সেকেন্ডারি শেয়ারে বিনিয়োগের ওপর কর রেয়াত তুলে নেওয়া হতে পারে
পুঁজিবাজারে সেকেন্ডারি শেয়ারে বিনিয়োগের ওপর বিদ্যমান কর রেয়াত বাতিলের বিষয়ে ভাবছে সরকার। ব্যাংকে সঞ্চয়কারীরা এতে উপকৃত হবেন – এ পদক্ষেপ সরকারের রাজস্বও বাড়াতে পারে; কিন্তু তার অনাকাঙ্ক্ষিত পরিণতিস্বরূপ পুঁজিবাজার থেকে তহবিল চলে আসতে পারে ব্যাংকিং ব্যবস্থায়।
বর্তমানে, করদাতারা পুঁজিবাজার, ডিপোজিট পেনশন স্কিম (ডিপিএস), জীবন বীমা ইত্যাদিতে তাদের করযোগ্য আয়ের সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ পর্যন্ত বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ কর রেয়াত পান।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, সরকার আসন্ন ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে সেকেন্ডারি মার্কেটে বিনিয়োগের ওপর এই রেয়াত প্রত্যাহারের প্রস্তাব দেওয়ার পরিকল্পনা করছে। প্রস্তাবিত সুবিধাগুলি শুধুমাত্র প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও)-তে করা বিনিয়োগের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে।
তারা বলেছেন, কর কর্মকর্তাদের পক্ষে সেকেন্ডারি শেয়ারে বিনিয়োগের হিসাব এবং নিরীক্ষণ করা কঠিন হওয়ায় অর্থ মন্ত্রণালয় প্রাথমিক শেয়ারে বিনিয়োগকে প্রসার করতে চায়।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সভাপতিত্বে সাম্প্রতিক এক সভায় এই প্রস্তাবগুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে এবং আগামী ১৪ মে অনুমোদনের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে উপস্থাপন করা হবে।
তবে অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা এবিষয়ে তাদের আপত্তি তুলে ধরে জানিয়েছেন, এতে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হতে পারে। এটি পুঁজিবাজারের সার্বিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করেন তারা।
তারা আরো উল্লেখ করেন যে, প্রতি বছর জুন মাসে অর্থবছরের শেষদিকে পুঁজিবাজারে উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ করা হয়; প্রস্তাবটি এই নতুন বিনিয়োগ প্রবাহকে সংকুচিত করতে পারে।
সরকারের এমন পদক্ষেপ দেশে বিনিয়োগ প্রবাহকে প্রভাবিত করতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ছায়েদুর রহমান।
তিনি আরও উল্লেখ করেন, প্রতি বছর আইপিওর সংখ্যা খুবই কম হওয়ায় করদাতারা তাদের জন্য নির্ধারিত পরিমাণ আইপিওতে বিনিয়োগ করতে পারবেন না।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সাথে আলাপকালে- বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং পুঁজিবাজার বিশ্লেষক প্রফেসর আবু আহমেদ সরকারের প্রস্তাবের কঠোর সমালোচনা করেন বলেন, এটি অন্যায্য এবং অযৌক্তিক।
সুস্পষ্ট কোনো ব্যাখ্যা ছাড়াই জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) কেন হঠাৎ করে সেকেন্ডারি বাজারে বিনিয়োগের ওপর কর রেয়াত প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত নিতে চাইছে - সে প্রশ্ন রাখেন তিনি।
'এই প্রস্তাব অনুমোদন হলে, মানুষ পুঁজিবাজার থেকে সরে এসে- সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করবে। তখন সরকারকে সঞ্চয়পত্রের ওপর আরও সুদ দিতে হবে, আর সেটাও গ্রহণযোগ্য নয়।'
অধ্যাপক আবু আহমেদ আরও উল্লেখ করেন যে, সেকেন্ডারি শেয়ারে বিনিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ। প্রায় দুই দশক আগে তৎকালীন এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী যখন এই কর রেয়াত সুবিধা চালু করেছিলেন, তখন এর উদ্দেশ্য ছিল পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের উদ্দেশ্যে ঝুঁকি নেওয়া করদাতাদের পুরস্কৃত করা।
তাই এ ধরনের কঠোর পদক্ষেপের প্রস্তাব করার আগে- কেন নীতিনির্ধারকরা বিষয়টি বিবেচনা করেননি - সে প্রশ্নও তোলেন তিনি।
তিনি বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এবং ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জকে (ডিএসই) এই প্রস্তাবের বাস্তবায়ন রোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান।
যেসব খাতে বর্তমানে বিনিয়োগ করলে কর ছাড় পাওয়া যায়, সেগুলো হচ্ছে- সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ, জীবন বীমার প্রিমিয়াম; সরকারি কর্মকর্তার প্রভিডেন্ট ফান্ডে চাঁদা; স্বীকৃত ভবিষ্য তহবিলে নিয়োগকর্তা ও কর্মকর্তার চাঁদা; কল্যাণ তহবিল ও গোষ্ঠী বীমা তহবিলে চাঁদা; সুপার অ্যানুয়েশন ফান্ডে প্রদত্ত চাঁদা; ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বছরে সর্বোচ্চ ৬০ হাজার টাকা ডিপোজিট করলে; পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির প্রাথমিক ও সেকেন্ডারি শেয়ার, স্টক, মিউচুয়াল ফান্ড বা ডিবেঞ্চারে বিনিয়োগ; এবং সরকার অনুমোদিত ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগে।
ডিপিএসে বিনিয়োগের সীমা বাড়বে
আগামী বাজেটে ডিপিএসে বিনিয়োগের সীমা বাড়ানো হবে বলেও মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা উল্লেখ করেন।
বর্তমানে, ডিপিএস-এর জন্য বছরে ৬০ হাজার টাকা (প্রতি মাসে ৫,০০০ টাকা) পর্যন্ত কর ছাড় পাওয়া যায়। এটি ৭২,০০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৭৫,০০০ টাকা করা হতে পারে।
চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট ফার্ম স্নেহাশিস, মাহমুদ অ্যান্ড কোং- এর প্রতিষ্ঠাতা অংশীদার স্নেহাশীষ বড়ুয়া বলেন, ডিপিএস- এ বিনিয়োগের সীমা প্রসারিত করা একটি ভাল উদ্যোগ। এটি ব্যাংকিং এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানে তারল্য বাড়াতে সাহায্য করবে। আজকাল মাসে ১০,০০০ টাকা জমা করা করদাতাদের জন্য বড় কোনো সমস্যা নয়। এই বিবেচনায়, আমরা ডিপিএস সীমা ১,২০,০০০ টাকা পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব করেছি।
২৯ ধরনের নথি জমা দেওয়ার ঝক্কিমুক্ত হতে পারে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান
সূত্রগুলো আরো জানায়, কর রিটার্ন জমা দেওয়ার সময় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ২৯ ধরনের নথি দিতে হতো। আগামী বাজেটে তা কমিয়ে ১২টি করা হতে পারে।
স্নেহাশীষ বড়ুয়া বলেন, এতে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের কর রিটার্ন জমা দেওয়ার প্রক্রিয়া সহজতর হবে।