটা চালের দাম ৪০ টাকা এবং রাজধানীতে ৪২ টাকার নিচে রাখা নিয়ে সরকারের এ পরিকল্পনার বিষয়ে ব্যবসায়ীরা সন্দিহান।
তবে এ বছর একটি ভাল ফলন আশা করা হচ্ছে। যদি কোনো মজুদ না থাকে তাহলে মোটা চাল গত কয়েক বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম দামে পাওয়া যেতে পারে।
বাংলাদেশ অটো মেজর হাস্কিং মিলস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি শহীদুর রহমান পাটোয়ারী মোহন জানান, সরকার ঘোষিত ক্রয়মূল্যের চেয়ে চালের দাম কম হবে না।
"সরকারের দাম বাজারের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তবে, যদি কৃষক ও মিলার ছাড়া অন্য মজুতদারদের ধান বা চাল মজুদ করতে না দেওয়া হয়, তাহলে দাম কমবে," তিনি যোগ করেন।
টিসিবি থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, বুধবার রাজধানীর বাজারে স্বর্ণা ও চায়নার মতো মোটা চালের জাত প্রতি কেজি ৪৬ থেকে ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
কৃষি বিপণন অধিদপ্তর জানিয়েছে, বিভিন্ন জেলার বাজারে মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৪৫ থেকে ৪৮ টাকায়। অন্যদিকে ব্যবসায়ীরা দাবি করেছেন, জেলা পর্যায়ে মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৪২ থেকে ৪৪ টাকায়।
মফস্বল পর্যায়ে মোটা চালের দাম ৪০ টাকার বেশি হলেই ওএমএস এর মাধ্যমে চালের সরবরাহ বাড়িয়ে বাজারদর নিয়ন্ত্রণে আনা হবে।
তবে গ্রাম পর্যায়ে এ ধরনের চালের দাম ৪০ টাকা বা তার কম হলে স্বাভাবিকভাবে ওএমএস কার্যক্রম চলবে।
ওএমএস কার্যক্রমে সরকার প্রতিকেজি মোটা চাল ৩০ টাকা করে বিক্রি করে।
অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে ওএমএস বন্ধ করে কার্ড বিতরণ করে তাদেরকে চাল দেওয়ার নির্দেশনা এলেও ওএমএস কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ করা যাবে না। এটি চালের বাজারদর নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকারের হাতে একমাত্র অস্ত্র।
এছাড়া, ধান-চাল সংগ্রহের মওসুমে গুদামে থাকা চাল ওএমএসের মাধ্যমে শহুরে ক্রেতাদের মধ্যে বিক্রি করে গুদাম খালি করা হয়।
অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, চলতি অর্থবছরের বাজেটে খাদ্যে ভর্তুকি বাবদ প্রায় ৬০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল; সংশোধিত বাজেটে এখাতে অতিরিক্ত ৮১২ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
আগামী অর্থবছর খাদ্যে ভর্তুকিতে ৮০০০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রাক্কলন করা হয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানান, "খাদ্যে ভর্তুকি আপেক্ষিক বিষয়। অভ্যন্তরীণ ধানের উৎপাদন ও বাজারদর পরিস্থিতি এবং সরকার চালের বাজারে কতটা হস্তক্ষেপ করবে, তার উপর এই ভর্তুকির পরিমাণ নির্ধারণ হবে।"
"যেমন- সরকার বাজেট ঘোষণার পর এক কোটি পরিবারকে টিসিবির মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে পণ্য সরবরাহ করার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় এ খাতে ভর্তুকি বাড়াতে হয়েছে। বর্তমান সরকারের শেষ বছরে চালের দর সহনীয় রাখতে ওএমএস বাড়ানোসহ অধিক চাল সরবরাহ করার কর্মসূচি নিলে এ খাতে ভর্তুকি আরও বাড়বে," বলেন তিনি।
খাদ্য মন্ত্রণালয়, দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সরকার সাশ্রয়ী মূল্যে খাদ্য সরবরাহ করে থাকে। চলতি অর্থবছরের ২০ এপ্রিল পর্যন্ত খাদ্য মন্ত্রণালয় এবং দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় বিভিন্ন কর্মসূচির আওতায় ২৪,৭৬,০০০ হাজার টন খাদ্য (চাল ও গম) সাশ্রয়ী মূল্যে বিতরণ করেছে।
এছাড়া বাণিজ্য মন্ত্রণালয় টিসিবির মাধ্যমে প্রায় ২,১০,০০০ হাজার টন খাদ্য সরবরাহ করেছে। চলতি অর্থবছর টিসিবির ২.৭৫ লাখ টন খাদ্য সরবরাহ করার পরিকল্পনা আছে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে টিবিএসকে বলেন, "সাশ্রয়ী মূল্যে খাদ্য সরবরাহ বাড়ানোর বিষয়ে সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলে নীতিগত সিদ্ধান্ত রয়েছে। এজন্য আগামী বাজেটে খাদ্য খাতে বাড়তি ভর্তূকিও রাখা হয়েছে। তবে সব কিছু নির্ভর করছে বাজারে চালের দামেরও ওপরে।"
"মোটা চালের কেজি ৪০ টাকা বা তার নিচে থাকলে সরকার বাড়তি সরবরাহ করবে না। তবে ৪০ টাকার বেশি দাম হলে সরবরাহ বাড়িয়ে নাম নিয়ন্ত্রণ করা হবে," বলেন তিনি।
ওই কর্মকর্তা জানান, আগামীতে কার্ডের মাধ্যমে সাশ্রয়ী মূল্যের চাল সরবরাহ করা হবে। এজন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ কাজ করছে। বাজারে স্থিতিশীলতা রক্ষা ও নিম্ন আয়ের মানুষের চাহিদা মেটাতে যখন যেখানে প্রয়োজন হবে সেখানে ওএমএস পরিচালনা করবে খাদ্য অধিদপ্তর।
টিসিবির চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোঃ আরিফুল হাসান টিবিএসকে বলেন, "টিসিবির সুবিধাভোগী এক কোটি পরিবার সরকারের সাশ্রয়ীমূল্যে সরবরাহ করা চাল পাবেন।"
"প্রতি কার্ডের বিপরীতে মাসে ১০ কেজি করে চাল ১৫ টাকা কেজি দরে দেওয়ার প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে এই চাল সরবরাহ শুরু হবে টিসিবির স্মার্ট কার্ড চালুর পরে। এতে ছয় মাস পর্যন্ত সময় লাগতে পারে," বলেন তিনি।
চলতি বোরো মওসুমে ২.১৫ কোটি টন চাল উৎপাদন হবে বলে আশা করছে সরকার। গত বোরো মওসুমে ২.০২ কোটি টন বোরো ধান উৎপাদন হয়েছিল। এবছর অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সরকারের চাল ও গম সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রাও বাড়ানো হয়েছে।পাশাপাশি ধান ও চালের সংগ্রহ মূল্য বাড়িয়েছে সরকার।
৫ এপ্রিল অনুষ্ঠিত খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ কমিটির (এফপিএমসি) সভায় বোরো মৌসুমে ৩০ টাকা কেজি দরে চার লাখ টন ধান ও ৪৪ টাকা কেজি দরে ১২ লাখ ৫০ হাজার টন সিদ্ধ চাল সংগ্রহ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
এবার ৩৫ টাকা কেজি দরে এক লাখ টন গম সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণকরা হয়েছে। আগামী ৭ মে থেকে শুরু হয়ে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত এই সংগ্রহ অভিযান চলবে।
এছাড়া বিদেশ থেকে আমদানিরও উদ্যোগ রয়েছে। সরকারের মজুদ বাড়ানোর মূল লক্ষ্য সাশ্রয়ী মূল্যে সরবরাহ বাড়ানো।