লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় এনবিআরের বড় রাজস্ব ঘাটতি নিয়ে উদ্বেগ
চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ঘাটতি কেবলই বড় হচ্ছে। এমনকী প্রাথমিকভাবে যা ধারণা করা হয়েছিল তার চেয়ে বড় হবে ব্যবধান। বছর শেষে যা ৪০ হাজার কোটি টাকায় ঠেকতে পারে বলে শঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদেরা।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ পর্যন্ত ) লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকা।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এই ঘাটতি বাড়তে থাকলে তা সার্বিক অর্থনীতি ব্যবস্থাপনায় সরকারের জন্য গুরুতর চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারে; কারণ চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে সরকারের নেওয়া ব্যাংক ঋণ চারগুণ বেড়েছে আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায়।
এছাড়া, রাজস্ব সংগ্রহের প্রত্যাশিত গতি না এলে – বাংলাদেশের পক্ষে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের পরবর্তী কিস্তি পাওয়ার শর্তানুসারে কর-জিডিপি অনুপাত (জিডিপিতে রাজস্বের অবদান) বাড়ানো সম্ভব হবে না।
অর্থনীতিবিদ ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) এর নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'রাজস্ব আদায়ের প্রবৃদ্ধির দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছে, লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় বছর শেষে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি থাকতে পারে।'
তিনি বলেন, "বর্তমান কর কাঠামো দিয়ে এনবিআরের পক্ষে আইএমএফ এর শর্ত অনুযায়ী ০.৫ শতাংশ ট্যাক্স-টু-ডিজিপি রেশিও বাড়ানো সম্ভব হবে না। কিছু সংস্কার করলেও তার ফল আসতে তিন-চার বছর সময় লেগে যেতে পারে'।
গত কয়েক মাসে রাজস্ব সংগ্রহ কমতে থাকলেও, মার্চে সার্বিক প্রবৃদ্ধি ছিল ৯ শতাংশের কাছাকাছি। কিন্তু, এনবিআরের গত বছরের রাজস্ব আদায়ের পরিসংখ্যান পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত বছরের একই সময় এই প্রবৃদ্ধি ছিল বর্তমানের প্রায় দ্বিগুণ।
মূলত আমদানি নিয়ন্ত্রণে সরকারের বেশকিছু উদ্যোগ এবং স্থানীয় অর্থনীতিতে প্রত্যাশিত গতি না থাকাকে রাজস্ব আদায় কমার পেছনে মূল কারণ হিসেবে দায়ী করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে রাজস্ব আদায়ে প্রত্যাশিত গতি না আসা কারণ খুঁজতে রোববার মাঠ পর্যায়ের সিনিয়র কর্মকর্তাদের নিয়ে দিনভর রাজধানীর আগারগাঁওয়ের রাজস্ব ভবনে বৈঠক করেছেন এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুুুুুনিম।
বৈঠক সূত্র জানায়, অর্থবছরের বাকী মাসগুলোতে আদায় বাড়াতে বকেয়া আদায়, সরকারির বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে আটকে থাকা রাজস্ব আদায়, ফাঁকি ধরতে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়াসহ বেশকিছু নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি।
এনবিআর সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে আমদানি পর্যায়ে শুল্ক-কর আদায় গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৩.৪৫ শতাংশ বেড়েছে, যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ২০ শতাংশের উপরে।
এনবিআরের আদায়কৃত আমদানি করের প্রায় ৯০ শতাংশই আসে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজের মাধ্যমে।
চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে টিবিএসকে বলেন, 'বিভিন্ন ধরণের যানবাহন, প্রসাধনী, ফলসহ কিছু পণ্যের আমদানি নিরুৎসাহিত করার কারণে এসব পণ্যের আমদানি কমেছে। এসব পণ্যের আমদানি শুল্ক বেশি'।
এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে ২ লাখ ৫৪ হাজার ৫১৭ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে রাজস্ব আদায় হয়েছে ২ লাখ ২৬ হাজার ৭৫১ কোটি টাকা। গড়ে প্রতি মাসে আদায় হয়েছে ২৫ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি।
কিন্তু, ৩ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্য অর্জন করতে হলে পরবর্তী তিন মাসে গড়ে আদায় করতে হবে প্রায় ৪৮ হাজার কোটি টাকা করে, যা কার্যত অসম্ভব বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
আর্থিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে চ্যালেঞ্জ
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-র গবেষণা ফেলো মুনতাসীর কামাল টিবিএসকে বলেন, 'এর ফলে কিছু দরকারি ব্যয় হয়তো কমাতে হবে। এছাড়া সম্প্রতি বৈদেশিক ঋণ কমতির দিকে। ফলে বাজেট ঘাটতি কিছুটা বেড়ে যেতে পারে এবং ব্যাংক থেকে ঋণ বাড়তে পারে, যা বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবাহ সঙ্কুচিত করতে পারে'।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের জানুয়ারি পর্যন্ত সাত মাসে সরকারের ব্যাংক ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৫ হাজার কোটি টাকায়, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ১২ হাজার কোটি টাকা।
আমদানিতে ক্ষীণ আশার আলো
এদিকে দেশের আমদানি-রপ্তানির প্রধান দ্বার চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানি বাড়ছে বলে খবর পাওয়া গেছে।
নাম না প্রকাশের শর্তে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের একজন কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, বিগত কয়েক মাসের তুলনায় মার্চে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানি বেড়েছে, এর ধারাবাহিকতা চলতি এপ্রিলেও দেখা যাচ্ছে'।
পরবর্তী মাসগুলোতে আমদানি স্বাভাবিক হবে – এমন আশার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, 'সেক্ষেত্রে আমদানি পর্যায়ে রাজস্ব আদায়ও বাড়বে'।